ছবি : বেঙ্গল ফাউন্ডেশন
আর্মি স্টেডিয়াম থেকে : পাঁচ দিনব্যাপী বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের পঞ্চম ও শেষ দিনের পরিবেশনা চলছে। গুণী শিল্পীদের সুরঝংকারে মুগ্ধ-আপ্লুত স্টেডিয়ামভর্তি হাজারো দর্শক।
দিনের তৃতীয় পরিবেশনা ছিল পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার। তিনি সন্তুরে রাগ যোগ বাজিয়ে শোনান। পরিবেশনা শেষে শিল্পীর হাতে উৎসবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
পরবর্তী পরিবেশনায় খেয়াল শুনিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন কুমার মারদুর। তিনি রাগ পুরিয়া কল্যাণ ও কিরওয়ানিতে ভজন পরিবেশন করেন। পরিবেশনা শেষে শিল্পীর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বিশিষ্ট লেখক আনিসুল হক। পঞ্চম দিনের আয়োজনে আরও পরিবেশন করবেন পণ্ডিত কুশল দাস (সেতার), আরতী আঙ্কালিকর (খেয়াল) এবং পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া (বাঁশি)।
এরআগে সোমবার সন্ধ্যাটায় বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে শেষ দিনের আয়োজনে অনুষ্ঠানের শুরুতেই দলীয় কণ্ঠসংগীত পরিবেশন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ। সমবেত কণ্ঠে রাগ ভূপালী পরিবেশন করেন তারা।
এ সময় তবলায় তাল দেন স্বরূপ হোসেন ও জাকির হোসেন। সংগীত পরিবেশনা শেষ হলে শিল্পীবৃন্দের হাতে উৎসবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জী। শিল্পীদের পক্ষে স্মারক গ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান ড. লিনা তাপসী।
এরপর বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ দলীয় সেতার পরিবেশন করেন। শিল্পীরা হলেন নিশিত দে, সম্য দে, আশিস নারায়ণ সরকার, প্রসেনজিৎ মণ্ডল, আহম্মেদ ইমতিয়াজ হুমায়ুন, টি.এম. সেলিম রেজা, খন্দকার নাজমুস সাকিব, রিংকু চন্দ্র দাস, মেহরিন আলম, জ্যোতি ব্যানার্জী, জাহাঙ্গীর আলম শ্রাবণ ও মোহাম্মদ কাওছার। সেতার, তবলা ও গিটারের সম্মিলিত সুরে তারা রাগ চারুকেশী পরিবেশন করেন। তবলায় ছিলেন প্রশান্ত ভৌমিক ও সুপান্থ মজুমদার। বাদ্য শেষে তাদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সহ-সভাপতি রুবি গজনবী।
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৬-এর আনুষ্ঠানিক সমাপনী ঘোষণা করা হয় এরপরই। অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সম্মানিত শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান।
মঞ্চে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মান্যবর মেয়র আনিসুল হক এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মান্যবর মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।
শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান উৎসবে আগত শিল্পীদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন,‘আমাদের দেশে উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চা যখন স্তিমিত হতে যাচ্ছিল তখন এই উৎসব সে চর্চাকে আবার উজ্জীবিত করেছে। যা আমাদের জাতীয় চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।’
ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ তাঁর বক্তব্যের শুরুতে সদ্যপ্রয়াত লেখক সৈয়দ শামসুল হককে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের রক্তে শুদ্ধ সংগীতের ধারা বইছে। এই ভূখণ্ড থেকে এক সময় ওস্তাদ আলী আকবর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, পণ্ডিত রবিশংকরের মতো শিল্পীর জন্ম হয়েছে। এই উৎসব চলমান থাকলে পুনরায় আমরা বিশ্বমানের শিল্পী পাবো।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। দেশের সংগীতশিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে তিনি সংগীত প্রযোজকদের অনুরোধ করেন শিল্পীদের ন্যায্য পাওনা দেওয়ার জন্য। তিনি বলেন,‘শিল্পীরা পারেন একটি দেশের মননে পরিবর্তন আনতে। তাই তাঁদের যথাযোগ্য সম্মান যেন আমরা দিতে পারি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে পুরান ঢাকার ১২টি সংগীত বিদ্যালয় পরিচালনার ভার নিতে তাকে অনুরোধ করেন এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য করারও আশ্বাস দেন। মৌলবাদি অপশক্তি প্রতিরোধে এই উৎসবকে একটি শক্তিশালী উদ্যোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন,‘আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। কোন অপশক্তি এই অগ্রযাত্রা রুখতে পারবে না।’
স্কয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী বক্তব্যের শুরুতেই সবাইকে ধন্যবাদ জানান। উৎসবের সঙ্গে থাকতে পেরে গর্ব প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে অন্যান্য আরও বড় উৎসব আমরা আপনাদের উপহার দেব।’
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের বক্তব্যের শুরুতে তিনি সদ্যপ্রয়াত লেখক সৈয়দ শামসুল হক, হোলি আর্টিজানে নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মৌলবাদি আক্রমণে নিহতদের স্মরণ করে আগত সবাইকে এক মিনিট নিরবতা পালন করতে অনুরোধ করেন। অতঃপর তিনি উৎসবের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ও মাছরাঙ্গা টেলিভিশনসহ উৎসব সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
তিনি এই উৎসবকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নের একটি মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেন। সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান আয়োজনে সহায়তা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও সংস্কৃতিমন্ত্রীসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন আবুল খায়ের।
তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন যেন দেশে কমপক্ষে তিন হাজার সিনেমা হল তৈরি করে দেওয়া হয়। এছাড়াও দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও সাংস্কৃতিক ক্লাব গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটা বড় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাই আমরা। যেখানে শুধু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হবে।’ বক্তব্যের শেষে তিনি আসছে জানুয়ারি মাসে তিন রাত ধরে সুফি গানের উৎসব করার ঘোষণা দেন। সমাপনী অনুষ্ঠান শেষে অতিথিদের হাতে উৎসবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন তিনি।
সংগীত উপভোগের পাশাপাশি শ্রোতাদের জন্য খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা রয়েছে উৎসব প্রাঙ্গণে। এছাড়া বিভিন্ন স্টলে পাওয়া যাবে আইস মিডিয়ার ম্যাগাজিন ও বেঙ্গল পাবলিকেশনসের বই। রয়েছে ডেইলি স্টার বুকস ও প্রথমা। এছাড়া অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে আরও রয়েছে অরণ্য, বেঙ্গল ক্রিয়েশনস, ম্যাংগো মোবাইল, বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপ ও সেট্লমেন্ট এর প্রদর্শনী। আছে ব্র্যাক ব্যাংকের এটিএম বুথ। সাংবাদিকদের জন্য থাকছে ওয়াইফাই জোন।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজতি বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৬-এর নিবেদক স্কয়ার গ্রুপ। আয়োজন সর্মথন করছে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড। অনুষ্ঠানে সম্প্রচার সহযোগী মাছরাঙা টেলিভিশিন। মিডিয়া পার্টনার আইস বিজনেস টাইমস।
আতিথেয়তা সহযোগী র্যাডিসন হোটেল। সার্বিক সহযোগিতায় বেঙ্গল গ্রুপ। অনুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে বেঙ্গল ডিজিটাল, ম্যাংগো, বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয় ও পারফেক্ট হারমনি প্রোডাকশনস্ সিঙ্গাপুরের সহযোগিতায়। ইভেন্ট ব্যবস্থাপনায় ব্লুজ কমিউনিকেশনস।
এ বছর উৎসবটি উৎর্সগ করা হয়েছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) স্মৃতির উদ্দেশ্যে।
বহুমাত্রিক.কম