ছবি : বহুমাত্রিক.কম
সুনামগঞ্জ : ‘আমার মা দেশের জন্য যে অবদান রেখে গেছেন তার জন্য আমরা গর্ববোধ করি। আমার মায়ের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ হল না, অপূর্ণ রয়ে গেল। মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করবেন। সবাই আমার মায়ের জন্য সবাই দোয়া করবেন’-বলছিলেন প্রয়াত কাকন বিবির মেয়ে সখিনা বেগম।
তিনি বলেন, ‘বীরপ্রতীক খেতাব ঘোষিত হলেও আজও গেজেট আকারে প্রকাশ হয় নি আমার মা কাকন বিবির নাম। মৃত্যুর পূর্বেও যদি তিনি গেজেট আকারে প্রকাশ হত যদি তাহলে তিনি মরে গিয়েও খুশি হতেন।’
এবিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাবিরুল ইসলাম বলেন, ‘গেজেট আকারে প্রকাশের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে কথা বলেছি।’
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘খেতাব পেয়েও খেতাবের সুযোগ সুবিধা না পাওয়া টা খুবেই দুঃখজনক। জীবদ্দশায় এই প্রাপ্য পাওয়া প্রয়োজন ছিল। খেতাবের সকল সুযোগ-সুবিধা যে তার পরিবার পায় তার সকল ব্যবস্থা করতে হবে।
এদিকে, মুক্তিযুদ্ধে বীরপ্রতীক খেতাব উপাধিতে ভূষিত নারী মুক্তিযোদ্ধা কাকন বিবির দাফন সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবার বাদ আছর নামাজে জানাযা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এই মহিয়সী নারীকে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার জিরাগাঁও গ্রামের নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় থাকে দাফন করা হয়েছে।
এর পূর্বে কাকন বিবির মরদেহ বেলা একটায় সিলেট থেকে নিজ গ্রামে আনা হয়। পরে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম,পুলিশ সুপার বরকত উল্লাহ খান,জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ,উপজেলা প্রশাসন সকল দল ও বিভিন্ন সংঘটন এবং প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর তাতে গার্ড অব অনার সহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করা হয়।
সর্বস্তরের জনসাধারণের উপস্থিতিতে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়া খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরজাহান বেগম ওরফে কাকন বিবি সিলেট এম.এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গত বুধবার রাত সোয়া ১১টায় এই বীর প্রতীকের মৃত্যু হয় বলে নিশ্চিত করেন হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল একেএম মাহবুবুল হক।
শ্বাসকষ্ঠ নিয়ে গত সোমবার এই হাসপাতালে শেষবারের মতো ভর্তি হয়েছিলেন কাকন বিবি। এর আগে হত বছরের জুলাইয়ে পরবর্তীতে ডিসেম্বরে দু-দফায় ভর্তি হয়ে একই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেন তিনি।
কাকন বিবির জন্ম ১৯৪১ সালে বলে জানিয়েছেন তার ভাগ্নে ইনছান আলী। মেঘালয়ের নেত্রাই খাসিয়া পল্লীতে তিনি জন্মেছিলেন বলে সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃবৃন্দ স্বীকার করেন। তার গ্রামের বাড়ী সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার থানার লক্ষীপুর ইউনিয়নের জিরারগাঁও গ্রামে। এলাকায় তার পরিচিতি ছিল খাসিয়া মুক্তি বেঠি হিসাবে।
স্বামীর খোঁজ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পরিচিতি হয়। শুরু করেন গুপ্তচরের কাজ। এরপর মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহণ করেন কাকন বিবি। ১৯৭১ সালে ৩ দিনের নবজাতক কন্যাকে রেখে যুদ্ধে চলে যান কাকন বিবি। জুন মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন তিনি। বাংকারে আটকে দিনের পর দিন তাকে নির্যাতন করে পাক বাহিনী।
ছাড়া পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন কাকন বিবি। রহমত আলীর দলে সদস্য হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ করেন তিনি। একইসঙ্গে চালিয়ে চান গুপ্তচর বৃত্তির কাজ। নভেম্বর মাসে ৫নং সেক্টরের সেলা সাব-সেক্টরের অধীনস্থ টেংরাঠিলার সম্মুখ যুদ্ধে কয়েকটি গুলি তার শরীরে বিদ্ধ হয়।
পরে আমবাড়ী, বাংলাবাজার, টেবলাই, বালিউড়া, মহব্বতপুর, বেতুরা দুর্বণটিলা ও ছাতক পেপার মিলের যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধে কাকন বিবি প্রায় ২৫টির বেশী যুদ্ধে অস্ত্র হাতে জীবনবাজি রেখে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৬ সালে তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার।
পৃথক পৃথক বিবৃতিতে মুক্তিযোদ্ধা কাকন বিবির মৃত্যুতে সুগভীর শোক প্রকাশ ও তার শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ ৫ আসনের এমপি মুহিবুর রহমান মানিক, সুনামগঞ্জ-মৌলভীবাজার সংরক্ষিত আসনের এমপি এডভোকেট শামছুন নাহার বেগম শাহানা রব্বানী, সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোঃ সাবিরুল ইসলাম, দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইদ্রিছ আলী বীরপ্রতীক, মুক্তিযুদ্ধ চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের আহবায়ক এডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হুমায়ুন কবীর, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নয়ন, সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী জাহান, সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি সাংবাদিক আল-হেলাল ও সাধারণ সম্পাদক ছাদিয়া বখত সুরভী।
বহুমাত্রিক.কম