ঢাকা : মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের দেশের এটি অনেক বড় একটি ঘটনা।
দেশের সব পরিবারেরই পরিচিত কেউ না কেউ এসএসসি পরীক্ষা দেয়। আগ্রহ নিয়ে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করে। ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর ক্যামেরাম্যানরা নামিদামি স্কুলগুলোতে যায়, ছেলে-মেয়েদের আনন্দোজ্জ্বল মুখের ছবি তোলে। আমরা পত্রপত্রিকায় দেখি, আমাদের ভালো লাগে।
আমি দুরুদুরু বক্ষে পরের দিন পত্রিকা খুলি, পত্রিকার ভেতরের পাতায় চোখ বোলাই, এখন পর্যন্ত একবারও হয়নি যখন পরীক্ষার ফলাফলের হতাশার কারণে ছেলে-মেয়েরা আত্মহত্যা করে না। দেখে আমার বুকটা ভেঙে যায়।
মানুষের জীবন কত বড় একটা ব্যাপার, তার তুলনায় এসএসসি পরীক্ষার গুরুত্ব কত কম; কিন্তু এ দেশের কিশোর-কিশোরীদের সেটি কেউ বলে না। অভিমানী ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষায় মনের মতো ফলাফল করতে না পেরে আত্মহত্যা করে ফেলে।
মাঝেমধ্যে এক-দুটি ঘটনায় খুঁটিনাটি বের হয়ে আসে, আমরা শুনে হতবাক হয়ে যাই। যখন জানতে পারি এ রকম ঘটনার বড় একটি কারণ অভিভাবকদের অবহেলা তখন কোনোভাবেই সেটি মেনে নিতে পারি না। পরীক্ষার ফল তো খারাপ হতেই পারে—যদি হয়েই যায় তখন অভিভাবকদের, আপনজনদের বুক আগলে সেই কিশোর কিংবা কিশোরীটিকে রক্ষা করার কথা, তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কথা, সাহস দেওয়ার কথা। অথচ পুরোপুরি উল্টো একটি ঘটনা ঘটে, বেশির ভাগ জায়গায় অভিভাবকদের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, অপমানে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ছেলে-মেয়েরা গলায় দড়ি দেয়। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে। পৃথিবীর আর কোথাও আমাদের কিছু অভিভাবক থেকে নিষ্ঠুর অভিভাবক আছে কি না আমার জানার খুব কৌতূহল হয়।
এটি কেউ অস্বীকার করবে না যে দেশের মানুষ লেখাপড়ার গুরুত্বটি ধরতে পেরেছে, সবাই তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতে চায়। কিন্তু কিভাবে কিভাবে জানি লেখাপড়ার আসল অর্থটি কোথায় জানি হারিয়ে গেছে। সবার ধারণা হয়েছে লেখাপড়ার অর্থ পরীক্ষায় ভালো ফল করা। পরীক্ষায় ভালো ফল করেও যে অনেক সময় একটি ছেলে বা মেয়ে কোথাও কিছু করতে পারছে না, সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর পরও আমাদের অভিভাবকদের টনক নড়ছে না। ছেলে-মেয়েদের যে একটি আনন্দময় শৈশব থাকতে হয় সেটি অনেকেই জানে না। শুধু অভিভাবকদের দোষ দিই কিভাবে, আমরা নিজেরাই কি লেখাপড়ার পুরো প্রক্রিয়াটিই শুধু পরীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলিনি?
২.
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক, লেখক, শিল্পী, ফুটবল প্লেয়ার বের করতে দেওয়া হলে সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যায়। কাকে ছেড়ে কার নাম বলবে ধরতে পারে না। কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকের নাম বলতে বলা হলে দেখা যায় কোনো তর্কবিতর্ক না করে সবাই আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম বলছে। আমার ধারণা, লেখাপড়ার আসল উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত সেটি বোঝার জন্য আলবার্ট আইনস্টাইনের জীবনের কয়েকটি উদাহরণ পরীক্ষা করে দেখা যায়।
তাঁর জীবনের একটি গল্প এ রকম। তিনি তখন আমেরিকায় এসেছেন, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে থাকেন। এত বড় একজন বিজ্ঞানীকে তাঁর নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ খুবই সতর্ক। একদিন রাতের বেলা ইউনিভার্সিটির পুলিশ দপ্তরে একটি টেলিফোন এসেছে। একজন মানুষ টেলিফোন করে আইনস্টাইনের বাসার নম্বরটি জানতে চাইছেন। খুব স্বাভাবিক কারণেই পুলিশ বলল, আইনস্টাইনকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য তাঁর বাসার নম্বরটি গোপন রাখা হয়েছে। এটি কাউকে বলা যাবে না। মানুষটি পুলিশকে জানালেন, তাঁকে আইনস্টাইনের বাসার নম্বর জানালে কোনো ক্ষতি নেই। কারণ তিনি নিজেই আইনস্টাইন। বাসার নম্বরটি ভুলে গিয়ে এখন নিজের বাসাটি খুঁজে বের করতে পারছেন না।
বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে অনেক ধরনের গল্প থাকে। কাজেই এই গল্প কতখানি সত্যি ও কতখানি অতিরঞ্জিত আমার জানা নেই। আমরা নিজেরাও অনেক সময় অনেক কিছু ভুলে যাই; কিন্তু সেটি কখনো দশজনের সামনে প্রচার করা হয় না, উল্টো আমরা অপদার্থ মানুষ হিসেবে বকাঝকা খাই। তবে আইনস্টাইনের গল্পটির একটি গুরুত্ব আছে, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একজন বিজ্ঞানী যিনি, তাঁর মস্তিষ্ক ব্যবহার করে সারা পৃথিবীর চিন্তারজগতে ওলটপালট করে ফেলতে পারেন, তাঁর নিশ্চয়ই একটি নম্বর মনে রাখার ক্ষমতা আছে; কিন্তু তিনি তাঁর মস্তিষ্কটিকে তথ্য দিয়ে ভারাক্রান্ত করতে চাইতেন না! আমাদের মস্তিষ্কটি তথ্য জমা রাখার জন্য তৈরি হয়নি, আমাদের মস্তিষ্ক তৈরি হয়েছে তথ্যকে বিশ্লেষণ করার জন্য, তথ্যকে প্রক্রিয়া করার জন্য। সোজা কথায় বলা যায় সমস্যা সমাধান করার জন্য।
কাজেই আমরা যখন দেখি ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করছে শুধু পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য; কিন্তু সেটি করতে গিয়ে তার মহামূল্যবান মস্তিষ্কটি অপব্যবহার করে সেটিকে অকেজো করে ফেলছে, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাটিকে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে—তখন অবশ্যই আমাদের দুশ্চিন্তা হয়।
মস্তিষ্ক নিয়ে কথা বলতে হলে ঘুরেফিরে অনেকবারই আইনস্টাইনের কথা বলতে হয়। আমরা কোনো কথা বললে সেটি কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেবে না; কিন্তু আইনস্টাইন বললে সেটিকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। আইনস্টাইন বলেছেন, জ্ঞান থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কল্পনাশক্তি। কথাটি আমি অসংখ্যবার উচ্চারণ করেছি, অসংখ্যবার ছেলে-মেয়েদের মনে করিয়ে দিয়েছি। (কোনো কোনো ছেলে-মেয়ে আমাকে প্যাঁচে ফেলে দেওয়ার জন্য বলে, স্যার, তাহলে আমরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে দিনরাত গালে হাত দিয়ে কল্পনা করি না কেন? আমি তাদের চেষ্টা করে দেখতে বলেছি, তাহলে নিজেরাই আবিষ্কার করবে জ্ঞানের ওপর ভর না করে শুধু কল্পনা বেশি দূর যেতে পারে না)। কল্পনাশক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণটি সহজ। আমাদের যখনই জ্ঞানের ঘাটতি হয় আমরা চেষ্টাচরিত্র করে সেই ঘাটতিকে পূরণ করে ফেলতে পারি। কিন্তু যদি কল্পনা করার শক্তি একবার হারিয়ে ফেলি, তাহলে সেটি আর ফিরে পাওয়া যায় না।
কাজেই আমাদের লেখাপড়ার উদ্দেশ্যেটাই হতে হবে কল্পনাশক্তিকে বাঁচিয়ে রাখার একটি যুদ্ধ। প্রতি পরীক্ষায় গোল্ডেন ফাইভ পেয়ে জীবনের আসল পরীক্ষায় যদি আমরা একটি ছেলে-মেয়েকে অপ্রয়োজনীয়-অকেজো একটি মানুষ হিসেবে পাই, তাহলে সেই দুঃখ আমরা কোথায় রাখব?
৩.
সপ্তাহখানেক আগে লেখাপড়াসংক্রান্ত ব্যাপারে আমার দুটি ছোট প্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ হয়েছে। প্রথম প্রতিক্রিয়াটি একজন অভিভাবকের, তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, তিনি তাঁর ছেলেটিকে কি বাংলা মিডিয়ামেই রাখবেন, নাকি ‘ও’ লেভেল, ‘এ’ লেভেলে সরিয়ে নেবেন। এসব ব্যাপারে আমি কখনোই কোনো উপদেশ দিই না, এবারও দিইনি; কিন্তু আমি জানতে চেয়েছি কেন হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন। তিন যেটি বললেন সেটি শুনে আমি হকচকিয়ে গেলাম। অভিভাবকটি আমাকে জানালেন, আমাদের দেশের মূলধারার লেখাপড়ায় তিনি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হয়, যদি বা ফাঁস না হয়, সেই প্রশ্ন খুবই নিম্নমানের। পড়াশোনার পদ্ধতি মান্ধাতার আমলের। তাঁর ধারণা, এই পদ্ধতিতে পড়াশোনা করে একজন ছেলে বা মেয়ে বিশ্বমানের লেখাপড়া করতে পারবে না। যেহেতু পাশাপাশি আরেকটি পদ্ধতি রয়েছে এবং সেই পদ্ধতিতে তাঁর লেখাপড়া করানোর ক্ষমতা রয়েছে, তাহলে কেন সেটি করাবেন না।
আমি ব্যাপারটি জানার পর আমার পরিচিত অনেকের সঙ্গে এটি নিয়ে কথা বলেছি। আশ্চর্যের ব্যাপারে হলো, তাঁদের কেউই ব্যাপারটি শুনে অবাক হলেন না। যে বিষয়টি আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে সেটি হচ্ছে একসময় এ দেশের লেখাপড়ার ওপর অভিভাবকদের আস্থা ছিল, এখন যতই দিন যাচ্ছে ততই আস্থা চলে যাচ্ছে। পৃথিবীতে সব কিছু ধীরে ধীরে ভালো হওয়ার কথা, মনে হচ্ছে আমাদের দেশে লেখাপড়ার বেলায় উল্টোটি হচ্ছে। সবার ধারণা, যতই দিন যাচ্ছে লেখাপড়ার মান কমে আসছে। এর অনেক কারণ আছে, বেশ কিছু কারণের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এটিকে একটি সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা না হবে ততক্ষণ তার সমাধান হবে না। কেউ কি লক্ষ করেছে, যত দিন শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বীকার করেনি প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে তত দিন প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হয়নি। যখন স্বীকার করেছে, শুধু তখনই প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হয়েছে!
লেখাপড়া নিয়ে দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়াটি পেয়েছি একজন এসএসসি পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে। সে খুলনার একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছে এবং সেই স্কুলের ছেলে-মেয়েরা ক্লাসে আসে না। ক্লাসে না এসে তারা কী করে তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে, আমরা সেটি নিজেরাই অনুমান করতে পারব। আমাকে চিঠিটি কয়েকবার পড়তে হয়েছে নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে বিষয়টি একটি স্কুল নিয়ে। কলেজে এ ধরনের ঘটনা ঘটে সেটি আমরা সবাই জানি এবং মনে হয় আমরা সবাই সেটি মেনেও নিয়েছি। শিক্ষকরা ক্লাসে পড়ান না এবং অনেক উৎসাহ নিয়ে বাসায় পড়ান, সেটি এখন সামাজিকভাবে স্বীকৃত বিষয়। কিন্তু আমার ধারণা ছিল স্কুলের বিষয়টি আলাদা। লেখাপড়া হোক বা না হোক, ছেলে-মেয়েরা সবাই স্কুলে যায়। কিন্তু এখন দেখছি সেটি সত্যি নয়। যদি স্কুলে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে ছেলে-মেয়েরা ক্লাসে না এসে অন্য কোথাও যায়, অন্য কিছু করে, তাহলে সেটি খুবই ভয়ংকর ব্যাপার। গল্প-উপন্যাসে খুবই খারাপ একটি স্কুল বোঝানোর জন্য আমি নানা ধরনের বিচিত্র ঘটনার কথা লিখি, সেখানেও আমি এটি লিখতে সাহস পাই না, যেখানে ছেলে-মেয়েরা স্কুলে আসার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে স্কুলে আসছে না। যদি শিক্ষকরা সেটি অভিভাবকদের নজরে না আনেন, আর অভিভাবকরা এর সমাধান না করেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত আমরা কোন তলানিতে পৌঁছাব, কে জানে?
৪.
এ পর্যন্ত লিখে আমি আবিষ্কার করেছি যে আমি সারাক্ষণই মন খারাপ করা বিষয় নিয়ে লিখে যাচ্ছি। কিন্তু আশপাশে যে ভালো কিছু নেই তা নয়, সেগুলো দেখে ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে না নিই, তাহলে কেমন হবে?
স্কুলের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এই মাত্র অভিযোগ করেছি, আবার এই স্কুলের ছেলে-মেয়েরাই প্রগ্রামিং প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র-ছাত্রীকে হারিয়ে দিয়েছে! শুধু তা-ই নয়, তারা একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পর্যন্ত পেয়েছে। একটুখানি সুযোগ করে দেওয়া হলে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে আমাদের তাক লাগিয়ে দেয়। তাই তাদের নিয়ে মাঝেমধ্যে দুশ্চিন্তা হয়তো করি; কিন্তু হতাশ কখনোই হইনি।
শুধু অপেক্ষা করে থাকি দেখার জন্য দেশটির লেখাপড়ার বিষয়টি কখন আরেকটু গুছিয়ে নেওয়া হবে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
বহুমাত্রিক.কম