Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

হারিয়ে যাচ্ছে ঝিনাইদহের ঐতিহ্যের বাঁশ শিল্প

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০১:১৪, ১৮ মার্চ ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

হারিয়ে যাচ্ছে ঝিনাইদহের ঐতিহ্যের বাঁশ শিল্প

ছবি-সংগৃহীত

ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহ জেলায় এক সময় শহর ও গ্রাম সবখানে বাঁশের তৈরী মোড়া ও মিটসেফ’র ব্যবহার ছিলো সচারাচার। বাড়িতে মেহমান আসলে মোড়ায় বসতে দেয়ার দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না। এখনকার মানুষ এগুলোকে সেকেলে ভাবে।

বর্তমানে প্লাস্টিকের চেয়ার দখল করেছে মোড়ার স্থান। রান্নাঘরেও ঢুকেছে বাঁশের পরিবর্তে লোহার পাত দ্বারা তৈরী মিটসেফ। একসময় গ্রামে বাঁশের তৈরী ঝুড়ি, ধামা, মোড়া, কুলা, মাছধরার নানান জাতের ফাঁদ ধান রাখার ডোল, গোলা ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। কালের আবর্তে আধুনিক সভ্যতার উৎকর্ষতায় হারিয়ে যেতে বসেছে এসবের ব্যবহার। শুধু হারায়নি গভীর দরদে সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় যারা এসকল জিনিস পত্র তৈরী করতো সে সকল কারীগর।

পূর্ব পুরুষের শেখানে এসকল কাজ এখনও করে যাচ্ছে তারা তবে বাণিজ্যিকভাবে নয় নিজেদের ব্যাবহারের জন্য ও খুচরা দু’একটি বিক্রির উদ্দেশ্যে। শিবনগরের বাঁশ শিল্পী বিমল দাস জানান, বর্ষাকালে আগের মতো পানি না হওয়ায় এবং কৃষিতে কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যাবহারে খাল বিলে মাছ না থাকায় মাছ ধরার নানান ফাঁদ তৈরী করা বাদ দিয়েছেন অনেক আগে।

এদিকে কৃষক আর গোলা ভরে ধানও রাখতে পারেনা কারণ ধান ওঠার সাথে সাথে বিক্রি করে উৎপাদন ব্যায় পরিশোধ করতে হয়। কাজেই ব্যবহার কমেছে গোলা আর ডোলের। তাই এখন ঝুড়ি, টেপারী ও চাটাই এর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে কালীগঞ্জের বাঁশ শিল্প।

অথচ একসময় ছিল কি শহর কি গ্রাম প্রতিটি বাড়িতে বাঁশের তৈরী জিনিসপত্র ছাড়া যেন কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু কালের আর্বতে আমাদের বাঁশ শিল্প এখন মৃত প্রায়। কালীগঞ্জের অনেক ঋষি পরিবার পূবর্ পুরুষের পেশা ছেড়ে চলে গেছে অন্য পেশায়। কিন্তু এখনও এ শিল্পকে আঁকড়ে আছে পোড় খাওয়া স্বল্প সংখ্যক শিল্পী যারা পূর্ব পুরুষের শেখানো কাজের ওপর মেধা ও শ্রম দিয়ে দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন মৃতপ্রায় এ শিল্পটিকে। কালীগঞ্জের বিমল দাস, তারা দাস, সুধীর দাস, চম্পাদাস, আরতী দাস তাদের কয়েক জন।

বাঁশ শিল্পী বিমল দাস জানান, দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে তিনি এ পেশায় আছেন। লাভ কম হলেও মাঠে কৃষি জমি না থাকায় এখনও এ পেশায় জড়িত থাকতে হচ্ছে তাকে। শিব নগরের বিমল দাস ও চম্পা দাস জানান, তারা স্বামী স্ত্রী ২ জনে মিলে দিনে ৪/৫টি টেপারী তৈরী করে। প্রত্যেকটি টেপারী ৩৫ টাকা দরে বিক্রি করে। এতে টেপারী প্রতি ১৫ টাকা করে লাভ থাকে। এদিয়েই কোন রকমে চলছে তাদের সংসার। তবে এবার কয়েকদিন টানা বর্ষা হওয়ায় মাছ ধরার ফাঁদ তৈরী করে বেশ কিছু বাড়তি আয় হয়েছে।

প্রশান্তি ভরা নিঃশ্বাস ছেড়ে চম্পা দাস বলেন, ভগবান যদি প্রতি বছর এরকম বৃষ্টি দিতো তাহলে দুমুঠো খেয়ে পরে বাচতে পারতাম। অন্য জিনিসের চাহিদা কম থাকায় তারা এখন ঝুড়ি ও টেপারীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ শিল্পের চাহিদা কমতে থাকায় অনেক পরিবার বর্তমানে পূর্ব পুরুষের পেশা ছেড়ে এখন অন্য পেশায় গেছেন। শিবনগরের সুধীর দাস ও আরতী দাস জানান, তাদের ছেলেরা এখন ফার্নিসারের কাজ করেন। পূর্ব পুরুষের পেশা ছাড়তে কষ্ট হয় তাই তারা দু’জন বাড়িতে বসে ঝুড়ি ও টেপারী তৈরী করেন।

চাঁচড়া গ্রামের সমীর দাস শুধু চাটই তৈরী করেন দিনে ২ টি করে চাটাই তৈরী করা সম্ভব হয় বলে তিনি জানান। একটা চাটাই বিক্রি হয় ২২০ টাকায়। তৈরী করতে খারচ পড়ে ১৪০ টাকা। চাঁচড়া গ্রামের তারাপদ দাস জানান, বাঁশের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আগের মতো লাভ হয় না। কালীগঞ্জের ভাটপাড়া জগন্নাথপুর, বেজপাড়া রেলগেট, ভোলাডাঙ্গা, বালিয়াডাঙ্গা, শিবনগর, চ্চঁড়া এলাকার ঋষিপরিবারের অনেক সদস্যই পূর্ব পুরুষের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় গিয়েছেন। তারা জানান পুঁজি না থাকায় তারা দ’একটি করে বিক্রি করায় লাভ খুবই কম হয়। পুঁজি থাকলে একবারে অনেক মাল বিক্রি করতে পারতো এতে লাভও ভালো হতো।

বর্তমানে চট্টগাম, মুন্সিগঞ্জ, যশোর সহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বাঁশের তৈরী বাহারী সৌখিন জিনিসপত্রের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। শহুরে পরিবারে, অফিস, রেস্তারায় রঙ তুলির ব্যবহার করা বাঁশ ও বেতের তৈরী জিনিস সোপিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিদেশের বাজারেও এর রয়েছে ব্যপক চাহিদা। এতে ভালো মুনাফাও পাওয়া যায় বলে জানতে পেরেছেন এ অঞ্চলের বাঁশ শিল্পীরা। কিন্তু রঙ তুলি দিয়ে বাহারী জিনিসপত্র কিভাবে তৈরী করতে হয় সে কৌশল জানা নেই তাদের।

কালীগঞ্জের বাঁশ শিল্পীরাও চায় তাদের তৈরীকৃত জিনিস পত্রে শৈল্পিক রুপ দিতে। এজন্য কালীগঞ্জের বাঁশ শিল্পীরা সরকারী বা বেসরকারীভাবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং সুদমুক্ত ঋণ দিতে সরকারের কাছে জোর দাবী জানান। অন্যদিকে শিল্পপ্রেমীরা চান কোন ভাবেই যাতে দেশের ঐতিহ্যবাহী এই বাঁশ শিল্প কালের আর্বতে হারিয়ে না যায়।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer