‘‘কোনো একটা বিশেষ নিয়ম যখন দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তা একদিনেই হয়ে যায় তা নয়। ধীরে ধীরে সম্পন্ন হতে থাকে। ঠিক যেনো ‘সতীদাহের বাইরের চেহারাটা রাজ শাসনে বদলালো, কিন্তু তার ভেতরের দাহ আজও তেমনি জ্বলছে। তেমনি করে ছাই করে আনছে। এ নিভবে কি দিয়ে?’’
শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখনি দিয়েই শুরু করছি, তালাক বিল প্রসঙ্গ। তিন তালাকের বিরুদ্ধে যে বিল লোকসভায় পাশ হলো তাতে মুসলিম সমাজে মহিলাদের কোন ভালো বা উপকার হবে বলে আমি মনে করি না। কারণ ইসলাম মতে তালাক আট প্রকার। এক প্রকার তালাক নিষিদ্ধ ঘোষণা হলেও এখনও সাতপ্রকার তালাক পুরুষের হাতে আছে।
আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে এসব বিল আনা হয়। এরকম বিল ভারতবর্ষে প্রচুর হয়েছে। কিন্তু মানুষ সেই সব বিলের অধিকার বা সুফল পাচ্ছে কী? সংবিধানে মৌলিক অধিকার স্বীকৃত, সেই মৌলিক অধিকার ভারতীয় ক`জন নাগরিক পাচ্ছেন?
দুর্নীতি নিবারণ আইন আছে, দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে কি? ভেজাল বিরোধী আইন আছে, আমাদের দেশে, খাদ্যে ওষুধে ও ভেজাল বন্ধ হয়েছে কি? সিআরপিসি, আইপিসি আছে সেই সব অপরাধ দূর হয়েছে কি? তালাক মানে বিবাহ বিচ্ছেদ। সন্তান রেখে স্ত্রী অন্য লোকের সাথে ঘর করে। স্ত্রী-সন্তান রেখে একটি পুরুষ আরও একটি মেয়েকে বিয়ে করছে।
যে দেশে পরকিয়া বৈধ, অর্থাৎ স্ত্রী, ও স্বামী থাকতেও অন্যের সাথে যৌনতা অপরাধ নয়, সেখানে তালাক ব্যবস্থার আরো সহজীকরণ হওয়া উচিৎ ছিল বলে মনে করি। ভারতীয় সমাজে হিন্দুদের ডিভোর্স অনেক শক্ত ছিল। বর্তমানে অনেক সরলীকরণ হচ্ছে, একটি বৌ থাকতে আরও একটি বিয়ে অপরাধ, ৪৯৪ এ অপরাধ হবে তথাপি প্রথম স্ত্রী থাকতে ২য় বিয়ে হচ্ছে না কি?
সেই কারণে সুপ্রিম কোর্ট বললেন, এক সাথে দীর্ঘদিন থাকলে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে ধরে নেওয়া হবে। এবং যদি সন্তান হয় তাহলে তাদের ওয়ারিশ সূত্রে অধিকার দিতে হবে।
আসলে সমাজ যখন পুরোভাবে অবনমিত হয়, সমাজের কোনো অংশে কোন নীতিনৈতিকতা বলে কিছু থাকে না, যেমন রাজনৈতিক নেতারা, আমলা, মন্ত্রী , পুলিশ, প্রশাসন, ধর্মগুরু, মৌলভী,পাদ্রী, সমাজের এই সব অংশ বেশির ভাগ নৈতিক ভাবে অধঃপতিত।
সমাজের ভালোর দিকে কারো চোখ নেই- তাই চাষী ক্ষেতমজুরদের মজুরি বাড়ে না, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে না, কিন্তু তাদের কথা ভেবে যারা দেশে সেবা করার ব্রত নিয়েছে, তাদেরই বেতন বাড়ছে। যে দেশে শিক্ষা প্রসারের জন্য অর্থ ব্যয় হয় না,অথচ মারণাস্ত্র কেনার জন্য টাকা বেশি ব্যয় হয়। সেই দেশে যে আইনই পাশ করুক-তা মানুষের কল্যাণের জন্য হবে না।
কারণ মঙ্গল-উচিত-অনুচিত এই সব শব্দগুলি সামাজিক পরিমণ্ডলে বহুল ব্যবহৃত। সমাজের ক্রমবিকাশের মাধ্যমে এ গুলি অর্জিত হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী সন্তান,বিবাহ-প্রেম এসব বিষয়ে সচেতন না হলে বৈবাহিক সম্পর্ক মানুষের পারিপার্শ্বিক সম্পর্ক টিকে থাকে না। সব আগে মানুষ হিসাবে মানুষের নৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটানো দরকার। তার জন্য শিক্ষা দরকার।
মানুষকে সমাজ চেতনায় মান বাড়ানো প্রয়োজন। কোন আইন দেশের বা দেশের মানুষের মঙ্গল হবেনা। একটা প্রবাদ আছে, সর্ষের মধ্য ভুত থাকলে সেই সরষের ভুত ছাড়বে না। আমাদের দেশে মহিলাদের জন্য ১২৫ ধারা,৪৯৮ ( ক) ধারা সেকশন ৩ মুসলিম মহিলাদের জন্য আছে।
ডমিস্টিক ভায়োলেন্স আইন আছে। আরও নতুন কোন আইনের প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি না। যে আইন আছে সেগুলো ঠিক মতো প্রয়োগ হচ্ছে কি না,তার সুফল মানুষ বা মহিলারা পাচ্ছে কি না সেগুলো দেখা আগে উচিৎ ছিল,। সেই ১৮০৮ সালের বিচার ব্যবস্থা যা বৃটিশ আমলে ছিল তা কেন আজও আছে? স্বাধীন ভারতের স্বাধীন নাগরিক এর জন্য বিচার ব্যবস্থা, যা দ্রুত নিঃস্পত্তি হবে তার ব্যবস্থা কই? মানুষের বিচারের বাণী নিভৃতে যদি কাঁদে তাহলে আইন করে কিছুই হবে না বলে আমি মনে করি।
লেখক: আইনজীবী ও সমাজকর্মী-মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ।
বহুমাত্রিক.কম