মৌলভীবাজার : চা শ্রমিক আন্দোলনের কিংবদন্তি, বলিষ্ট রাজনীতিক, ভাষা সৈনিক, শিক্ষাবিদ মফিজ আলীর ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী ১০ অক্টোবর সোমবার। তিনি লেখক ও বহুমাত্রিক.কম-এর নিজস্ব প্রতিবেদক নূরুল মোহাইমীন মিল্টনের পিতা।
প্রাতস্মরণীয় এই ব্যক্তিত্বের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটি বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সোমবার সকাল ১০টায় ধূপাটিলাস্থ প্রয়াতের সমাধিস্থলে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে আলোচনা সভা এবং পারিবারিক উদ্যোগে দোয়া মাহফিলের অয়োজন করা হয়েছে।
মফিজ আলী বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) এর কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। ৬০ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে মফিজ আলী ছাত্র আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যূত্থন, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, চা শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন।
মফিজ আলী ছাত্র জীবনে রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি তুখোড় সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা, প্রগতিশীল রাজনীতি, চা শ্রমিক আন্দোলন, ভাষা সংগ্রামী, বালিশিরা কৃষক আন্দোলনসহ বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনেরও একজন বলিষ্ট নেতা হিসাবে সমধিক পরিচিত ছিলেন। এসব কারনেই হয়তো অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাখান করে গ্রামীণ পরিবেশে ভাঙ্গা কুড়ে ঘরে দু:খ-কষ্টের সাথেই কাটিয়েছেন সারাটি জীবন।
তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ৬টি বছরেও তিনি রাজবন্দী হিসাবে কারাভোগ করেছেন। জীবনের শেষ সময়েও লেখালেখির পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণির অধিকার আদায়ে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনকালীন ২০০৮ সনের ৩০ আগষ্ট দুর্ঘটনা কবলিত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ অক্টোবর ভোর রাতে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
তাঁর রাজনৈতিক ও বিভিন্ন আন্দোলনের সহযোদ্ধারা তার সম্পকে জানিয়েছেন, প্রচলিত এই সমাজে কিছু সংখ্যক মানুষ নিঃস্বার্তভাবে আলো ছড়িয়ে দিয়ে নিজেরা থেকেছেন অন্ধকারে-এমনই একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন মফিজ আলী। নিজের জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়েও কোন ধরণের সুযোগ-সুবিধার কাছে হার মানতে রাজি হননি। আদর্শকে ধারণ করেই অবহেলিত, শোষিত, নিষ্পেষিত এসব খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কথা বলেছেন।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থানার শ্রীসূর্য ধূপাটিলা গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯২৭ সালের ১০ ডিসেম্বর জন্মগ্রহন করেন। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ছাত্রজীবনে বি.এ. ৪র্থ বর্ষ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। মদন মোহন কলেজ থেকে আই.এ. পাশ করার পর এম.সি. কলেজে ভর্তি হলে ছাত্র ইউনিয়নের কার্যকলাপের জন্য এম.সি. কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেন। তাঁর পক্ষে ডিগ্রি পরীক্ষা দেয়া আর সম্ভব হয়নি।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন একজন তুখোড় সাংবাদিক ও কলামিষ্ট। তিনি পাকিস্তান আমলে ডন, ইত্তেফাক, সংবাদ, জনতা, আজাদ, গণশক্তিসহ বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত সংবাদ ও কলাম লিখেছেন। পঞ্চাশের দশকে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে লেখা প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে “রাষ্ট্রভাষা ও আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন”, “মে দিবসের ইতিহাস” এবং ঈদ সংখ্যায় ছোট গল্প “একটি গামছা।” ষাটের দশকে তিনি দৈনিক সংবাদ এর নিজস্ব প্রতিবেদক ছিলেন। ছাত্রজীবনে তার প্রকাশিত পুস্তিকার নাম “পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের নমুনা।”
চা শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশা দেখে ১৯৬৪ সালে চা শ্রমিক নেতা কর্মীদের নিয়ে “পূর্ব পাকিস্তান চা শ্রমিক সংঘ” নামে একটি শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করান। নিজের লোভ লালসার উর্ধ্বে থেকে দেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়েছে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী সেই দিনগুলোতে মফিজ আলী সিলেট এমসি কলেজের ছাত্র অবস্থায় কলেজে আন্দোলনের ফাঁকে এলাকায় ছুটে গেছেন। তখনকার সময়েও ভাষা আন্দোলনের জন্য সাহসী নেতৃত্ব প্রদান করেন।
মওলানা ভাসানীর গঠিত কৃষক সমিতির বৃহত্তর সিলেট জেলা কমিটির প্রথমে সহ-সম্পাদক এবং পরবর্তীকালে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে শ্রীমঙ্গলে বালিশিরা কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইন ও বিভিন্ন মামলায় বিভিন্ন সময়ে তিনি দীর্ঘ ৬ বছর রাজবন্দী হিসাবে কারাবরন করেন। তিনি জীবনে আদর্শ, কিছু বই-পুস্তক ছাড়া আর কিছু রেখে যাননি।
এ ধরনের সম্পূর্ন নির্মোহ, নিঃস্বার্থ একজন মানুষ জীবনে কখনও নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য অর্থবিত্তের দিকে ফিরেও তাকাননি। তিনি নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য তা ধ্রুব নক্ষত্রের মতো পথ দেখাবে পথের মানুষদের।
বহুমাত্রিক.কম