Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১০ ১৪৩১, বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪

স্বাধীনতার অনেক আগেই যিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন

সোহরাব হাসান

প্রকাশিত: ০২:৪৩, ২৬ মার্চ ২০১৪

আপডেট: ২২:০৫, ১৪ আগস্ট ২০১৬

প্রিন্ট:

স্বাধীনতার অনেক আগেই যিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন

ঢাকা : ষাটের দশকের গোড়ার দিকে শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা যান। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সাহায্য ও সমর্থন আদায় করা। সেবার দুদফায় তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। সম্ভবত শেখ মুজিব (তখনো বঙ্গবন্ধু হননি) প্রথমবার যান ১৯৬২ সালে। বিএসএফ তাকে চিনতে না পারায় গ্রেপ্তার করেনি। প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা শেষে ফিরে আসেন।

দ্বিতীয় দফায় তিনি আগরতলা যান ১৯৬৩ সালের জানুয়ারির দিকে। তার আগে অবশ্য তার প্রতিনিধির সঙ্গে ত্রিপুরার তৎকালীন টেরিটরিয়াল কাউন্সিল প্রধান সচিন্দ্র লাল সিংহের কথাবার্তা হয়। সচিন্দ্র লাল সিংহ দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর সঙ্গেও কথা বলেছেন। তবে সেই আলোচনার ফলাফল ইতিবাচক ছিল না। সবেমাত্র চীন-ভারত যুদ্ধ শেষ হয়েছে। চীনের কাছে ভারত শুধু পরাজিত হয়নি, উত্তর সীমান্তে বিরাট ভূখণ্ডও হাতছাড়া হয়েছে।

অন্যদিকে পাকিস্তান ছিল চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। এ অবস্থায় জওয়াহেরলাল নেহরু কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। শেখ মুজিব ভারতের এ মনোভাব জানার আগেই আগরতলা রওনা হয়ে যান। সীমান্তে বিএসএফ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে পরিচয় জেনে বিএসএফ সদস্যরা যোগাযোগ করেন ত্রিপুরা পুলিশ সুপার ভিক্ষু ঠাকুরের সঙ্গে। ভিক্ষু জানতে পেরে নিজেই সীমান্তে গিয়ে শেখ মুজিবকে শহরে নিয়ে আসেন। বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করুন। কিন্তু কেউই তাকে (শেখ মুজিবকে) সাহায্য করতে রাজি হলো না। দিল্লিও নীরব। ভিক্ষু ঠাকুর টিটিসি প্রধান সচিন্দ্র লাল সিংহের সঙ্গেও কথা বললেন। অতঃপর সিদ্ধান্ত হলো বন্দিকে তার দেশে পাঠানো হবে; কিন্তু তখনই তা সম্ভব নয়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। টিটিসি প্রধান বললেন, রাতটা তাকে নিরাপদ কোনো স্থানেই রাখতে হবে।

নিরাপদ স্থান কোনটি? ভিক্ষু ঠাকুর জানতে চাইলেন।
সচিন্দ্র লাল সিংহ জবাব দিলেন, জেলখানা।
এরপর পুলিশ সুপার খবর দিলেন জেল সুপারকে। বললেন, একজন ভিভিআইপি বন্দি আছে, আপনি বাসায়ই থাকুন।

এর কিছুক্ষণ পর সেই ভিভিআইপি বন্দিকে নিয়ে ভিক্ষু ঠাকুর গেলেন জেল সুপার ননী ভৌমিক করের বাংলোয়। বন্দি ও তার হেফাজতকারীকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন গৃহকর্তা।
তাকিয়ে দেখলেন সৌম্য চেহারার এক ভদ্রলোক তার সঙ্গে। গড়পরতা বাঙালিদের চাইতে লম্বা। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। মাথায় ব্যাক ব্রাশ করা চুল। ড্রয়িং রুমে তিনটি চেয়ার। তিনজন বসলেন। জেল সুপার ভিভিআইপি বন্দির কুশল জানতে চাইলেন। বন্দি দু-এক শব্দে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সারাক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। ভেতরে অস্থিরতা। কিন্তু জেল সুপারকে তা বুঝতে দিলেন না।

রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রিয় লাইন মনে পড়লো: ‌‌``বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা/বিপদে যেন করিতে পারি জয়``।

ভিক্ষু ঠাকুর উঠে গেলেন। যাওয়ার সময় বললেন, কাল খুব ভোরে আসবো। আপনি তৈরি থাকবেন। ননী ভৌমিক কর পুলিশ বিভাগের লোক। পূর্বাপর ঘটনা আঁচ করার চেষ্টা করলেন। তারপর পরিবেশ সহজ করার জন্য বন্দিকে জিজ্ঞেস করলেন, কী খাবেন?
বন্দি জবাব দিলেন, কিছু খাবো না।

এবার জেল সুপার পীড়াপীড়ি করলেন। বন্দি বললেন, কফি খেতে পারি। তখন আগরতলায় কফির প্রচলন এতো ছিল না। জেল সুপারের বাসায় কোনো ফ্লাক্স নেই। পুলিশ সুপারের বাসা তেকে ফ্লাক্সে করে কফি নিয়ে আসা হলো। জেল সুপার নিজ হাতে বন্দিকে কফি দিলেন। বন্দি কয়েক কাপ কফি খেলেন। সেই সঙ্গে দুজনের গল্প চলতে থাকে। নানা গল্প। দেশের গল্প, দেশভাগের গল্প। জেল সুপারের পূর্ব পুরুষ ছিলেন পূর্ব বাংলায়। ’৪৭-এর পর তারা ভারতে চলে যান। কিন্তু মন পড়ে আছে তিতাসের পাড়ে। তার সামনে যিনি বসে আছেন, যেনো তিনি বন্দি নন, পরম আত্মীয়। এভাবে গল্প করতে করতে রাত গভীর হয়। একটা, দুটো, তিনটা। চারটা বাজতেই পুলিশ সুপার এসে হাজির হলেন। বললেন: স্যার, এখন যেতে হবে। বন্দি চেয়ার থেকে উঠে জেল সুপারকে জড়িয়ে ধরলেন। বিদায় সম্ভাষণ জানালেন।
পুলিশ সুপার তাগাদা দিলেন, আপনাকে যেতে হবে।

জেল সুপার সসম্মানে বন্দিকে গাড়িতে তুলে দিলেন। এরপর পুলিশ সুপার নিজে গাড়ি চালিয়ে সীমান্তের দিকে রওনা হলেন।

জেল সুপার ননী ভৌমিক কর এখন বেঁচে নেই। ১৯৯৮ সালের ২৫ অক্টোবর মারা যান। আগরতলার দৈনিক সংবাদ রিপোর্ট করেছিল: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শেষ সাক্ষীর প্রয়াণ। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মৃত্যুতে শোকবার্তাও পাঠিয়েছিলেন। ননী ভৌমিক করের পুত্র গৌতম কর ভৌমিক বর্তমানে সংবাদ-এ সাংবাদিকতা করেন। আলাপ প্রসঙ্গে বললেন, তার বাবা অসংখ্যবার তাদের কাছে এ গল্প করেছেন। শেখ মুজিব যে চেয়ারটিতে বসেছিলেন, সেটিও সযত্নে রেখে দিয়েছেন। ভিনদেশী বাঙালি শেখ মুজিবের স্মৃতি হৃদয়ে ধারণ করলেও বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ তাঁকে ভুলে গেছে। শাসকচক্র ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে।

শেখ মুজিবের এই আগরতলা মিশন সম্পর্কে পরবর্তীকালে রাজনীতিক ও গবেষকরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, এটা ছিল শেখ মুজিবের অ্যাডভেঞ্চারিজম। কেউ বলেছেন, পাকিস্তান শাসকবর্গের হাত থেকে মুক্তি পেতে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের কথা ভেবেছিলেন ষাটের দশকের শুরুতেই। সেই সংগ্রাম সফল করতেই ভারতের সহায়তা লাভের চেষ্টা। আবার কারো কারো মতে, দিল্লি হয়ে তিনি লন্ডন গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন।

পরবর্তীকালে পাকিস্তান সরকার যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে, সেই মামলায় শেখ মুজিবের আগরতলা সফরের উল্লেখ নেই। তবে তার সহযোগীরা আগরতলা গিয়েছেন, ঢাকায় কর্মরত ভারতীয় কূটনীতিকের সঙ্গে শেখ মুজিবের সহযোগীদের বৈঠকের অভিযোগ আনা হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের প্রধান দুই সহযোগী হিসেবে রুহুল কুদ্দুস ও আহমদ ফজলুর রহমানের নামও বলা হয়েছে। তবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হননি, এমন একজন ছিলেন তার আগরতলা মিশনের প্রধান পরিকল্পক ও সহযোগী। সিলেটের চা বাগানের মালিক মোয়াজ্জেম হোসেন নন)। এই মোয়াজ্জেম হোসেন ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার আগে থেকেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করার চিন্তা করছিলেন।

শেখ মুজিবের আগরতলা যাত্রা সম্পর্কে তার ফুফাতো ভাই মমিনুল হক খোকা অন্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল: বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার ও আমি গ্রন্থে লিখেছেন: ‘মিয়া ভাইয়ের (শেখ মুজিব) গতিবিধির ওপর সরকারের কড়া নজর। ...বিরোধী মহল চিন্তিত, শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করলে আন্দোলন ঝিমিয়ে যাবে। বিরোধী দলের চরমপন্থী গ্রুপের কয়েকজনের সঙ্গে মিয়া ভাইয়ের ছিল বিশেষ হৃদ্যতা। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করলেন তিনি দেশত্যাগ করবেন।

প্রথমে ভারতে, তারপর সেখান থেকে লন্ডনে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করবেন। ... স্থির হলো কুর্মিটোলা পর্যন্ত মিয়া ভাইকে গাড়ি করে নিতে হবে। ...আরো স্থির হলো ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন থেকে আরোহরণ করবেন দুজন ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী। একজন মিয়া ভাইয়ের বিশেষ অনুসারী চট্টগ্রামের তারেক চৌধুরী, আরেকজন আমার বন্ধু রেজা আলী। ...স্থির হলো কুর্মিটোলা রেল স্টেশনে আমি মিয়া ভাইকে নিয়ে বাড়িতে তৈরি থাকবো।

ট্রেন স্টেশনে পৌঁছালেই রেজা আলী টর্চ জ্বালাবে। মিয়া ভাই আমার বাড়ি থেকে নেমে ট্রেনের কামরায় উঠবেন; আর রেজা আলী নেমে এসে আমার গাড়িতে বসবে। সমস্ত অপারেশনটাই চালাতে হবে দ্রুত, কারণ কুমিল্লাগামী ট্রেনের ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে মাত্র কযেক সেকেন্ডের বিরতি। ...গাড়ি চলতে শুরু করলো। হারুন চালক, আমি তার পাশে। মিয়া ভাই পেছনের সিটে শুয়ে পড়লেন। নির্বিঘ্নে পার হলাম ক্যান্টনমেন্ট গেট। রেল স্টেশনে পৌঁছালাম। ... স্টেশনে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, ট্রেন পৌঁছালো, সেই সঙ্গে জ্বলে উঠলো একটা কামরা থেকে টর্চ লাইট। অন্ধকারে মিয়া ভাই সমস্ত গা কালো চাদরে মুড়ে কামরায় উঠে পড়লেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নেমে এলো রেজা আলী। ট্রেন চলতে শুরু করলো।

এরপর মমিনুল হক, আগরতলায় ব্যর্থ মিশন শেষে শেখ মুজিবের দেশে ফেরার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে: ‘সেহরির সময় ভাবী (বেগম মুজিব) ও আমি কথা বলছি। হঠাৎ শুনি দরজায় নক। আমি উঠে দরজা খুলেছি, দেখি মিয়া ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। লুঙ্গি পরিহিত, সারা গা ও মাথা চাদর দিয়ে ঢাকা। চুল উস্কখুস্ক, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ভাবীকে বললেন, আমাকে কিছু খেতে দাও আগে। আমি খুব ক্লান্ত, সারা রাস্তা পায়ে হেঁটে এসেছি।’

সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার রিপোর্ট করে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তিনি তখন দৈনিক আজাদের চিফ রিপোর্টার। আদালতে সাক্ষীদের সওয়াল-জবাব পুরোপুরি ছাপা হতো পত্রিকায়। ফয়েজ আহদ সওয়াল-জবাব ছাড়াও সাইড রিপোর্ট লিখতেন। সেই রিপোর্ট নিয়েই লেখেন ‘আগরতলা মামলা, শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ।’ এই বইয়ে ত্রিপুরার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বা টিটিসি প্রধান সচিন্দ্র লাল সিংয়ের একটি চিঠি ছাপা হয়েছে। দিল্লি থেকে চিঠিটি সংগ্রহ করেন লেখক ও সংস্কৃতিসেবী মফিদুল হক।

এই চিঠিতে বলা হয়: ১৯৬৩ সালে আমার ভাই শ্রী উমেষ লাল সিং সমভিব্যাহারে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ১০ জন ত্রিপুরার পালম জেলার খোয়াই মহকুমা দিয়া আগরতলায় আমার বাংলোয় রাত্র ১২ ঘটিকার সময় আগমন করেন। প্রাথমিক আলাপ-আলোচনার পর আমার বাংলোবাড়ি হইতে মাইল দেড়েক দূরে হেমাঙ্গিনী দেবীর বাড়িতে শেখ সাহেব আসেন। সেখানেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তারপর মুজিব ভাইয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর সঙ্গে দেখা করি। তিনি মুজিবুর রহমানকে ত্রিপুরায় থাকিয়া প্রচার করিতে দেওয়ার অনুমতি দিতে সম্মত হননি।

শেখ মুজিবের আগরতলা মিশন সম্পর্কে লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক আবদুল মতিন জানাচ্ছেন, ১৯৬২-৬৩ সালে তিনি আগরতলা গেলেও পরিকল্পনা ছিল অনেক আগের। ১৯৬০ সালে শেখ মুজিব সবেমাত্র জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছেন। থাকতেন সেগুনবাগিচার একটি বাসায়। এখন যেটি ইউসেফ স্কুল। মতিন সাহেব লিখেছেন: শেখ মুজিব তখন জেলের বাইরে থাকলেও তার ওপর আইবির কড়া নজর ছিল। সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দোতলা থেকে শেখ মুজিব ডাক দিলেন। আবদুল মতিন না শোনার ভান করলে কিছু চড়া স্বরে ডাকলেন। উপরের দিকে তাকাতেই সেই পরিচিত কণ্ঠে ভেসে এলো: এতো ভয় কিসের? এদিকে এসো। তিনি উপরে গেলে শেখ মুজিব কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর সামরিক শাসন সম্পর্কে জনগণের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন।

এক পর্যায়ে শেখ সাহেব  বললেন, তিনি আইয়ুবকে পরোয়া করেন না। জনগণের মনের কথা তিনি জানেন। এরপর কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে তিনি আইয়ুববিরোধী সংগ্রামের আগরতলাকে ব্যবহারের কথা বললেন। তার হাতের ও মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হলো, তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের কথা ভাবছেন।
এরপর মতিন আরো জানাচ্ছেন: তার এই গোপন পরিকল্পনার আভাস পেয়ে আমি অস্বস্তি বোধ করলাম।

তিনি ‘গেরিলা যুদ্ধ’ শব্দ দুটি ব্যবহার না করলেও গেরিলা যুদ্ধের কথা বলতে চেয়েছেন বলে মনে হলো। (বঙ্গবন্ধুর আগরতলা সফর, দ্বিজাতিত্ত্বের বিষ বৃক্ষ, আবদুল মতিন) আবদুল মতিন লিখেছেন, ‘শেখ সাবে তার গোপন পরিকল্পনাটি জানানোর উদ্দেশ্য হলো বামপন্থীদের কাছে খবরটি পৌঁছানো। আমি যেনো তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আভাসে-ইঙ্গিতে কথা  বলি এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা জেনে নিই। এর কিছুদিন পর শেখ মুজিব লন্ডন যান। সেখানেও তিনি বাঙালি কমিউনিটির নেতা তাসাদ্দুক আহমেদের সঙ্গে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করেন।’

স্বাধীনতার পর মতিন সাহেব বঙ্গবন্ধুর আরো কাছে চলে আসেন। লন্ডন ও জেনেভায় চিকিৎসাকালে তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক সহচর। জেনেভায় মতিন সাহেব বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মিশন সম্পর্কে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, তথাকথিত আগরতলা মিশন সম্পর্কে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। তবে আইয়ুববিরোধী সংগ্রামের পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি আগরতলা গিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে আর বিস্তারিত কথা হয়নি।

‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ শীর্ষক মামলার সরকারি ভাষ্যে বলা হয়, ১৯৬৭ সালের ১২ জুলাই তারিখে ভারতের আগরতলায় অনুষ্ঠিত এক গোপন বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বিদ্রোহের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহতি হয়। এই বৈঠকে শেখ মুজিব উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করা হয়নি। সরকারি মহল উল্লিখিত মামলাকে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে অভিহিত করে।

১৯৬২ সালে শেখ মুজিবের আগরতলা মিশন ব্যর্থ হলেও ১৯৭১ সালে তার ভারত মিশন ব্যর্থ হয়নি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে শেখ মুজিব লন্ডন যান। সে সময় ভারত সরকারের একজন প্রতিনিধি লন্ডন অবস্থান করছিলেন। শেখ মুজিবের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, নির্বাচনে তিনি জিতবেন। কিন্তু পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কি না সে ব্যাপারে সংশয় ছিল। ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে কী হবে? এই আশঙ্কা থেকেই শেখ মুজিব ভারতের সহায়তা চাইলেন। বললেন, পাকিস্তানিরা ক্ষমতা না ছাড়লে ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষকে’ নিয়ে তিনি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করবেন। এই সংগ্রামে ভারতসহ সারা পৃথিবীর সাহায্য চাইবেন। মঈদুল হাসানের মূলধারা ’৭১-এ এ বৈঠক সম্পর্কে কিছুটা আভাস রয়েছে।

কিন্তু যে শেখ মুজিব ১৯৬২ সালে গোপন পথে স্বাধীনতা সংগ্রামের সহায়তার জন্য আগরতলা গিয়েছিলেন, সেই শেখ মুজিব কিন্তু ’৭১-এর ২৫ মার্চ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভারতে যেতে রাজি হননি। সে কি ভারতের প্রতি তার সংশয় না অন্য কোনো বিকল্পের সম্ভাবনা? ’৬২ সালে তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিক মাত্র, ’৭১-এ হয়ে ওঠে জনগণমন নন্দিত নেতা। সহকর্মী নেতারা কোথায় থাকবেন, কীভাবে সীমান্ত পার হবেন, ভারতে গিয়ে কাদের সঙ্গে কথা বলবেন, সবকিছু  ঠিক করে রাখলেও নিজে ঘর ছেড়ে কোথাও গেলেন না। নিজের জীবনকেই বাজি রাখলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার শর্তে। এই ছিলেন শেখ মুজিব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতা।

স্বাধীনতার পর ত্রিপুরাবাসী মনেপ্রাণে চাইছিলেন, শেখ মুজিব একবার আগরতলা যাবেন, যেমন তিনি গিয়েছিলেন কলকাতায়। কলকাতার মানুষ যেভাবে জয়বাংলাকে গ্রহণ করেছিলেন শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আরতলাবাসাীও তাকে হৃদয়ে ঠাঁই দিয়েছিলেন। হৃদয়ের অর্ঘ্য, ভালোবাসায়। তাদের দ্বিতীয় দাবি ছিল, আগরতলায় বাংলাদেশের একটি ভিসা অফিস স্থাপনের।

নবীন রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে নানা প্রতিকূলতার কারণে বঙ্গবন্ধু আগরতলাবাসীর প্রথম দাবি পূরণ করতে না পারলেও দ্বিতীয় দাবিটি সানন্দে বাস্তবায়ন করেছিলেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই আগরতলায় বাঙালিদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা কত গভীর ছিল, তা জানা যায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এক ভারতীয় সেনা অফিসারকে পাঠানো শুভেচ্ছা বার্তায়। ত্রিপুরার বাসিন্দা ক্যাপ্টেন শিশির কুমার চক্রবর্তী ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৬৮ সালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ধর্মনগর সীমান্তে যুদ্ধ করেন। ’৭২-এর ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে পাঠানো শুভেচ্ছাপত্রে লিখেছিলেন:
‌‌``Capt.S.K. Chakrabarty
`In the long war between
False hood and the truth
False hood wins the first
Battle and  truth the last.``
-Sheikh Mujib

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer