ছবি : বহুমাত্রিক.কম
মৌলভীবাজার : মে দিবসকে সামনে শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টা বিনোদন আর ৮ ঘন্টা বিশ্রামের অধিকার নিয়ে যখন শ্রমিক নেতারা সরব তখন অনেকটাই অনালোচিত সিলেটে চা শিল্পে বেকার নারী শ্রমিকদের সঙ্গে বছরের পর বছর চলা বৈষম্যের কথা। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থেকেও তারা বৈষম্যমূলক মজুরিতে বহু অপ্রাপ্তিকে সঙ্গী করে জীবন পার করেন। শ্রমিক অধিকার দিবসের প্রাক্কালে প্রশ্ন উঠছে-এসব নারী শ্রমিকদের সঙ্গে বৈষম্য আর কত দিন?
দেশের অর্থকরী ফসল চা শিল্পে শ্রমজীবীদের একটি বিরাট অংশজুড়ে বেকারত্ব রয়েছে। চা বাগানের বেকার এসব যুবক, যুবতী, নারী-পুরুষ জীবিকার তাগিদে শিল্পের বাইরে বস্তি ও শহরে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকলেও নারী-পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে রয়েছে মজুরি বৈষম্য। সমান কাজে নিয়োজিত থাকায় মে দিবসের চেতনায় মজুরি বৈষম্য অবসানের দাবি চা শ্রমিক নেতাদের।
চা বাগানে কর্মরত নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা দৈনিক ৮৫ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। এর বাইরে বিপুল সংখ্যক বেকার নারী শ্রমিকরা বস্তি কিংবা শহরের নার্সারি, কৃষি আর বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনে কাজ করে দিন পার করছেন। চা বাগানের জরাজীর্ন কলোনী সমুহে গাদাগাদি পরিবেশে বসবাসরত নারী-পুরুষ শ্রমিকরা স্বল্প মজুরি আর বেকারত্বের কঠিন জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। চা বাগানের শ্রমিকদের এমনিতেই পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে চেহারায় হাড্ডিসার দশা।
বেকারত্বের জীবনে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানাদি নিয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বাগানের বাইরেও ইটভাটা, বিল্ড্রিং-কনস্ট্রাকশনসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এই নারী শ্রমিকরা জীবিকার তাগিতে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠিন কাজ করে চলেছেন। রোদ, বৃষ্টিতে ভিজে, পোক-মাকড়ের আক্রমনের মধ্যেই চলে তাদের কাজ। এরপর মজুরি! সেটিও পাঁচ সাত সদস্যের পরিবারে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বেকার নারী শ্রমিকরা চা বাগানে কাজ না পেয়ে সংসারের চাকা সচল রাখতে বস্তি ও শহরে বেঁচে নিয়েছেন কঠিন কাজ।
কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর চা বাগানের নারী শ্রমিক মনি চাষা (৪৩) বলেন, স্বামী বেঁচে নেই। এক মেয়েকে বিবাহ দিয়ে আরও এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে চলছে তাঁর সংসার। চা বাগানে কাজ নেই। বেকার জীবনে একসাথে ছেলেমেয়েকে মানুষ করা, সংসার চালানো, তাই রোজগারের জন্য বেঁচে নিয়েছেন বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের ইট বালি বহন করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। মাথায় ইট কিংবা বালির বোঝা বহন করে চলেছেন। যেকোন সময় দুর্ঘটনা কবলিত হওয়ারও আশঙ্কা নিয়েই জীবন সংগ্রামে অবতীর্ন হয়েছেন তিনি।
তারপরও মজুরি পুরুষদের তোলনায় কম। কাজের দৈনিক এই আয় দিয়েই কোন মতে দু:খ-কষ্টে খাবার-দাবার ও বাচ্চাদের পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন, এরপর বাসস্থান, স্যানিটেশন, পানীয়জল আর চিকিৎসা সমস্যা তো আছেই বলে জানালেন মনি চাষা। একই চা বাগানের নারী আচ্চামা গোয়ালা, রেবতি রিকিয়াশন সহ নারী শ্রমিকরা এধরণের অসংখ্য অভিযোগ তোলে ধরেন। শমশেরনগর চা বাগানের শ্রমিক লছমী রাজভর বলেন, চা বাগানের নারীদের কাছ থেকে সস্তায় শ্রম পাওয়া যাচ্ছে। বাগানে সারাদিন পরিশ্রম করে মজুরি ৮৫ টাকা, আর শহর-বস্তিতে কাজ করলে সর্ব্বোচ্চ দেড় থেকে দুশ’ টাকা দেয়া হচ্ছে। অথচ পুরুষ শ্রমিকদের বেলায় তিন থেকে চারশ’ টাকা মজুরি। এই বৈষম্য কোন মতেই কাম্য নয় বলে তিনি দাবি করেন।
মে দিবসে শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে মৌলভীবাজার চা শ্রমিক সংঘের নেতা রাজদেও কৈরী, চা শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য ও শমশেরনগর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য সীতারাম বীন বলেন, চা বাগানে কর্মরত আর বেকার শ্রমিকরা বাগানের বাইরে কর্মরত আছেন। তারা কঠিন কাজ ও পরিশ্রম করলেও ন্যায্য মজুরি বঞ্চিত রয়েছেন। তার উপরে রয়েছে মজুরি বৈষম্য। তাই মে দিবসের চেতনা বাস্তবায়নের মধ্যদিয়েই নারী পুরুষ শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও মজুরি বৈষম্য রোধ হওয়া উচিত বলে তারা দাবি করেন।
বহুমাত্রিক.কম