Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৬ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

সুনীল গঙ্গোপ্যাধ্যায়ের কবিতায় প্রেম-বিরহ

মুস্তাক মুহাম্মদ

প্রকাশিত: ২৩:৫৭, ১ জুন ২০১৭

আপডেট: ০০:২২, ২ জুন ২০১৭

প্রিন্ট:

সুনীল গঙ্গোপ্যাধ্যায়ের কবিতায় প্রেম-বিরহ

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৩৪-২০১২) পাঠকপ্রিয় আধুনিক কবি। দেশ বিভাগের পূর্বে তিনি ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করলেও পরে ভারতে চলে যান। বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের চাওয়া-পাওয়া; প্রেম-ভালবাসার নিখুঁত চিত্র এঁকেছেন তাঁর কবিতায়। যা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশ থেকে চলে গেলেও বাংলার প্রতি ছিল তাঁর গভীর প্রেম। তাঁর বিভিন্ন কবিতায় বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ লক্ষণীয়।

প্রেম-ভালোবাসা-বিরহের কবিতায় তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি “নীরা” কোটি কোটি পাঠক কুলের স্বপ্নের নায়িকার মত। এই কালজয়ী চরিত্রটি শতকে-শতকে প্রেমিকার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন যেমন পাঠকের হৃদয়ে প্রেম জাগায়-প্রশান্তি এনে দেয়। যুগে যুগে বনলতা , শশীলতা, নীরারা আমাদের শান্তির আশ্রয়স্থল হয়ে উঠে। এই শক্তিটা বিধাতা তাদের বিশেষ করে দিয়েছেন। আলোচনার কেন্দ্রটা প্রেম কেন্দ্রিক হলেও বিরহ অর্থাৎ পরিণত পর্যায় মুখ্য ভূমিকায় থাকবে। সেই সাথে চাওয়া পাওয়ার, হিসেব না মেলা হিসেবও উপস্থিত হবে।

যুবক বয়স প্রেমের জন্য উত্তমকাল। যুবক প্রেমিক প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্য এমন সব কাজ করে পরে তা দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। যৌবনে ভালোবাসার জন্য প্রেমিক অসাধ্যকে সাধন করতেও প্রস্তুত থাকে। প্রেমিকাকে সুখি করার জন্য সে সব কিছু করতে রাজি। শুধু প্রেম-প্রেমিকাকে পাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা তার ভেতর কাজ করে। পৃথিবীতে হেন কাজ নেই যে প্রেমিকার মুখের একটু হাসির জন্য প্রেমিক করতে পারে।

পারস্যের কবি হাফিজ বলেছিলেন-প্রিয়ার মুখের ছোট একটি তিলের জন্য বহু কষ্টে অর্জিত বুখারা ও সমরখন্দের সিংহাসন ত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু যদি প্রেমিকা কৌশলে প্রেমিকের সাথে প্রতারণা করে! পার্থিব অর্থ-বিত্তের কাছে যদি প্রেমিকা নিজেকে সঁপে দেয় তখন সে আর প্রেমের দাবি থাকে না; সে আর দশ জন নারীর মত হয়ে যায়। যাদের থাকে অর্থ-বিত্ত-কামাবেগে প্রচণ্ড আকর্ষণ। প্রতারিত প্রেমিক বিরহ অনলে পোড়ে। আর ঐ সব প্রতারিত বিরহকাতর প্রেমিকের আর্তনাদ নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন-

“ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি/ দুরন্ত ষাড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়/ বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীলপদ্ম/ তবু কথা রাখে নি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ/ এখনো সে যে কোনো নারী!” (কেউ কথা রাখে নি)

প্রেমিকার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যা প্রেমিকের কাছে অসাধারণ, মনোমুগ্ধকর, আকর্ষণীয় হয়। বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ ভঙ্গিমায় প্রিয়াকে দেখার জন্য অনেক আঘাত সহ্য করতে পারে। পারে অনেক কিছু ত্যাগ করতে। সমস্ত কিছুর বিনিময়ে হলেও প্রিয়ার সেই বিশেষ ভঙ্গিমা-মুহূর্ত দেখতে প্রেমিক কখনো কুণ্ঠিত হয় না। সানন্দে সব কিছু ত্যাগ করে ছুটে আসে প্রিয়ার সান্নিধ্যে। প্রেম-প্রিয়াকে পাওয়ার আকুতির প্রকাশ দেখতে পাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায়। যখন তিনি লেখেন-
“যতই বাতাস আঘাত করুক, তবুও তোমার রূপালি চক্ষু-/আজ আমি একা বৃষ্টিতে ভিজে, রূপালি মানবী, দেখবো তোমার/বৃষ্টি না-ভেজা একা বসে থাকা।” (রূপালি মানবী)

দেশপ্রেম মহৎ গুণ। খাঁটি দেশপ্রেমিক দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে দ্বিধা করে না। দেশ প্রেমিককে দেশ থেকে যদি গভীর ষড়যন্ত্রকারীরা নির্বাসনে দেয় তখন নির্বাসনে শুধুমাত্র প্রাণহীন দেহ যায়। আর আত্মা পড়ে থাকে দেশ-মাতৃকার বুকে। খাঁটি দেশপ্রেমিক কখনো দেশ থেকে পৃথক হয় না। এমনকি দেশ মাতৃকার বুকে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে চান। এ ক্ষেত্রে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) এর কাব্যিক উপস্থাপনা প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন- “আঁখি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়ালো,/ ওই আলোতেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে।।” (সার্থক জনম আমার) নিজ মাতৃভূমিকে ভালোবেসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন-

“বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ.../এ আমার ই সাড়ে তিন হাত ভূমি/যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো/আমি বিষপান করে মরে যাবো।।” (যদি নির্বাসন দাও)

মধ্যবিত্তের যাপিত জীবন সংগ্রামময়। একটা চাওয়া পূরণ করতে গেলে আর একটা চাওয়া তীব্রভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। সাময়িকভাবে চাওয়া পূরণ হলেও অপ্রাপ্তির ঘরে আরও বেশি কিছু জমা হয়। অপর দিকে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা বিলাসবহুল জীবন-যাপন করে। তারা বিভিন্নভাবে ভোগ-দখলে মশগুল হয়ে থাকে। কিন্তু তারা সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষদের দিকে খেয়াল করে না। বরঞ্চ তারা গরিবদের শোষিত শ্রেণীতে পরিণত করে দলিত মথিত করে। যা অমানবিক। তবু নিন্মবিত্তের দিন আনা-দিন খাওয়া মানুষেরা স্বপ্ন দেখে তাদের স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে। ঈশ্বর তাদের মনোবাসনা পূর্ণ করবেন। কিন্তু তা অপূর্ণ থেকেই যায়। কোনো দিনও পূরণ হয় না। আর ওই সব নিন্মবিত্ত শ্রেণীর হা-হুতাশ, উচ্চবিত্তের উল্লাস দেখি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার ছত্রে- “ভিখারীর মতন চৌধুরীর গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি/ ভিতরের রাস উৎসব/ অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কন পরা ফর্সা রমণীরা/ কত রকম আমোদে হেসেছে/ আমার দিকে তারা ফিরেও চায় নি!/ বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন আমরাও.../ বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয় নি কিছুই।” (কেউ কথা রাখে নি)

দীর্ঘ বিরহের পর- জীবনের চলার পথে ঘুরতে ঘুরতে প্রেমিক-প্রেমিকার সাথে যদি আবার দেখা হয়। তখন আবেগে জমানো কথা আর বলা হয় না। যা ভাবতে ভাবতে রাত পার হয়ে গেছে। যদি আবার দেখা হয় তার সাথে এই কথা বলব , ঐ কথা বলবো । এভাবে জমতে জমতে কথার পাহাড় হয়ে গেছে। কিন্তু যখন দেখা হল তখন আর কথা নেই। শুধু স্তব্ধতা , দৃষ্টি মেলা দেখা । উভয় জানে অনেক কথা বলার আছে কিন্তু কেউ কাউকে কিছুই বলতে পাওে না। সময় আজ ব্যবধান কওে দেছে। এক সময়ের কথার ¯্রােতকে বাইওে দিয়ে প্রবাহিত না কওে আজ অন্তর দিয়ে প্রবাহিত করছে। এভাবে চলতে থাকে। প্রয়োজনের তাগিদে বাস্তবতার নিরিখে পরষ্পরকে মুখ দিয়ে কিছু না বলেই চলে যায়। কিš মুখ দিয়ে বলার চেয়ে চোখ দিয়ে বা মৌনতায় যা বলেছে তা প্রেমিক হৃদয়ই জানে। কোনো অস্থিরতা নই শান্ত পরিবেশে নিরবে সব কথা বলা হয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ ভঙ্গিও পাল্টে গেছে। এমন বিরহ গাথা কথামালা সাজিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন-

“বহুক্ষণ মুখোমুখি চুপচাপ, একবার চোখ তুলে সেতু/ আবার আলাদা দৃষ্টি, টেবিলে রয়েছে শুয়ে / ................................/ আপাতত প্রকৃতির অনুকারী ওরা দুই মানুষ - মানষী /দু’খানি চেয়ারে স্তব্ধ , একজন জ্বলে সিগারেট/ অন্যজন ঠোঁটে হাসিটুকু মুছেও মোছে না/ আঙুলে চিকচিকে আংটি , চুলের কিনারে একটু ঘুম/ ফের চোখ তুলে কিছু স্তব্ধতার বিনিময়, / সময় ভিখারী হয়ে ঘোরে/ অথচ সময়ই জানে , কথা আছে, ঢের কথা আছে।” ( কথা আছে )

ভালোবাসা কি ? এমন প্রশ্নের জবাব সকলেই দিতে পারবে। কিন্তু প্রেয়োরসে ভালবাসা কি ? কেউ বলবেন মনের মায়া , কেউ বলবেন - আকর্ষণ বোধ , কেউ শারিরীক টানের কথা , কেউ মানষিক- শারিরীক উভয়কে সমর্থন করবেন। হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন - “ প্রেম হলো শুধু দেখা ও চোখের ভাল লাগা থেকে, রাগ থেকে প্রেম হয় , ঘৃণা থেকে প্রেম হয়, প্রেম হয় অপমান থেকে , এমনকি প্রেম হয় লজ্জা থেকেও। প্রেম আসলে লুকিয়ে আছে মানবসম্প্রদায়ের প্রতিটি ক্রোমসমে। একটু সুযোগ পেলেই সে জেগে উঠে।” আসলে প্রেম নির্ভরতার প্রতীক। ক্লান্ত জীবনানন্দ দাশকে প্রেয়সী দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল। আসলে জগত জুড়ে ভালবাসারই প্রকাশ। ভালোবাসাই টিকিয়ে রেখেছে জগত । তা না হলে কি আমাদের কোনো অস্তিত্ব থাকত? থাকত না। ভালবাসার বিনিময়ে শুধু ভালবাসা দিয়েই হয়। অন্য কিছু তার সাথে তুল্য নয়। যে যাই বলুক, হৃদয়ের প্রবল টানকে প্রকৃত প্রেম বলা যেতে পারে। প্রেমের সংজ্ঞা দিয়েছেন প্রেম- বিরহের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সংজ্ঞাটি নিন্মরূপ- 

“ভালোবাসা নয় স্তনের ওপরে দাঁত ?/ ভালোবাসা শুধু শ্রাবণের হা-হুতাশ?/ ভালোবাসা বুঝি হৃদয় সমীপে আঁচ?/ ভালোবাসা মানে রক্ত চেটেছে বাঘ/#/ ভালোবাসা ছিল ঝর্ণার পাশে একা/ সেতু নেই আকাশে পারাপার/ ভালোবাসা ছিল সোনালি ফসলে হওয়া/ ভালোবাসা ছিল ট্রেন লাইনের রোদে।/ #/ শরীর ফুরায় ঘামে ভেসে যায় বুক/ অপর বাহুতে মাথা রেখে আসে ঘুম / ঘুমের ভিতরে বারবার বলি আমি / ভালোবাসাকেই ভালবাসা দিয়ে যাবো।” (ভালোবাসা)

আধুনিক যুগযন্ত্রণা, চাওয়া-পাওয়ার তীব্র বিরোধ, হতাশা, বিরহে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা অনবদ্য। প্রেমের স্বরূপ নিরূপণে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। সহজ-সরল প্রচলিত শব্দে তিনি কবিতায় এমনভাবে তুলে এনেছেন যে পাঠকমাত্রই রসাস্বদনে সক্ষম। তীব্র প্রেমের আকুতি, না পাওয়া প্রেমের নস্টালজিয়া, নাগরিক জীবনে টানা-পোড়নকে কবিতায় পঙ্তি গঠনের মুন্সিয়ানার জন্য তিনি চিরদিন পাঠকের মনে মনে ঘুরবেন এমন প্রত্যাশা অমূলক নই।

মুস্তাক আহমেদ

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer