Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪

হাওরবাসীর আর্তনাদ : আসুন দুর্দশাগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াই

কৃষিবিদ ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১৬:৪৮, ২২ এপ্রিল ২০১৭

আপডেট: ১৭:০৭, ২২ এপ্রিল ২০১৭

প্রিন্ট:

হাওরবাসীর আর্তনাদ : আসুন দুর্দশাগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াই

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি বিরাট অংশ ভাটি এলাকার হাওর হিসেবে পরিচিত। বৃহত্তর সিলেটের জেলাসমূহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ে এ বিশাল হাওর এলাকা গঠিত। এ এলাকার একটি বিশেষত্ব হলো সেখানে বছরে ৭ মাসই পানিতে তলিয়ে থাকে। বছরে মাত্র একটি ফসল বোরোধান উৎপাদিত হয়ে থাকে। এসময়ে সেখানে প্রাকৃতিকভাবেই মিঠাপানির অনেক দেশি প্রজাতির মাছ উৎপাদিত হয়ে থাকে। এ অঞ্চলে উৎপাদিত বিচিত্র ও বাহারি রকমের ধান ও মাছ দেশের চাহিদা মিটিয়ে ক্ষেত্র বিশেষে বিদেশেও রপ্তানি হয়ে থাকে।

এ অঞ্চলের একটি বড় রকমের দুঃখ হলো আগাম বন্যা ও অতিবৃষ্টি। প্রতিবছরে একমাত্র বোরো ফসল কাটার সময় এলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে শিলাবৃষ্টি ও আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের। কিন্তু প্রতিবছরই কিছু না কিছু ফসল বিনষ্ট হলেও এবছর (২০১৭) অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন জরিপকারী সংস্থাসমূহ। সেখানে বিস্তীর্ণ হাওর এলাকায় প্রায় দুই লক্ষাধিক হেক্টর জমির ধান ফসল যার বারো আনা নষ্ট হয়েছে। সেখানে ৫ লক্ষাধিক মেট্রিক টন ধান নষ্ট হয়েছে যার বাজারমূল্য প্রায় এক হাজার কোটি টাকারও বেশি।

শুধুমাত্র মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত হাকালুকি হাওরেই নষ্ট হয়েছে ২৫ মেট্রিক টন বিভিন্ন বিরল প্রজাতির মাছ। বৃষ্টির পানিতে আধাপাকা ধানের গাছ পানির নিচে চলে যাওয়ায় সেখানে সেগুলো পঁচে গিয়ে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে। সেই দুর্গন্ধে পানিতে অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস সৃষ্টি হয়ে পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। পানির স¦াভাবিক পিএইচ মান ৭ থেকে ৩-৪ এ নেমে গিয়ে পানি এসিডিক হয়ে পড়ছে। এতে মারা যাচ্ছে মাছসহ পরিবেশের জীববৈচিত্রের অন্যান্য সজীব উপাদানসমূহ। এগুলো সমাধানের জন্য যদিও মৎস্য ও কৃষি বিভাগ চুনসহ অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহার করে পানির স্বাভাবিক পিএইচ মাত্রায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে, তারপরও তড়িৎ কোন ফল পেতে দেরি হচ্ছে। ঠিক সেকারণে বিষাক্ত মাছ ধরে যাতে জনস্বাস্থ্যের কোন সমস্যা সৃষ্টি না হয় সেজন্য সেখানে সাতদিন মাছ ধারার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

সেখানকার বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা গেছে, এবারের আগাম বর্ষা ও বন্যা বিগত প্রায় ১২০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এত বিশাল ক্ষয়ক্ষতি স্মরণকালের মধ্যে আর জীবিত কারো চোখে পড়েনি। সেখানে কারো বাড়িতে ধান নেই, চাল নেই, নেই কোন নগদ অর্থকরি। চারিদিকে শুধু হাহাকার। কারণ একটি মাত্র বোরো ফসল আবাদের জন্য কৃষকরা তাদের সর্বস্ব বিনিয়োগ করে থাকে। এখন তারা সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

আমরা জানি, মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ সেই কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার মানুষ। তিনি সম্প্রতি শেকড়ের টানে সেসব বন্যাপীড়িত মানুষের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার জন্য সেসব এলাকা পরিদর্শন করেছেন। সেখানকার সরেজমিন পরিস্থিতি দেখে তিনি এতটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন যে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৯ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে একটি সমাবর্তনে যোগ দিতে এসেও সেই হাওর এলাকার মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা ও উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

খবর পাওয়া গেছে, সেখানে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সেখানে পরিবার প্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।

কেন হলো এবারের এমন ভয়াবহ অবস্থা? কারণ অন্যান্য বছরগুলোতে বর্ষাটা সাধারণত বৈশাখের শেষের দিকে শুরু হয়। কিন্তু এবার তা বৈশাখই শুধু নয় শুরু হয়েছে চৈত্রের শুরুতেই। বিশেষজ্ঞদের ধারণামতে এগুওেলাই আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল। তাছাড়া হাওরের সার্বিক উন্নয়নের জন্য যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলো এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। সেখানে বেড়িবাধ, বিভিন্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধসমূহ যখন সম্পন্ন হবে তখন এধরনের সমস্যা কম হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞগণ।

আমরা জানি-প্রাকৃতিক দুর্যোগের উপর কারো কোন হাত নেই। তবে একে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিছুটা মিনিমাইজ করা যায়। এগুলোকে মিনিমাইজ করার জন্য বর্তমানে সরকারেরর ইচ্ছায় হাওর উন্নয়ন বোর্ডকে আরো শক্তিশালী করা হচ্ছে। সেইসাথে ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি হাওরের কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিবিড়ভাবে গবেষণার মাধ্যমে উন্নয়নের জন্য চালু করা হয়েছে হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। আরো নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক সমন্বিত প্রকল্প। যেগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হলে সামনের দিনগুলোতে আমাদের হয়তো হাওরের মানুষের এমন কান্না আর দেখতে হবে না। তবে এ মুহূর্তে আমাদের সাধ্যমতো তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।

 

লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer