Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ভাওয়াল রাজবাড়ির কীর্তিনাশ

সৈয়দ মোকছেদুল আলম, যুগ্ম সম্পাদক

প্রকাশিত: ০০:৪৪, ২৬ মে ২০১৭

আপডেট: ০২:১৭, ২৬ মে ২০১৭

প্রিন্ট:

সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ভাওয়াল রাজবাড়ির কীর্তিনাশ

পুরনো ছবিতে ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজবাড়ির সন্মুখভাগ। গর্বের এই স্মারক স্থাপনার সন্মুখের এখন ভিন্নরূপ।

গাজীপুর : গাজীপুরের ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল রাজবাড়ির চেহারায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক এস.এম.আলম ভাওয়াল রাজা সন্নাসির স্মৃতি বিজড়িত এই সংরক্ষিত পুরাকীর্তির মূল দালানের কীর্তিনাশ ঘটিয়ে নিজ খায়েশ পূরণ করেছেন।

দক্ষিণমুখি খোলা বারান্দা আধুনিক সজ্জায় সাজিয়ে তাঁর স্বপ্নবিলাসী অফিস কক্ষ বানিয়েছেন। ফলে হঠাৎ করে তাকালে যে কোন সচেতন ব্যক্তি এখন হকচকিয়ে যান। চোখ কচলে ভাল করে পরখ করে দেখেন সত্যিই এটা গাজীপুরবাসীর গর্বের ধন সেই চিরচেনা ভাওয়াল রাজবাড়ি কিনা!

কারণ, তিনদিক থেকে বন্ধ করে দিয়ে সেখানে শীতাতপ যন্ত্র বসানো হয়েছে। পুরাতন দরোজা খুলে ফেলে বিদেশী মূল্যবান দু’টি নতুন দরোজা স্থাপন করা হয়েছে। শতাব্দী প্রাচীন দালানের দোতালা মেঝে নতুন করে ফিটিং করা বিদেশী টাইলসের নীচে চাপা পড়েছে। এই বাহারি স্থায়ী ও অস্থায়ী সাজসজ্জার জন্য ব্যয় হওয়া ৩০/৩৫ লাখ টাকার সংকুলান কোন উৎস থেকে কীভাবে হয়েছে-তা নিয়ে প্রশ্ন তো আছেই। কোন বিবেচনায় একজন জেলা প্রশাসক এমন তুঘলকী অপকর্ম ঘটাতে পারেন তা নিয়েও আছে বিশাল আশ্চর্যবোধক চিহ্ন।

সরেজমিনে দেখা যায়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রবেশ দ্বারের সামনে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে লাগানো সাইনবোডের্র বিজ্ঞপ্তিতে এ ধরণের কর্মকান্ডকে দন্ডনীয় অপরাধ বলে সতর্কবার্তা প্রকাশ করা হয়েছে।

এতে লেখা আছে, “কোন ব্যক্তি এই পুরাকীর্তির কোন রকম ধ্বংস বা অনিষ্ট সাধন করলে বা এর কোন বিকৃতি বা অংগচ্ছেদ ঘটালে বা এর কোন অংশের উপর কিছু লিখলে বা খোদাই করলে বা কোন চিহ্ন বা দাগ কাটলে, ১৯৬৮ সালের ১৪নং পুরাকীর্তি আইনের ১৯ ধারার অধীনে তিনি সর্বাধিক এক বৎসর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডনীয় হবেন।”

সাবেক জেলা প্রশাসক এস.এম আলম ওই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে এই অপকীর্তি ঘটানোয় দুঃখ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। ইতিহাসবিদ, গবেষক, সাংস্কৃতিক কর্মী-সংগঠক, বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিবিদ ও সচেতন নাগরিক মহলে এ বিষয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বইছে। বিশেষ করে দায়িত্ব গ্রহণের পৌনে দুই বছরের মাথায় জেলা প্রশাসক এস.এম.আলমকে বদলী করা হয় সেতু বিভাগে। গত ১৫ মে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব থেকে বিদায় নেন। এরপর থেকেই ভাওয়াল রাজবাড়ির আদল বদলে দেবার জন্য খলনায়ক এস.এম. আলমকে নিয়ে নেতিবাচক আলোচনার পরিগন্ডি বেড়ে চলেছে।

‘গাজীপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’-বই সূত্রে জানা যায়, এককালে ভাওয়াল পরগণার শাসন কাজ পরিচালিত হতো ভাওয়াল রাজবাড়ি থেকে। এই রাজবাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে ভাওয়াল রাজা সন্নাসি মেজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর ১২বছর পর পুনঃআবির্ভাবের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনি। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকের এ কাহিনির ঢেউ তখন ভাওয়াল পরগণা ছাড়িয়ে ভারত এমনকি টেমস্ তীরের বিলেত শহরে গিয়ে আঁছড়ে পরে। পত্র-পত্রিকা বিশেষ বুলেটিন বের করে। লিখিত হয় গল্প, উপন্যাস, কবিতা, পুথিঁপাঠ। নানা ভাষায় নির্মিত হয় চলচ্চিত্র।

স্থাপত্য বিশারদ নাজিমউদ্দিন আহমদ মন্তব্য করেছেন, “বাংলাদেশের মধ্যে ভাওয়াল রাজপ্রাসাদ হলো সর্ববৃহৎ প্রাসাদ যা এখনো অক্ষত। উত্তর-দক্ষিণে ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্য ত্রিতল বিশিষ্ট ভাওয়াল রাজবাড়ি নির্মাণ শুরু করেন লোক নারায়ণ রায়। প্রায় ১৫ একর জমির উপর ৩৬০ কক্ষ বিশিষ্ট মূল প্রাসাদ। ১৮৬০-৬১ সালে ‘বড় দালান’ (জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) নির্মাণের মধ্যে দিয়ে কালী নারায়ণ রায় রাজবাড়ির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন (সূত্র : ‘গাজীপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ ৩৪৫-৩৪৬ পৃঃ)।”

প্রসঙ্গতঃ ‘ভাওয়াল রাজবাড়ি’- গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এস.এম. আলমের আগে আরও ১৪ জন গাজীপুর জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরা সবাই রাজবাড়ির সামনের দালানের অন্য একটি কক্ষ অফিস হিসেবে ব্যবহার করেছেন। পুরাকীর্তির কোন ক্ষতি সাধন হয় এমন কাজ থেকে বিরত থেকেছেন। কেবল দেখভালের দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত বিভাগ রাজবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনে সংস্কার কাজ করে থাকে। মূল দালানের বারান্দায় জেলা প্রশাসকের বসার নতুন ব্যবস্থার কারণে পূর্বের অফিস কক্ষটি বর্তমানে এনডিসি’র অফিস কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

গাজীপুর গণপূর্ত অফিস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসকের নতুন অফিস তৈরির বিষয়টি তাঁরা শুনেছেন। কিন্তু এই অফিস থেকে সেখানে কোন কাজ করা হয়নি। ওই কাজের অর্থ যোগানের বিষয়েও তাঁরা কিছু জানেন না।

জেলা প্রশাসকের নাজির সুন্দর আলী এই বিষয়টি সম্পর্কে কিছু জানেন না এবং এল.আর (লোকাল রিসোর্স) ফান্ড থেকেও ওই কাজের অর্থ জোগান দেয়া হয়নি বলে জানান। এ প্রসঙ্গে আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটার খরচের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন”।

গত ১০ মে গাজীপুর প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় এস.এম আলম এ প্রসঙ্গে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলে জানান, তিনি চেয়েছিলেন নিজ উদ্যোগে রাজবাড়িকে আধুনিক রূপে সাজাবেন। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শিগগিরই রাজবাড়ি পর্যটনের জন্য বুঝে নিবে। তাই তিনি আর না এগিয়ে এ বিষয় থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন।

অন্যদিকে, গত ১৬ মে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের ভাওয়াল সম্মেলন কক্ষে এক মতবিনিময় সভায় নবাগত জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর এ ব্যাপারে উপস্থিত সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করে জানান, যা এখন যে অবস্থায় আছে তাই থাকবে। নতুন করে আর কিছু করা হবে না।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer