Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১০ ১৪৩১, বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪

সর্বসাধারণের কবি নজরুল

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১৮:১৩, ২০ মে ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

সর্বসাধারণের কবি নজরুল

কবি নজরুল বলতে কাউকে বাড়তি কোন কথা বা বিশ্লেষণ দিয়ে আবার চিনিয়ে দিতে হয় সেটা আমি কখনো শুনিনি। কারণ কবি নজরুল হলেন বাংলার কবি, বাঙালির কবি, বাংলার সর্বসাধারণের কবি। ক্ষণজন্মা ও ক্ষণকালীন সক্রিয় এ কবি যদি বাংলা সাহিত্যে না আসতেন তাহলে বাংলা সাহিত্য এতটা সমৃদ্ধ হতো না। তাঁর কবি প্রতিভা সম্পর্কে কারো কোন সন্দেহ নেই। এমনকি তাঁর সমালোচকরাও তাঁর কবি প্রতিভাকে কখনোই খাটো করে দেখেননি। স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে তাঁর জীবদ্দশাতেই বড়মাপের কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। কবিগুরু নজরুলের কবিসত্তার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর সঞ্চয়িতা গ্রন্থটি কবি নজরুলকে উৎসর্গ করে গেছেন। নজরুল কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি শুধু কবিতা রচনাতেই থেমে থাকেন নি। সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তিনি অবদান রাখেন নি।

কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির নামের সাথে কিছু স্থানের নাম এমনভাবে অঙ্গা-অঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে যেন সেসব ব্যক্তিবর্গের নাম থেকে সেসব স্থানের নামও কোনভাবে আলাদা করা যায় না। বাংলাদেশের জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে বাইগার নদী, মধুমতি নদী, টুঙ্গিপাড়া গ্রাম, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, ঢাকার ধানম-ির ৩২ নম্বর ইত্যাদি স্থান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, বিশ্বভারতী, শান্তি নিকেতন, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, কুঠিবাড়ি, সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর, নওগাঁর পতিসর ইত্যাদি স্থান বিখ্যাত হয়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

ঠিক একইরকমভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে কবি নজরুলের জন্য বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রাম। সেখানেই শেষ নয়, তাঁর জন্য আরো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে ত্রিশালের দরিরামপুর, কাজির সিমলা দারোগা বাড়ি, বটতলা ও বিচুতিয়া বেপারি বাড়ি। কবি নজরুলের নামের সাথে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রয়েছে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জসহ আরো অনেক জায়গা। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে ঢাকায় কবিভবন।

সেই কবিভবনকে নিয়ে অন্য আরেকটি ইতিহাস রয়েছে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কবিকে ভারত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি কবিকে শুধু ফিরিয়ে এনেই ক্ষান্ত হননি। বাঙালির প্রাণের ও মননের এ কবিকে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর নিজ বাড়ির পাশের একটি বাড়িতে এনে তোলেন। পরবর্তীতে সেটিকেই নাম দেওয়া হয়েছে কবিভবন। আর এ কবিভবনই এখন নজরুল গবেষণার প্রাণকেন্দ্র নজরুল ইন্সটিটিউট। সে বাড়িতে তুলে কবি নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদায় সিক্ত করেন। ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট (১২ ভাদ্র) পর্যন্ত আমৃত্যু কবি সেই কবিভবনেই ছিলেন।

আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ করার সময় ময়মনসিংহের ত্রিশালের কাজির সিমলা গ্রামের কাজী বাড়ির কাজী রফিজ উল্লাহ দারোগা নিয়ে এসে যেমন করে কিশোর নজরুলের কবি প্রতিভাকে প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে গনমানুষের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিনে। সেরকমভাবে কবিকে দেশে ফিরিয়ে এনে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার কবি হিসেবে, বাংলা সাহিত্যের কবি হিসেবে, আমাদের নিজেদের কবি হিসেবে জনমানুষের কাছে পরিচিত করে দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন। যাতে করে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত কবির জীবনের শেষ কয়েকটি বছর বাঙালিরা তাঁকে নিজেদের করে পেয়েছিল। যেখানে কবি নজরুলকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে পাওয়ার সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়।

কবিতা, কবি, কবিত্ব ইত্যাদি হলো অনেকাংশেই শিক্ষিত মানুষের বিষয়। কিন্তু কবি নজরুলের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি সম্পূর্ণই আলাদা। কারণ মূর্খ, নিরক্ষর, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, মধ্যশিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত- তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যারা কবি নজরুলের নাম জানেন না, তাঁকে চিনেন না, কিংবা তাঁর সাহিত্যকর্মের কোন না কোন প্রতিভার খবর রাখেন না। বাংলাদেশের ভিতরে এবং ভারতে বাংলা ভাষাভাষি তো বটেই, অন্যান্য ভাষার মানুষও কবি নজরুলের সাহিত্যকর্মের ভক্ত। কী আছে নজরুলের সাহিত্য-কর্মে? কেনইবা সবধরনের জনসাধারণ তাঁর সাহিত্য-কর্মের প্রতি এতটা আসক্তি অনুভব করে? যুগে যুগে গবেষকগণ এর অনুসন্ধান করেছেন। আমার এ নিবন্ধে কিছু বিষয় আলোচনা করব।

এর প্রথম কারণ হলো, আগেই বলেছি কবি নজরুল সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তিনি অবদান রেখে সমৃদ্ধ করেন নি। তিনি রণ সংগীত রচনা করেছেন যা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্যারেড গ্রাউন্ডে ধ্বনিত হয়। তিনি বিদ্রোহীর মতো কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর কবিতা গান তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তিনি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য ও পা-ুলিপি লিখেছেন, চলচ্ছিত্রে অভিনয় করেছেন, লিখেছেন কালজয়ী নাটক, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ। করেছেন বিদেশি জনপ্রিয় গ্রন্থ অনুবাদ। লিখেছেন শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ সবার জন্য পাঠোপযোগী সাহিত্যকর্ম।

তাঁর সকল শাখার সাহিত্যকর্মই গুরুত্বপূর্ণ। তবে তাঁর সকল সাহিত্যকর্মের মধ্যে গান বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। নজরুলের গান ‘নজরুল গীতি বা নজরুল সংগীত’ হিসেবে গণমানুষের কাছে পরিচিত। আর সম্ভবত গানের বৈচিত্র্যের জন্যই তিনি সাধারণ মানুষের নিকট এতটা বেশি পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি সব ধর্মের মানুষের জন্য লিখেছেন গান। একজন মুসলিম হিসেবে তিনি মুসলমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি আধ্যাত্মিক গান রচনা করেছেন। একমাস সিয়াম সাধনার পর বহু কাঙ্খিত রমজানের ঈদের চাঁদ উঠার সাথে সাথে একটি জনপ্রিয় গান, ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, সবার মনে সত্যিই এক অন্যরকম ঈদ অনুভুতি এনে দেয় এ গানের মাধ্যমে। দেশের মানুষ ঈদের বার্তাবাহী এ গানটির জন্য যে কত আকাঙ্খিত থাকে তা সময় এলেই সবাই উপলব্ধি করতে পারেন। আরো ইসলামী গান যেমন- ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান, কোথা সে মুসলমান’, ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’ ইত্যাদি ইত্যাদি। হিন্দু সনাতনি ধর্মাবলম্বীদের জন্য ‘অঞ্জলি লহ মোর সংগীতে’, ‘ব্রজ বুলি জপে হরি, হরি রে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অপরদিকে লোকজ আমেজে বাঙালির আবহমান কালের সবার অতি পরিচিত ‘পদ্মার ঢেউরে’, মোর হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যা যারে’, ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া, মজনুগো আঁখি খোল’ ইত্যাদি গান গ্রাম বাংলার সকল মানুষের হৃদয়ে ঢুকে পড়েছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেখাপাত করে কবির জীবন সংগ্রাম। তাঁর জন্ম একটি স্বনামখ্যাত ও বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী কাজী পরিবারে হওয়া সত্ত্বেও জন্মের পর বাবার মৃত্যু হলে তিনি সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে কঠিন সমস্যায় পড়ে যান। অর্থাভাবে এ মেধাবী শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বাবার মৃত্যু, তারপর আবার অর্থকষ্ট, সেজন্য তাঁকে ছোটবেলায় দুখু মিয়া নাম দেওয়া হয়। তারপর শিশুকালে মক্তবে শিক্ষকতা, মসজিদের মোয়াজ্জিন, রুটির দোকানে চাকুরি, জায়গির মাস্টার, ছাত্র পড়ানো ইত্যাদি পেশায় তাঁকে নিয়োজিত হতে হয়েছে। কিন্তু কবির ছিল অদম্য কর্মস্পৃহা ও মেধা। মানুষের জন্য ছিল প্রেম প্রীতি ভালোবাসা। সেজন্য তাঁর দুঃখে মানুষ দুঃখী হয়, সুখে সুখী হয়।

আমাদের দেশের প্রত্যেকটি শিশুই জন্মের পর প্রথমে কিছুদিন হলেও স্কুলে যাতায়াত করে থাকে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগেরই হয়তো শেষপর্যন্ত প্রাইমারি স্কুলের গ-িই পার হওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু তারা যে পর্যন্তই পড়–ক না কেন, তাতেই সবার কবি নজরুলের উপর একটি পরিচিতি ঘটে যায়। কারণ একেবারে ছোট বয়স থেকেই নজরুলের কবিতা পাঠ বাচ্চাদের জন্য একপ্রকার বাধ্যতামূলক। আর তখন থেকেই নজরুল সম্পর্কে, তাঁর জীবনী সম্পর্কে, তাঁর জীবন সংগ্রাম সম্পর্কে জানতে পারে সবাই।

নজরুল গণমানুষের চেতনার কবি। তিনি সবার মধ্যেই বাস করে থাকেন। আমরা যখন ছোটবেলায় সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। তখন একেকটি সিনেমার কাহিনী, প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের উপর মনে পরম রেখাপাত করতো। কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও তা কখনো মন থেকে চলে যেতো না। তেমনি একটি সিনেমা ছিল ‘ছুটির ঘণ্টা’ যেখানে একজন স্কুল পড়–য়া শিক্ষার্থীর করুন জীবনাবসানের কাহিনী চিত্রিত হয়েছে। অপরদিকে বলতে গেলে ‘এতিম’ সিনেমাটিও আমার মনে খুবই রেখাপাত করেছিল, যেখানে একটি ছোট্ট ছেলের মা-বাবা মারা যাওয়ার পরে এতিম হয়ে যাওয়ার করুন কাহিনী সেখানেও ফোঁটে উঠেছে। নজরুলের জীবন এর থেকেও বেশি করুন ছিল। সেজন্যই কবি নজরুলের জীবনীপাঠে, পাঠক ও শ্রোতা মানেই রেখাপাত করে।

নজরুলকে নিয়ে এমন আগ্রহ যে শুধু আমাদের এ বঙ্গে তা নয়। পশ্চিমবঙ্গসহ পুরো ভারতবর্ষে তো বটেই এমনকি সারাবিশ্বে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ সালের ২৫ মে কবি নজরুলের যখন জন্ম তখন ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত বাংলা নামে পরিচিত ছিল। তখন আমরা কিংবা তারা একটি দেশেরই অধীনে ছিলাম। কিশোর বয়সে ১৩-১৪ বছর বয়সে কিশোর নজরুল যখন কাজী রফিজ উল্লাহ দারোগার হাত ধরে ত্রিশালে আসেন তখন তিনি একবছর সময়কাল ত্রিশালে এবং তারপর বিভিন্ন সময়ে এ বাংলার আরো কিছু স্থানে বেশ কিছুদিন দফায় দফায় অবস্থান করেছিলেন। এসব স্থানে প্রণয়-বিরহ বিয়ে-শাদীসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম করেছেন। যেভাবেই এ বঙ্গে থাকুন না কেন সারাবিশ্বের বাঙালির মতো আমাদের বাংলাদেশের বাঙালিরাও নজরুলকে আমাদের দেশের কবি হিসেবেই আত্মস্থ করে মেনে নিয়েছিলেন। আর তার সর্বশেষ পরিণতি দিলেন ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক কবিকে বাংলাদেশে এনে জাতীয় কবির মর্যাদার আসনে সিক্ত করার মধ্য দিয়ে।

এখন দুই বাংলায় সমানভাবেই নজরুলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে এটা ঠিক যে ভারতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। একসময় রবীন্দ্রণাথের পাশাপাশি নজরুলকে খুব কমই গুরুত্ব দেওয়া হতো। তবে যতই দিন যাচ্ছে ততই নজরুলের বহুমুখী সাহিত্য প্রতিভার কারণেই তাকেও এখন যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। সারা ভারতেই এখন নজরুল চর্চা এবং গবেষণা হয়ে থাকে।

এমনিতে তো সাহিত্য আলোচনায় এগুলো হরহামেশাই উঠে আসছেই, তারউপর সম্প্রতি এটি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে আমাদের কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক দলের একটি সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে। গত বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে সর্বপ্রথম কবি নজরুলের জন্মস্থান আসানসোলে স্থাপিত কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বাংলাদেশে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে নজরুলের ১১৭তম জন্মজয়ন্তীর মাধ্যমে একটি সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগ তৈরী হয়। সেবছর আমাদের তিন দিনব্যাপী নজরুল জয়ন্তীতে পশ্চিমবঙ্গের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. সাধন চক্রবর্তী ও সেখানকার বাংলা বিভাগীয় প্রধান ড. মোনালিসা দাস অতিথি হিসেবে এসে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রথম ধাপটি সম্পন্ন করেন।

এর ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহীত উল আলম একাধিকবার আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সেখানকার নজরুল বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউিট অব নজরুল স্টাডিজ এর প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন আমাদের উপাচার্য মহোদয়। সেখানে ইন্সটিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ এর সহকারি পরিচালক নজরুল গবেষক মুহাম্মদ রাশেদুল অনামও যোগ দেন এবং সেখানে নজরুল বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। উক্ত সেমিনারে বাংলাদেশের বিশিষ্ট নজরুল বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ইমেরিটাস প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম, পদ্মভূষণ পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. আনিসুজ্জমান অংশ নেন।

তার আগে ত্রিশালের নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. সাহাব উদ্দিন, চারুকলা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক সিদ্ধার্থ দে এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. শেখ মেহেদী হাসান এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি গবেষক দল ভারতের দার্জিলিংয়ে অবস্থিত উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, বোলপুরে বিশ্বভারতীর শান্তি নিকেতনে, হায়দারাবাদের ইংলিশ এন্ড ফরেন ল্যাংগুয়েজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিল্লিসহ আরো বেশ কয়েকটি ভেন্যুতে নজরুলের উপর কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করে এসেছেন। এতেও নজরুল গবেষণার মাধ্যমে তাঁর সার্বজনীনতা বিস্তৃত হচ্ছে।

নজরুলকে গবেষণায় অগ্রাধিকার দিয়ে আন্তর্জাতিকমানের যেসব ব্যবস্থাদি ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান এ বিষয়ে সর্বদা প্রত্যক্ষ সাপোর্ট দিয়ে চলেছেন। নজরুল গবেষণাকে আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে চালিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে এবারে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ১১৮তম নজরুল জয়ন্তীতে উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানসহ আন্তর্জাতিক সেমিনারগুলোতে পর্যায়ক্রমিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. সাধন চক্রবর্তী, বাংলা বিভাগীয় প্রধান ও নজরুল গবেষক ড. মোনালিসা দাস, দার্জিলিংয়ের উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা াবভাগের প্রফেসর ড. কনিকা বসুকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র যোগাযোগ করা হয়েছে। সেখানে তাঁরা যোগ দেওয়ার প্রাথমিক সম্মতিও প্রদান করেছিলেন। সেটি হলে একদিকে যেমন অনুষ্ঠানটি আন্তর্জাতিকতা পেতো অপরদিকে নজরুলের সার্বজনীনতা আরো গণমুখী হতো।

আমাদের কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন হয়ে গেল ১৯ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে। সেখানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর সভাপতির বক্তৃতার একটি বিরাট অংশ জুড়ে ছিল নজরুলের বিদোহী ভাব, মানব প্রেম, সমন্বয়বাদীতার উপর। কাজেই একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি নাগরিক নজরুলকে নিয়ে এমন ভাবনাই ভাবেন। নজরুলের সার্বজনীনতা নিয়ে এভাবেই ভাবেন জনগণ। তিনি নজরুলের সাথে ত্রিশালের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি যথার্থই রবীন্দ্রনাথ, শেখ সাদী, শেক্সপিয়ার, হাফিজের জন্মস্থানের মতো ত্রিশালকে নজরুল জীবনের উল্লেখযোগ্য স্থান হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

অনেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে কবি নজরুলের একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ নজরুল যেমন কবিগুরুকে তাঁর গুরুসম মনে করেছেন, ঠিক তেমনই কবিগুরুও নজরুলকে একজন কবি হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। তবে ভারতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যেভাবে চর্চাটা করা হয়েছে, সেভাবে কিন্তু নজরুল কখনই গুরুত্ব পাননি। সেখানে ধর্ম একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে বলে মনে করেছেন সাহিত্য বিশ্লষকগণ। কারণ ‘গোরস্থানের স্থলে মহাশ্মশান’ লিখে অমুসলিম হিসেবে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু নজরুল যেমন তেমন হিসেবে বিবেচনার জন্যই সকলে প্রস্তুত।

নজরুলের জন্মজয়ন্তী, মৃত্যুবার্ষিকী এখন প্রতিবছর জাতীয়ভাবে রাষ্ট্র পালন করে থাকে। সেজন্য বাংলাদেশে নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহে পালাক্রমে পালিত হয়ে থাকে। সেই পালায় বেশকিছু বছর পালিত হয়েছে ময়মনসিংহের ত্রিশালে। গতবছর (২০১৬) তারিখে পালিত হয়েছে কুমিল্লায়। এবছর (২০১৭) পালিত হচ্ছে রাজধানী ঢাকার ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা উদ্ভোধন করছেন। নজরুল জয়ন্তী ত্রিশালের মানুষের জন্য অন্যরকম এক ঈদ আনন্দ। কাজেই যেবছর জাতীয় নজরুল জয়ন্তী ত্রিশালে পালিত হয় না। সেবছরও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে সেটি জাতীয় আমেজেই পালন করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। এবছরও (২০১৭) তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।

এমনিতে তো প্রতিবছর পালন করা হয়ই। তাছাড়া ত্রিশালে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরর থেকে সেখানেও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছরই ভিন্নমাত্রায় তিন দিনব্যাপী নজরুল জন্মজয়ন্তী পালন করা হয়ে থাকে। ২০১৬ সাল থেকে এটি আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করেছে। কারণ সেবার ভারতের সাথে সাংস্কৃতিক ও গবেষণা বিনিময়ের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আনন্দের কথা, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে নজরুলের নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে নজরুলকে নিয়ে এখন তারাও অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। তারই অংশ হিসেবে ২০১৭ সালে ভারতের নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়েও তিন দিনব্যাপী নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপন শুরু করেছে। সেখানে আমাদের দেশের প্রথিতযশা নজরুল বিশেষজ্ঞ ও গবেষকগণ অংশ নিচ্ছেন।

নজরুল যে একজন সার্বজনীন লেখক, কবি, সাহিত্যিক-এগুলোই তার একটি বড় প্রমাণ। নজরুল বাংলাদেশের ত্রিশালে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ আসানসোলসহ সর্বভারতে। কাজেই নজরুলের চেতনা যার ভিতরে একবার ঢুকে যাবে তিনি বিশেষ গুণে গুণান্বিত হয়ে সমাজটাকেই বদলে দিতে পারেন। সেরকম একটি শক্তিশালী চেতনাই হলো নজরুল, যা সকলের মধ্যেই বিরাজমান। কাজেই নজরুল যে সার্বজনীন এবং সর্বসাধারণের কবি তাতে কারো সন্দেহ থাকার কোন অবকাশ নেই। আমরা সকলেই নজরুলের সার্বজনীন অনুসারী হতে চাই। তিনি মাত্র ২২-২৩ বছরের সাহিত্যজীবনে সর্বসাধারণের জন্য যে অবদান রেখে গেছেন তা যদি তিনি আমৃত্যু করে যেতে পারতেন, তখন তিনি কবিগুরুর মতো নোবেল জয় করে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে পারতেন তাঁর চেতনা, সমন্বয়বাদীতা ও দ্রোহের আলো।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer