ঢাকা : সংখ্যালঘু শব্দটিই আমার কাছে জটিল মনে হয়। সংখ্যায় বা আনুপাতিক হারে কম সে কারণে যদি সংখ্যালঘু হয় তাহলে যারা আক্রমণের শিকার তারা সংখ্যালঘু নাকি যারা আক্রমণ নির্যাতন চালিয়েছে তারা সংখ্যালঘু- আরেকটি প্রশ্ন। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ, কাজেই সহজ সূত্রে এ দেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট কম থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে তাদের যদি সংখ্যালঘু বলি- তা হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাঙালি মুসলমানরা যে বসবাস করছেন তারাও তো সে দেশের সংখ্যালঘু। আচ্ছা সংখ্যায় কম হলে যদি সংখ্যালঘু হয়- তা হলে বাংলাদেশে যেসব দলের লোক বা সমর্থন কম তারা কি সংখ্যালঘু রাজনৈতিক দল? মনে হয় সংখ্যালঘু শব্দটির ব্যবহার নিয়ে নতুনভাবে ভাবা যেতে পারে।
`আমি ভগবানকেই সব বলে দেব! শুধু ভগবানকে বলে রেখেছি, কারো কাছে বিচার চাইনি।` সত্যেন্দ্রনাথ সিংড়া পৌর এলাকার বালুয়া বাসুয়া রোড়ের পল্লীবিদ্যুৎ অফিসের সামনের প্রতিভা লাইব্রেরির মালিক নিজের ওপর হামলার সত্যতা নিশ্চিত করে শুধু এটুকুই বললেন। নতুন করে প্রশ্ন তৈরি হলো- এ অকরুণ আর্তনাদ কি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে?
সৃষ্টি জগতে আমাদের প্রধান পরিচয় হলো- আমরা মানুষ। আমরা সৃষ্টির সেরা জীব, আশরাফুল মাখলুকাত। এই মহোত্তম পরিচয় সৃষ্টিকর্তাই আমাদের দিয়ে পাঠিয়েছেন। এর বাইরে আমাদের জাতি-ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় তো আছেই। প্রশ্ন হলো মানুষ পরিচয়টাই কি বড় বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়। আমাদের প্রধান পরিচয় মানুষ। পরের পরিচয় আমরা নাগরিক। তারও পরের পরিচয় ধর্মীয় বিশ্বাসের। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। আর ইসলাম হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ট এবং শান্তির ধর্ম। পবিত্র ইসলাম ধর্মে অত্যাচার-নির্যাতন, জোর-জুলুমের পক্ষে নয় বরং বিপক্ষে দিকনির্দেশনা দেয়া আছে। তাহলে কেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর নামে সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে আমরা এতটা মির্মম নির্যাতন করছি? প্রশ্ন থাকল।
বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। নিরীহ এবং শান্তিপ্রিয় এ মুসলিম মানুষ। পবিত্র কোরআন সুন্নাহ্র আলোকে যার যার মতো করে ধর্ম পালন করছে। এ দেশে ১০ থেকে ১৫ ভাগ মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম পালন করে আসছে। ৪৫ বছরে আমাদের মধ্যে কোনো সমস্যা হয়নি। আমরা একে অন্যের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে শান্তিময় জীবনযাপন করছি। ৪৫ বছরে এ নিয়ে আপত্তি নেই। কোনো ক্রোধ নেই, বিদ্বেষ নেই। একটি অহিংস জাতি হিসেবে বাঙালির সুখ্যাতি ও দৃঢ় অবস্থান। হঠাৎ করেই কেন জানি সবকিছুতে গোলমাল! আস্তিক আর নাস্তিকদের বিবাদ! আস্তিক বা নাস্তিকের পরিমাপক কিছু আছে কোনো মানুষের কাছে? পবিত্র ইসলাম ধর্ম কি সে অধিকার দিয়েছে কাউকে? তাহলে কেন এসব নিয়ে মাতামাতি? এর অন্যতম কারণ কি- যুদ্ধাপরাধের বিচার, ভোটের রাজনীতি না কি সম্পদ দখল আর অর্থ লুটপাটের সুযোগ?
আমরা যারা মুসলমান- তারা নামাজ পড়ব, আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পরিপালন করে চলার চেষ্টা করব। অন্যরা তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করবে। অনুরূপভাবে বিএনপির সমর্থক বিএনপিকে, আওয়ামী লীগের সমর্থক আওয়ামী লীগে এবং অন্য দলগুলোর সমর্থকরা তাদের সমর্থিত দলকে ভোট দেবে। এর বাইরে সাধারণ জনগণ যাকে খুশি তাকে ভোট দেবে। এটাই তো স্বাধীন মত প্রকাশের রীতি-রেওয়াজ। কোনো সমস্যা তো নেই। তা হলে কেন এ অবিচার, মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি, খুনোখুনি, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ?
আমরা সবাই একই দেশের নাগরিক। এ দেশের আলো-বাতাসে বড় হচ্ছি। সশস্ত্র যুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে এ দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। মায়ের মুখের ভাষা ছিনিয়ে এনেছি জীবন দিয়ে। আমরা সেই গর্বিত জাতি। এসব আমাদের মানায় না। সংখ্যালঘু নামের অজুহাতে অত্যাচার-নির্যাতনের ইতিহাস আজকের নতুন ঘটনা নয়। বারে বারে ফিরে আসছে এ ঘটনাচক্র। নির্বাচনকে ঘিরে প্রকাশ্য কিছু ঘটনা হয়তো বা ঝড় তোলে দেশজুড়ে। কিন্তু কেন এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, কারা ঘটায় তার প্রেক্ষাপট কেউ খোঁজে না। বাংলাদেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনে ইতিহাসে বিএনপি-জামায়াত-আওয়ামী লীগ সবারই দায় আছে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা বা মদদে ঘটে চলেছে এসব ন্যক্কারজনক মানবতাবর্জিত ঘটনা।
মনে প্রশ্ন জাগে- ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা যদি আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হয়েই থাকে তা হলে ক্ষমতাসীন দলের এটুকু দায়িত্ব কি ছিল না যাতে এ সব মানুষ নিরাপদে থাকতে পারে। সেখানকার আওয়ামী লীগ কী করেছে তা হলে? তাদের ভূমিকা কী ছিল?
আমি যতদূর জানতে পারি বা বোঝার ক্ষমতা রাখি তাতে আমার কাছে মনে হয় বা আমি বিশ্বাস করি না যে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা সবাই আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় বা সমর্থন করে। তাদের মধ্যেও অনেকে সক্রিয়ভাবে বিএনপির সঙ্গে রাজনীতি করছে। তাদের মধ্যে সমর্থক আছে বিএনপিরও। তা হলে এ খেলাটা খেলা হচ্ছে শুধুই কি রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেয়ার জন্য? আবার এ সমস্যাটি যেহেতু প্রতিবার নির্বাচনের পর পরই ঘটছে তাহলে সরকার, প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনের সচেতনতা এবং দায়িত্ব কী ? ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আলোচনা, কার দায় বেশি, কার কম এসব না করে আগে থেকেই ব্যবস্থা নিলে কী হতো? ঘটনার পরে আলোচনা, পরিদর্শন, সহানুভূতি, তদন্ত আর ত্রাণ বিতরণ না করে এ বিষয়টির স্থায়ী পরিত্রাণের ব্যবস্থা নেয়া উত্তম নয় কি?
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বর্তমানে দেশে মাদ্রাসা আর মসজিদ কয়েক লাখ। এসব মাদ্রাসার শিক্ষক এবং মসজিদকেন্দ্রিক ইমাম এবং মুয়াজ্জিনের সংখ্যাও কয়েক লাখ। ধর্মীয় এবং মূল্যবোধের সমাজ বিনির্মাণে ধর্মীয় শিক্ষাগুরু এবং ইমাম মোয়াজ্জিনদের ভূমিকা কি তারা রাখতে পারছেন! একটি ব্যাপার দিন দিন স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে অতীতের মতো আলেম সমাজ জাতিকে ধর্মীয় আদর্শে অনুসৃত করতে পারছে না। কালের প্রবাহে আলেম-ওলামাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও তাদের প্রভাব ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর বড় প্রমাণ, নিরীহ এ মানুষের অমানবিক এবং অন্যায়ভাবে নির্যাতন করার পরও সচেতন আলেম সমাজের নীরব ভূমিকা।
মানুষ আমাদের বড় পরিচয়। ধর্ম সম্পর্কে বাড়াবাড়ির কথা ইসলাম ধর্মে নিষেধ আছে। ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষায় এ ব্যাপারে আলেম সমাজের ভূমিকা নেয়া উচিত। সমাজে আদর্শ নাগরিক গঠন করতে হলে সুষ্ঠু ও আলোকিত মানসিকতার নাগরিক তৈরি করতে হবে। আর এ কাজটি করতে হলে ধর্মীয় এবং মূল্যবোধের শিক্ষার বিকল্প নেই। পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর প্রতিটি ধাপে আদর্শ নাগরিক, সমাজ, রাষ্ট্র গঠনের সঠিক দিকনির্দেশনা রয়েছে। তা হলে কেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর এমন পৈশাচিক ঘটনা ঘটবে।
দেশের ১৬ কোটি মানুষ আপনাদের সঙ্গে আছে এমন আশার বাণী শোনালে কি তাদের মনের সাহস বাড়ছে। প্রতিবারই তো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছেই। মানবাধিকার কমিশন, বিশেষ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, গণজাগরণ মঞ্চসহ অনেকে যাচ্ছেন, দেখছেন, কথা বলছেন অথবা ত্রাণ বিতরণ করছেন। এসবে তো কাজ হবে না। তাদের প্রয়োজন স্থায়ীভাবে পরিত্রাণ, ত্রাণ কোনো সমস্যা নয়। এ ঘটনাগুলোর বিচারকার্য দ্রুত শেষ করতে হবে। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য আইন পাস করতে হবে। স্থানীয়ভাবে অসাম্প্রদায়িক কমিটি গঠন করতে হবে। তা না হলে হিন্দুরা দেশটিতে এ দুই পক্ষেরই প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত হতে থাকবে।
আমাদের সংবিধানে সব ধর্মের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের আড়ালে অনেক সময় দুর্বৃত্তরা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে। এ দেশের নাগরিক হিসেবে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নির্যাতনের দায় মানুষ হিসেবে আমরা কিছুতেই এড়াতে পারি না। যারা দেশের নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নেই। দেশের মানুষের কাছে তারা অপরাধী। একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, মুসলিম বিশ্ব আজ গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত। প্রতিটি মুসলিম দেশকে ঘিরেই চলছে ষড়যন্ত্র।
ধর্মীয় ইস্যুকে উসকে দিয়ে বিভিন্ন মুসলিম দেশে প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দিচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীরা। এ বাস্তবতার শিকার ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। বিশ্বলোভীদের কূটকৌশলে সম্ভাবনাময় মুসলিম দেশগুলো পরিণত হয়েছে একেকটি মৃত্যুপুরীতে। ধ্বংস হচ্ছে দেশের সম্পদ, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে জীবনমান উন্নয়নের গতিধারা আর সৃষ্টি হচ্ছে ভাইয়ে ভাইয়ে বিভেদ ও বিনষ্ট হচ্ছে জাতীয় ঐক্য। এ গভীর ষড়যন্ত্রের কালো থাবা প্রসারিত হয়ে ক্রমেই এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাকে গ্রাস করার লক্ষ্যে। এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে এখনই সতর্ক না হলে জাতি হিসেবে আমরা তলিয়ে যাবো ধ্বংসের অতল গহ্বরে।
এস এম মুকুল : মুক্ত লেখক ও প্রাবন্ধিক
বহুমাত্রিক.কম