Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪

শীতলক্ষ্যার তীর থেকে

সখ্যতায়-শত্রুতায় মোঘল আর গাজী

ড. রফিকুল মোহাম্মদ

প্রকাশিত: ২০:২১, ২৫ মার্চ ২০১৪

আপডেট: ১৪:৪৯, ২১ জুন ২০১৪

প্রিন্ট:

সখ্যতায়-শত্রুতায় মোঘল আর গাজী

ঢাকা: নানাবাড়িতে বেড়ে উঠছে ছোট্ট শিশু । বয়স সাত আট হবে । শীতলক্ষ্যা পার হয়ে তার দাদা এসেছেন তাকে দেখতে । অনেক স্নেহে কাছে বসিয়ে ছোট শিশুর কৌতুকময় প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন দাদাজি। ইতিমধ্যে পাক-ভারত যুদ্ধ লেগে গেল । যুদ্ধের সব নতুন নতুন খবর । দাদার কাছে শুনলেন কীভাবে উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানরা মারামারি করতে করতে নিজেরা খন্ডিত হয়ে গেল আর খন্ডিত হয়ে গেল উপমহাদেশ ।

শিশুর মনে নিজ অঞ্চলের পুরনো কীর্তিগাথা শোনার কৌতুহল জাগল । দাদা বলতে লাগলেন– ভাওয়ালের অন্তর্গত দুর্গদরিয়া (বর্তমানের দরদরিয়া), কর্ণপুর দিঘলীর ছিট, শৈলাট ও শাইট হালিয়া ইত্যাদি স্থানে, শীষপাল নামে এক বৌদ্ধ রাজার কীর্তি-চিহ্ন রয়েছে । শীষপাল প্রথম দুর্গদরিয়া নির্মাণ করেছিলেন । স্থানীয় জনসাধারণ একে সারা রানীর ভিটা নামে চেনে । ১২০০ খ্রিস্টাব্দের পর মুসরমানগন রানী ভবানীকে পরাজিত করেই ভাওয়াল অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেছিলো ।

শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে একডালা দুর্গের পাশেই শীষপালের রাজধানী ও দুর্গাবাড়ির ভগ্নাবশেষ রয়েছে । শ্রীপুরের শৈলাটে শীষপালের পুস্পবাটিকা বা উদ্যান ছিল । শীষপালের মৃত্যুর পর তার পুত্র কর্ণকীর্তিপাল রাজা হয়েছিলেন, তার নামানুসারে গ্রামের নাম হয় কর্ণপুর । এ গ্রামে কর্নকীর্তির স্মৃতিবিজরিত বাংলাদেশের বড়দিঘি রয়েছে । দিঘির পশ্চিম তীরে কর্ণকীর্তিও রাজবাড়ি ছিল । এখানে খনন করে রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ ও পুরাকালের প্রচুর ইট পাওয়া গেছে । কর্ণকীর্তির ছেলে শ্রী কীর্তি পাল বা শ্রী পালের নামানুসারে শ্রীপুরের নামকরণ করা হয়েছে ।

সে সময়ের একজন বৌদ্ধ মুর্নীষি বড়দিঘি থেকে শীতলক্ষ্যার নদীর দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলেন এ অঞ্চলে গৌড়সিংহের জন্ম হবে । গৌড়সিংহ বলতে তিনি গৌড়ের সিংহ পুরুষদেও বুঝিয়েছেন । পুরনো রেকর্ডপত্রে গোশিংগাঁর পূর্ব নাম গৌড়সিংহা পাওয়া যায় । আর শ্রীপালের নাতী (ইন্দ্রপালের ছেলে) আদিত্য পাল শ্রীপুরের উত্তর প্রান্তে একটি মাঝারি আকারে দিঘি খনন করেন ।

সে আমলেই এ দিঘির নাম ছিল আদিত্য দিঘি । অনেক পরে গাজীদের আমলে লতিফ গাজীর পুত্র আরিফ গাজী সেই দিঘিটির আয়তন বাড়িয়ে পুর্নখনন করেন এবং স্ত্রী ওয়াদ্দিদার নামে নামকরন করেন ওয়াদ্দিদার দিঘি । শ্রী পালের দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে ভবপাল রাজাবাড়ি ইউনিয়নের চিনাশুখানিয়া গ্রামের বান্দাবাড়িতে নতুন রাজধানী স্থাপন করে সে অঞ্চলে রাজত্ব কায়েম করেছিল । চন্ডাল রাজা প্রতাপ ও প্রসন্ন বান্দাবাড়ি নগরটি ভবপালের নিকট থেকে অধিকার করে নিয়েছিলো। শ্রীপুর থানার দক্ষিণাংশ (রাজাবাড়ি, প্রহলাদপুর ইউনিয়ন, রাজেন্দ্রপুর), গাজীপুর সদর জেলার উত্তরাংশ ও কাপাসিয়ার দক্ষিণাংশ নিয়ে রাজা প্রতাপ ও প্রসন্নের রাজত্ব ছিল । আর রাজাবাড়ির পাশের গোল্লাবাড়ি ছিল তাদের সামরিক দুর্গ ।

শাল-গজারি বনাঞ্চলের ফাঁকে ফাঁকে ছিল মাঝারি বিল-ঝিল, ছোট খাল ও নালা । বর্ষাকাল পরিপূর্ণ থাকত জলরাশিতে । একমাত্র যানবাহন শালকাঠের তৈরি একশহাত লম্বা রাজ নৌকাই বর্ষাকালে রাজা স্থানান্তরে যেতেন নৌকাযোগে । শ্রীপুর রেল স্টেশন থেকে ১৫ মাইল পশ্চিমে দিঘলীর ছিটে ছিল উদ্যান নগরী ও জনপদ ।

গাজীপুরের বিখ্যাত একডালা দূর্গ থেকে বাংলার স্বাধীনতার ঘোষাণা করা হয় । দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার কারণে ইলিয়াস শাহ শেষ পর্যন্ত মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হন । শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ চম্পারণ গোরক্ষপুর ও কাশী জয়ের পর হিজরি ৭৫৩ বা ১৩৫২ সালে তিনি সুলতান ফকরউদ্দিন মুবারক শাহের কাছ থেকে সোনারগাঁ জয় কওে ”শাহে-বাংলা” হয়েছিলেন । তিনি শীতলক্ষ্যার তীরবর্তী দুর্গ একডালাতে সামরিক সদর দপÍর স্থাপন করেন ও দুর্গের সংস্কার করেন । একডালা দুর্গ থেকে দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা ঘোষণা করলে মোহাম্মদ বিন তুঘলকের ভ্রাতুপুত্র ফিরোজ শাহ তুঘলক, দিল্লি থেকে ইলিয়াস শাহের বিদ্রোহ দমনের জন্য শীতলক্ষ্যার অভিমুখে অভিযান চালান । ইলিয়াস শাহ দুর্গের ভেতরে অবস্থান করে বর্ষা কালের প্রতিক্ষায় থাকেন, বর্ষা বলে তুঘলক বাহিনী ভিজে ভিজে অসুস্থ ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে । সামরিক গোলাবারুদ ভিজে নষ্ট হয়ে যায় । শেষে রসদ ফুরিয়ে গেলে ফিরোজ শাহ তুঘলক দিল্লি ফিরতে বাধ্য হন ।

১৪৫৭ সালে ঢাকায় বখত-বিনাতের মসজিদ নির্মানের সময়েই সামন্ত শাসনবসান হয়। অতপর পাহলোয়ান মোহামেদশাহ গাজী ভাওয়ালে গাজীদের প্রত্যক্ষ শাসন শুরু করেন। তিনি এসেছিলেন দিল্লি থেকে রাজশাহী থেকে গাজীপুরে । আর তাঁর পুর্বপুরুষরা এসেছিলো মধ্যপ্রাচ্যে থেকে । তিনি পল্লুনসা গাজী নামেও পরিচিত ছিলেন । চতুর্দশ শতাব্দীতে দিল্লির বাদশাহর কাছ থেকে তিনি চেদী রাজ্যগুলোর শাসনভার লাভ করেন । উত্তরে গফরগাঁও-ভালুকা থেকে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার ওপার পর্যন্ত এবং শীতলক্ষ্যার পুর্বপাড়ে কাপাসিয়া-চরসিন্দুর থেকে এগারসিন্দুর পর্যন্ত অধিকার করে তিনি ইসলাম প্রচার ও শাসনকাজ পরিচালনা করেন । প্রথমে রাজধানী ছিল কালিগঞ্জের চৌরা গ্রামে । উত্তরের নৌ-ঘাঁটি টোক, দুরদরিয়া, রাজধানী চৌরা ও সদর একডালাতে তিনি উপযুক্ত স্থাপনা নির্মান করেছিলেন । পাহলোয়ান শাহ গাজী চেদী রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন ।

গজীরা স্থানীয় জনগনের চাইতেও দীর্ঘকার, উজ্জল বর্ণের অধিকারী ছিলেন । তাদেও পরবর্তী বংশধরগন স্থানীয়দের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ তাদের উওর পুরুষদের গায়ের রঙ শ্যামলা হয়ে উঠে ।  পাহলোয়ানশাহ গাজীর মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র হয়রত গাজী কারফরমা শাহ গাজী পুরের শাসনভার গ্রহন করেন । তিনি অনেক মসজিদ ও দিঘি খনন করেন, চৌরা দিঘি তার অমর কীর্তি । তিনি মসলিন কাপড় বোনা কারিগরদের গাজীপুরে নিয়ে আসেন ।

পরবর্তীতে গাজীপুর কাপাসিয়া উন্নত সূক্ষ বস্ত্র তৈরীর কেন্দ্রে পরিণত হয় । কাপাসিয়াতে তখন কার্পাস তুলা উৎপন্ন হতো এবং সেগুলো সুতায় রুপান্তর করা হতো । এখনকার কারিগরেরাই ঢাকাই হিয়ে মসলিন কাপড় তৈরী করতে শুরু করে । কারফরমা শাহ গাজীর পওে তার কনিষ্ঠভ্রাতা ও রণ ভাওয়ালের গভর্নর কাইয়ুম খাঁ গাজীকে দিল্লির স¤্রাট গাজীপুরের শাসন কাজে অধিষ্ঠিত করেন । কাইয়ুম শাহ গাজীর আমলে রণ ভাওয়ালের সিমানা দক্ষিণ কাপাসিয়া থেকে শ্রীপুর-কালিয়াকৈর এবং গফরগাঁও বিস্তৃতি লাভ করে ।

কাইয়ুম খাঁ গাজীর মৃত্যুর পর তার পুত্র বাহলুল মোহামেদ গাজী পৈতৃক সনদে গাজীপুরের শাসনভার গ্রহন করেন । তিনি ভাওয়াল গাজী নামে পরিচিত ছিলেন । শৌর্য ও পরাক্রমের কারনে তাকে গাজী বংশের প্রানপুরুষ মনে করা হয় । বাহালুল গাজী যখন ভাওয়ালের শাসন ক্ষমতায়, তখন শূর বংশীয় বীর পাঠান শেরশাহ দিল্লীর মানসদে আহরন করেন । তিনি রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে প্রাশাসনিক বিন্যাস সাধন করেন এবং তার বিশাল সম্রাজ্যকে ৪৭টি সরকার এবং সরকার গুলোকে সুবিধাজনকভাবে কয়েকটি পরগনাতে বিভক্ত করেন ।  শের শাহের সনদ নিয়ে বাহলুল গাজী কালীগঞ্জের চৌরাকে রাজধানী করে নিজ নামে পরগণার নাম করেন ভাওয়াল ।তার সামরিক সদর ছিল একডালা দূর্গে ও নৌসদর ছিল কাপাসিয়া টেকে। (চলবে)

লেখক: ইতিহাসবিদ, গবেষক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer