Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৩ ১৪৩০, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪

স্ত্রী উদ্ধারে সার্চ ওয়ারেন্ট বনাম নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

প্রকাশিত: ০১:২২, ৬ আগস্ট ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

স্ত্রী উদ্ধারে সার্চ ওয়ারেন্ট বনাম নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট

ঢাকা : বেআইনীভাবে আটক ব্যক্তিদের উদ্ধারের জন্য তল্লাসি ওয়ারেন্টের বিষয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ১০০ ধারায় আলোচনা করা হয়েছে। এ ধারাটি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ম্যাজিস্ট্রেটের যদিএরুপ বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে, কোন ব্যক্তিকে অবৈধভাবে আটক রাখা হয়েছে-যা রীতিরকম অপরাধের সামিল, তাহলে তিনি একটি তল্লাসি ওয়ারেন্ট জারি করতে পারবেন।

তবে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। বয়সের দিক থেকে আত্মনির্ভরশীল ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য এই ধারা ব্যবহার করা যাবে না। স্ত্রী যদি তার পিতা-মাতার সাথে বা অন্য কোন কারণে কারো সাথে থাকা অবস্থায় তাকে উদ্ধারের জন্য স্বামীর আবেদনক্রমে তল্লাসী ওয়ারেন্ট ইস্যু করা সম্পূর্ণ বে-আইনী। অথচ নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট এর আদালতের মাধ্যমে অতিরিক্ত জেলা ম্যজিস্ট্রেটগণ এ ধারাটির যথেচ্ছা ব্যবহার করছেন।

কারও স্ত্রী যদি আইনগত কোন কারণ ছাড়াই তার স্বামীর সাথে একত্রে বসবাস না করে, সে ক্ষেত্রে স্বামী দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারে। ১৭ ডিএল আর ৫৪৪ পৃষ্টায় এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। নিয়মিত আদালত অর্থাৎ এ বিষয়ে পারিবারিক আদালতে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের মোকদ্দমা আনয়ন করতে হবে। সিআরপিসির ১০০ ধারার মাধ্যমে এ বিধানকে অবলম্বন করা যায় না এবং পারিবারিক আদালতের একচ্ছত্র এখতিয়ার বিষয়ে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট বিচার করতে পারেন না।

পাকিস্তান ক্রিমিনাল ল’জার্নাল, ১৯৭৭, পৃষ্টা ১১১ তে এ বিষয়ে একটি পরিস্কার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, স্বামী পরিচয়ে কোন ব্যক্তি কোন মহিলাকে উদ্ধারের জন্য আবেদন করলে উপযুক্ত প্রমাণাদি ছাড়া উক্ত আবেদন বিবেচনা করা যাবে না।

তবে অতিরিক্ত জেলা ম্যজিস্ট্রেটগণের এ ধরণের অবৈধ আদেশের বিরুদ্ধে অত্র আইনের ধারা ৪৩৫ ও ৪৩৯ (ক) এর বিধান মতে বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন করা যায়।

দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের মামলায় বাদীকে অবশ্যই প্রমান করতে হবে যে, সে নির্দোষ ও নিরীহ মনোভাব নিয়েই আদালতের কাছে বিচার প্রার্থী হয়েছে। স্ত্রী যদি প্রমাণ করতে পারে যে, স্বামী তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, তবে স্বামী ডিক্রি পাবে না। নিষ্ঠুরতার আকার প্রকৃতি এমন হতে হবে যে, ওই অবস্থায় স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর ঘরে যাওয়া নিরাপদ নয়, তখন সেটা হবে একটি উত্তম বৈধ প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি ।

আশু দেনমোহর যতক্ষণ পর্যন্তপরিশোধ করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রী তার স্বামীর সাথে বসবাস করতে ও তাকে দাম্পত্য মিলনের সুযোগ দিতে অস্বীকার করতে পারে। দাম্পত্য মিলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিতে স্বামী তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে সেই ক্ষেত্রে দেনমোহর অপরিশোধিত রয়েছে বললে আনীত মামলায় এটি একটি উত্তম প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি হবে এবং আনীত মামলাটি নাকচ করা হবে। কিন্তুু স্ত্রীর অবাধ সম্মতিক্রমে দাম্পত্য মিলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর মামলাটি দায়ের করা হলে ‘আশু দেনমোহর’ প্রদানমূলক শর্তমূলক দাম্পত্য অধিকারের পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত ডিক্রি দেওয়া যাবে। তবে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বৈধ বিবাহের অস্বিত্ব থাকতে হবে।

বিবাহের পূর্বে সম্পাদিত কোন চুক্তিতে যদি বলা হয় যে, বিবাহের পর স্ত্রী তার পিতা-মাতার সাথে বসবাস করতে পারবে, তাহলে এটি অবৈধ হবে এবং এই জাতীয় কোন চুক্তি দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য আনীত মামলায় কোন জবাব হিসেবে গ্রহনযোগ্য হবে না। অনুরূপভাবে যেখানে বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিতে যদি উল্লেখ করা হয় যে, এখন তারা একত্রে বসবাস করবে এবং যদি স্বামীর প্রস্তাবে একমত হতে না পারে তাহলে সেখানে চুক্তিটি স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করতে পারবে, সেখানে চুক্তিটি অবৈধ হবে এবং স্বামী কর্তৃক আনীত দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের মামলায় এটা উত্তম যুক্তি বলে গন্য হবে না। তবে দ্বিতীয় স্ত্রীকে বাড়িতে বসবাস করার অনুমতি দান করে তাকে ভরণপোষণ প্রদানে সম্মত হয়ে তার সাথে সম্পাদিত চুক্তি আইন দ্বারা কার্যকর হবে।
ী-স্ত্রীর ফিরে পা
স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে তালাক প্রক্রিয়া সম্পন্নকালে তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার করা না হলে এ মামলা চলে না। এ মামলায় আদালত বিবেচনা করেন যে পরষ্পরের প্রতি আরোপিত দায়িত্ব পালন করা হয়েছে কি-না। অনেক সময় দেখা যায়, স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে ঘরে ফেরা সম্ভব নয়। এরকম হলে তালাক নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৯৩৯ সালের বিবাহ বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা প্রমাণ করতে পারলে স্বামী এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। আবার স্বামী যদি স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যাভিচারের অভিযোগ আনেন, এ যুক্তি সত্য হলে দাম্পত্য অধিকার উদ্ধারে আদালত ডিক্রি জারি করতে পারেন। তবে স্বামী যদি সমাজচ্যুত কোনো কুখ্যাত সন্ত্রাসী বা মাস্তান হন, সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর বিরুদ্ধে দাম্পত্য অধিকারের মোকদ্দমা অচল হবে এবং স্ত্রী স্বামীর ঘরে ফিরতে বাধ্য নন।

তবে স্ত্রী নিম্নোক্ত কারণে স্বামীর দাম্পত্য অধিকার পূণরুদ্ধার দাবী অস্বীকার করতঃ বিপরীত দাবী করতে পারে। যথাক্রমে-
ক. স্বামীর নিষ্ঠুরতা
খ. স্বামী হতে পৃথক থাকার ক্ষমতা দান
গ. আশু মোহরানা পরিশোধ না করা
ঘ. স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামী কর্তৃক মিথ্যা অভিযোগ আনয়ন
ঙ. স্বামীকে সমাজচ্যূতকরণ;
চ. বিবাহের মিথ্যা দাবী সংক্রান্তমামলা
ছ. ওয়াদা ভঙ্গের দাবী ও
জ. স্ত্রী অপহরণ

দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবির ক্ষেত্রে আইনবিদদের মধ্যে রয়েছে দ্বিমত। বিভিন্ন মামলার নজিরেও ভিন্নমত পাওয়া গেছে। এতে অভিযোগ উঠেছে, কেউ যদি স্বাধীনচেতা হন, পূর্ণাঙ্গভাবে আলাদা থাকতে চান এতে সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একতরফা দাবির কোনো সংঘাত হবে কি-না।

১৮ বিএলডি (১৯৯৮)-এ খোদেজা বেগম বনাম মোঃ সাদেক মামলার রায়ে বলা হয়, ‘দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য একটি পারষ্পরিক অধিকার। সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদের সঙ্গে এটি বৈষম্যমূলক কিংবা অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’

হোসেন জাহান বনাম মো: সাজাহান মামলায় (১৮ বিএলডি, ১৯৯৮) বলা হয়, ‘বিনা কারণে যদি কোনো স্ত্রী দাম্পত্য মিলনে অস্বীকার করেন তাহলে স্বামী মামলা করতে পারেন।’

আরেকটি মামলার (১৬ বিএলডি, ১৯৯৬ পৃষ্টা ৩৯৬-৩৯৮) লিপিবদ্ধ বর্ণনায় নিম্ন আদালত থেকে স্বামীর পক্ষে ডিক্রি এবং আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে স্ত্রী রিভিশন মামলা করলে হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চ (বিচারপতি গোলাম রব্বানী ও বজলুর রহমান তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত) এ ডিক্রি বাতিল করেন এবং দাম্পত্য অধিকার মোকদ্দমা ডিস্মিস করেন। ওই রায়ে সৈয়দ আমির আলীর মোহামেডান “ল” গ্রন্থ থেকে বিয়ের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করা হয় এবং বলা হয়-

‘কোনো দেওয়ানি বা ধর্মীয় আইনের চোখে ইসলামী আইন অধিক কঠোর, যা একজন মহিলাকে তাঁর বিবাহিত জীবনের অত্যাচার থেকে রক্ষা করে। ইসলামি আইনে এ অত্যাচার স্বামী কর্তৃক কেবল দৈহিক বা মানসিক অত্যাচার বোঝায় না, স্বামীর সঙ্গে বসবাসে স্ত্রীর অনিচ্ছুকতাও বোঝায়।’

দাম্পত্য পুনরুদ্ধার মোকদ্দমার ক্ষেত্রে স্বামীরা এ প্রতিকার বেশি চাইলেও ৯০ শতাংশ ডিক্রিই স্ত্রীর পক্ষে যায়। আর এ ধরনের প্রতিকার স্বামী বা স্ত্রীকে দাম্পত্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডিক্রি কোনো পক্ষ পেলেও সাধারণত ডিক্রি কার্যকর হয় না। এ ডিক্রি প্রাপ্তির ফলে কেবল স্বামী বা স্ত্রীর উপর দাম্পত্য অধিকারটি স্থাপিত করা যায়, যাতে অপর পক্ষ দ্বিতীয় বিয়ে কিংবা বিনা কারণে তালাক না চান। তবে তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপরে জোর করা যায় না। এতে সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকার লংঘিত হয়। তবে কেউ যদি তালাক চান, তাহলে আলাদাভাবে তা কার্যকর করতে হবে। আর স্বামী-স্ত্রীর ঘর-সংসার করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যদি শ্বশুরবাড়ির লোকজন এতে বাঁধা দেয়, তাহলে ফৌজদারী আদালতের আশ্রয় নেওয়া যায়।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’

Email:[email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer