Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

প্রসঙ্গ : আলু ও অন্যান্য সবজির সুষ্ঠু সংরক্ষণ

কৃষিবিদ ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১২:৩৭, ১৪ এপ্রিল ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

প্রসঙ্গ : আলু ও অন্যান্য সবজির সুষ্ঠু সংরক্ষণ

ত্রিশাল, ময়মনসিংহ : আমরা ছোটবেলায় গ্রামে শুনেছি বাবা, চাচা, জেঠারা জমিতে আলু আবাদের জন্য বগুড়া থেকে দেশি আলুর বীজ নিয়ে আসতেন। সেজন্য সেই দেশি আলুর জাতকে ‘বগুড়া আলু’ বলা হতো। ছোট আকারের লাল বর্ণের সেই আলু এখনো দেখা যায় কিন্তু সেগুলোকে এখন আর ‘বগুড়া আলু’ বলা হয় না। বগুড়া আলু নামাকরণ হওয়ার একটি অন্যতম কারণ ছিল তখন সারাদেশের মধ্যে একমাত্র বগুড়াতেই প্রচুর পরিমাণে আলু ফলার জন্য সেখানে বিশেষ ধরণের কোল্ড স্টোরেজ কিংবা সংরক্ষণাগার ছিল। এরপর আস্তে আস্তে বগুড়ার সাথে সাথে মুন্সিগঞ্জ, বৃহত্তর ময়মনসিংহ বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর প্রভৃতি স্থানে ব্যাপকভাবে আলুর আবাদ বাড়তে থাকে। তখন শুধু দেশি আলু নয়, বিদেশ থেকে উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাতের বিভিন্ন আলুর জাত আমদানি হতে থাকে। 


আলু শীতকালীন রবি ফসল। দেশে রবি ফসলের আওতা বাড়তে থাকে, সেইসাথে বাড়তে থাকে আলুসহ অন্যান্য সবজি ফসলের। সেজন্য আলুর উৎপাদন বাড়তে থাকে সেইসাথে চাহিদাও বাড়তে থাকে। চাষের ব্যাপকতাও বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের জলবায়ু ও আবহাওয়া আলু চাষের জন্য এতটাই অনুকুল যে এর উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে একসময় ভাতের পরিবর্তে আলুকেই শর্করা জাতীয় খাবারের প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি ব্যাপকভাবে অলোচিত হতে থাকে।

পুষ্টি উপাদানের ধরণ ও প্রাচুর্য বিবেচনায় আলুতে আছে প্রচুর পরিমাণে শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট। অপরদিকে আমাদের সুষম খাদ্যের ছয়টি উপাদানের মধ্যে মানুষের শরীরের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণে প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান শর্করার প্রধান উৎস হলো ভাত কিংবা আটা। আর সেজন্যই ভাতের পরিবর্তে আলু দিয়ে খাদ্যোভ্যাস পরিবর্তনের বিষয়টি বারবারই সামনে চলে আসে। এগুলো নিয়ে অনেক জনপ্রিয় শ্লোগানও রয়েছে, যেমন- ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের উপর চাপ কমান’, আলু ও রুটি খান, ভাতের উপর চাপ কমান’ ইত্যাদি।

আগেই বলেছি, এক সময় বিশেষ কিছু এলাকাতে বিশেষ বিশেষ কিছু আলুর আবাদ হলেও এখন তা সারাদেশেই ব্যাপকভাবে আবাদ হচ্ছে। বাহারি ও সুস্বাদু দেশি বিদেশি অনেক আলুর জাত এখন বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী করে কৃষকগণ আবাদ করছেন। এসব আরুর বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউিট (বারি) এর কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র মাঠে ময়দানে কাজ করে চলেছে। সেই অগ্রযাত্রায় দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি দেশি বিদেশি বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।

যাহোক, পুষ্টি বিবেচানায় এবং কৃষি বিজ্ঞানের উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের হিসেবে আলু কিন্তু কোন সবজি ফসল নয়। তারপরেও আমরা জানি আলু ছাড়া কোন তরকারি হয় না। এমন কোন তরি তরকারি নেই যেখানে আলু একটি আইটেম হিসেবে খাটে না। সেজন্য অনেক সময় ঠাট্টার ছলে অনেককে আলু বলে ব্যঙ্গ করে ডাকা হয়। আলু এমন একটি ফসল যা সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করতে পারলে তা সারাবছরই খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সেজন্যই প্রয়োজন হয় আলু সংরক্ষণের।

আলু যে শুধু খাওয়ার জন্যই ব্যবহার হয় তা নয়। এটির বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। আলু সংরক্ষণ করে তা পরের বছর আবার বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সারাবছর আমাদের নিজস্ব চাহিদা মেটানোর পরে অনেক আলু উদ্বৃত্ত থেকে যায় যা সহজেই বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। সেজন্যই প্রয়োজন আমাদের মূল্যবান এ কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ। সেজন্য আমাদের জানতে হবে একে কেন সংরক্ষণ করা হয়। আলু সংরক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। এরমধ্যে দেশীয়, প্রচলিত ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। দেশীয় ও প্রচলিত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ প্রযুক্তি কৃষক নিজেই ব্যবহার ও প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষিত জনবলের প্রয়োজন পড়ে।

দেশীয় পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষণের জন্য কোন প্রশিক্ষণ কিংবা প্রযুক্তির দরকার পড়ে না। কৃষক তার নিজস্ব পদ্ধতিতেই তা সংরক্ষন করতে পারে। সেক্ষেত্রে সমস্যা হলো নির্ধারিত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা। সেটি করতে অসুবিধা হয় বলেই এসব দেশীয় পদ্ধতিতে আলু খুব বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না। বেশিদিন উচ্চ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হলে আলুর ভিতরকার পানি শুকিয়ে ফাঁপা পচন শুরু হয়ে যায়। পাশাপাশি আলুর গায়ে থাকা বিভিন্ন চোখ হতে চারা গজিয়ে যায়। এতে আলুর খাদ্যমান নষ্ট হয়ে যায়। সেজন্য আলু দীর্ঘদিন যাবৎ অর্থাৎ প্রায় বছরব্যাপী গুদামজাত করে সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজ বা হিমাগার বাঞ্ছণীয়।

একসময় দেশে শুধুমাত্র নির্ধারিত কয়েকটি স্থানে কোল্ট স্টোরেজ থাকলেও এখন যেসব এলাকায় আলু আবাদের আধিক্য রয়েছে সেসব স্থানেই একাধিক কোল্ট স্টোরেজ বিদ্যমান। সেগুলোর মধ্যে সরকারি পর্যায়ের যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বেসরকারি পর্যায়েরও। দেখা গেছে যেসব এলাকায় কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে সেসব এলাকার আলু চাষীরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়ে লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু যেসব এলাকায় কোল্ড স্টোরেজ নেই সেসব এলাকার আলু চাষীরা মৌসুমর সময়ই নামেমাত্র মূল্যে উৎপাদিত আলু মাঠ থেকেই বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এতে মধ্যস্বত্বভোগীরাই বেশি লাভবান হয়ে যাচ্ছে।

কারণ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) কর্তৃক স্থাপিত হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষণ উৎসাহিত করার জন্য কৃষকদেরকে প্রণোদনা প্যাকেজ ও ভর্তুকি দেওয়া হয়ে থাকে। তাছাড়া বিএডিসি মূলত কৃষকদের মাধ্যমেই তাদের চুক্তিবদ্ধ চাষীদের মাধ্যমে বীজ আলু উৎপাদন করে তা হিমাগারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। শুধু তাই নয় কৃষকের মাঠে সেই আলু আবাদে সকল খরচ বহন করে থাকে। সেজন্য সেখানকার কর্তৃপক্ষ উন্নতমানের বীজ, সার, সেচসহ অন্যান্য সবধরনের উপকরণ সরবরাহ সুবিধা এমনকি রোগ-পোকামাকড় দমনেও সহযোগিতা দিয়ে থাকে। পরবর্তীতে উৎপাদিত আলু ফসলের একটি বিরাট অংশ বাজারে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে বীজ হিসেবে হিমাগারে সংরক্ষণের জন্য কৃষকদের কাছ থেকে নগদমূল্যে কিনে নেয়। তাতে সেসকল চুক্তিবদ্ধ আলু চাষীরা আর্থিকভাবে খুবই লাভবান হওয়ার সুযোগ পায়।

বেসরকারি পর্যায়ে যেসব আলু সংরক্ষণের জন্য যেসকল হিমাগার রয়েছে সেগুলোতেও আলু রাখলে কৃষকদের জন্য হিমাগার কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। তার মধ্যে যে দিনগুলোতে কৃষক বা কোন আলু ব্যবসায়ীর আলু রাখা হলো তার বিপরীতে একটি ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে দেন তারা। তাতে কৃষকরা সরাসরি লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকে। এবং যেহেতু কৃষককে অর্থের জন্য কিংবা সংরক্ষণাগারের অভাবে আলু রাখতে না পেরে যে আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়তে হয়, তা ব্যাংক লোনের মাধ্যমে কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়।

সেভাবেই আলু হিমাগার থেকে অল্প অল্প করে বের করে উত্তোলন করা হয় এবং তা আস্তে আস্তে তরকারি হিসেবে খাওয়ার জন্য বাজারে ছাড়া হয়। তখন বাজারের চাহিদা যেমন মিটে অপরদিকে তা বিক্রি করে পূর্বেও তুলনায় বেশি দাম পাওয়া যায়। সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আলু বিদেশেও রপ্তানি করা হয়ে থাকে। আর এখন যে শুধু আলুই বিদেশে রপ্তানি করা হয় তাই নয় অন্য নানারকম সবজিও বিদেশে রপ্তানি করা হয়। সেগুলো রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হয়।

এখন কথা উঠতে পারে আলুসহএসব সবজি ফসল হিমাগারে গুদামজাত করলে ভোক্তা পর্যায়ে এর মূল্য বৃদ্ধি পায় কিনা। কিন্তু মোটেও তা নয়। কারণ দেখা গেছে সারাবছর হিমাগারে আলু রাখলেও যে পরিমাণ খরচ হয় তাতে মাত্র কেজিতে ২-৩টাকা দাম বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে আমাদের দেশের সবজিই এখন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে রপ্তানি হচ্ছে। সবজি একটি পচনশীল দ্রব্য হওয়া সত্ত্বেও রপ্তানি থেকে শুরু করে সেখানে গিয়ে বিক্রি হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সময় সেগুলো টাটকা ও সতেজ রাখা হয় শুধুমাত্র হিমাগারে সংরক্ষণের মাধ্যমে।

কাজেই শুধু আলু নয় তার সাথে অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সবজি ফসল হিমাারের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। সেগুলোর মধ্যে পিয়াজ সংরক্ষণ, রসুন সংরক্ষণ, টমেটু সংরক্ষণ, অন্যান্য সবজি সংরক্ষণ ইত্যাদি। আর এসব পণ্যের ব্যাপক সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে হলে শুধু সরকারি পর্যায়েই যথেষ্ট নয়। কৃষিকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে সকল পর্যায়ের ব্যবসায়ীকেই এখাতে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষিত হয়ে এগিয়ে আসতে হাবে। সারাদেশে প্রয়োজন অনুসারে আলুসহ আরো অনেক সবজি ফসলের জন্য হিমাগার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তাহলেই একদিকে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ হবে এবং প্রান্তিক কৃষকদের উন্নতির মাধ্যমে পুরো দেশেরই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

 [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer