ঢাকা : বাবা মা বাইরে কোনো কাজে অথবা অফিসে গেলে ছোট শিশুদের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে সেটি নিয়ে খুব সুন্দর করে বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেছেন বেবি সেন্টারে। সেখান থেকেই আমি যা শিখেছি, পাঠকদের জন্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
শিশু যখন ছয় মাস অতিক্রম করে, ধীরে ধীরে বাবা-মা এবং আশেপাশের পরিবেশের সঙ্গে সে ততোই খাপ খাইয়ে নিতে আরম্ভ করে। বিশেষ করে মায়ের সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। তবে একই সাথে মা বাবার সাথে সাময়িক সময়ের বিচ্ছেদ তাদের মধ্যে একধরণের ভীতি সৃষ্টি করে।
এ ব্যাপারটি কম বেশী সব শিশুর মধ্যেই দেখা যায়। আর এটি তাদের মানসিক বৃদ্ধির একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিছু কিছু শিশুর ক্ষেত্রে এটি একটু অতিরিক্ত মাত্রায় হয়ে থাকে। বাবা-মা কাজে গেলে বিশেষ করে চাকুরীজীবী মা হলে বেশিরভাগ শিশুই এইধরণের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং তাদের বিভিন্ন আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়।
সেক্ষেত্রে যারা মা’য়ের অনুপস্থিতিতে শিশুর দেখাশোনা করছেন, তাদের জন্য বিষয়টি একটু কষ্টকর হয়ে পড়ে। অনেক মা বাবাই লুকিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান বাচ্চা খুব কান্নাকাটি করবে দেখে, এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা অনেক বেশী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, কারণ তারা বিষয়টি বুঝতে পারে না। তার সবচেয়ে আপনজন হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো বলে এই নিরাপত্তাহীনতা অনেক গুণে বেড়ে যায়।
অনেক শিশুই মা বাড়িতে ফিরলে কাঁদতে শুরু করে এবং মায়ের সঙ্গ উপভোগ না করে সারাক্ষণ মা-কে আঁকড়ে ধরে রাখে-অসম্ভব খিটখিটে আচরণ করে। একক পরিবারে এই সমস্যাটি তীব্রতর।
অনেক শিশু নতুন অথবা স্বল্প পরিচিত মানুষ দেখলে অস্বাভাবিক আচরণ করে, ভয় পায় অথবা কান্না করতে থাকে, এসব আচরণের পিছনে মুল কারণ বহির্জগতের প্রতি শিশুর নিরাপত্তাহীনতা এবং ভীতি। এসমস্ত ক্ষেত্রে মা বাবা এবং অন্যান্য যারা বাচ্চার দেখাশোনা করেন তাদের অনেকখানি ভুমিকা কাজ করে।
কোন শিশু নতুন কারো কোলে যেতে না চাইলে কখনো জোর করা উচিৎ নয়, বাসায় অতিথি এলেও অনেক সময় এ ব্যাপারটি ঘটে। এই বয়সী শিশুরা খুবই আদরের হয়, কোনও সন্দেহ নেই-তবে জোর করে কোলে নিলে অথবা যার কাছে থাকতে চাইছে না জোর করে তার সাথে থাকতে বাধ্য করলে তাদের নাজুক মনে অনেক গভীর প্রভাব পড়তে পারে।
চাকরিজীবি মা-বাবা যখন অফিসে যান, শিশুকে বিদায় দিন দরজায় দাঁড়িয়ে, তাকে বুঝিয়ে বলতে থাকুন যে মা-বাবা কাজে যাচ্ছেন এবং আবার ফিরে আসবেন, বাচ্চারা ভাষা বুঝতে না পারলেও ‘টোন’ বুঝতে পারে, এবং গলার স্বরে যতদুর সম্ভব আন্তরিকতা মিশিয়ে বলতে থাকুন।
শিশুরা কাঁদলেও আপনি তাকে আদর করে হাসি মুখে বিদায় দিন। কয়েকদিনের মধ্যেই সে বুঝতে পারবে তার মা-বাবাকে এই সময় যেতে হয়। (এ বিষয়টি আমার বাচ্চার ক্ষেত্রে খুব ভালো কাজ করেছে) আপনি বেরুবার সময় সে একটু অসন্তোষ প্রকাশ করলেও বাকি দিনটি অনিরাপদ মনে করবে না, কারণ সে বুঝতে শিখবে আপনি নির্ধারিত সময়ে ফিরে আসবেন।
একটু ধৈর্য ধরে আপনার মুখে হাসি এবং কণ্ঠস্বরে ভরসা অক্ষুন্ন রাখুন। তবে এক্ষেত্রে যা একেবারেই করবেন না তা হলো, কান্না শুনে পিছনে ফিরে আসা, আবার তাকে কোলে নিয়ে বিদায় জানানো, এক্ষেত্রে বাচ্চা বিভ্রান্ত হয়ে যাবে এবং ভাবতে পারে কাঁদলে হয়তো আপনি ফিরে আসবেন।
বিদায় জানান, কিন্তু বিদায় জানানো প্রলম্বিত করবেন না কোনোভাবেই। অফিস থেকে ফিরলে যদি শিশু কান্নাকাটি করে, আপনি ফেরার পরপরই তার সাথে দেখা না করে একটু ফ্রেশ হয়ে তার সাথে দেখা করতে পারেন, এতে আপনি তার সাথে দীর্ঘক্ষণ কাটাতে পারবেন। এটি স্বাস্থ্যসম্মতও ।
শিশুকে নানি-দাদি, ম্যাইড, অথবা ডে-কেয়ার –যার কাছেই রাখুন না কেন, তাদের কাছে দীর্ঘক্ষণ ছাড়ার আগে তার সাথে টানা কয়েকদিন পরিচিত করান। যেসব শিশু সহজে অন্য কারো সাথে সহজ হতে পারে না, তাদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে এই নিয়ম রক্ষা করুন, অন্যাথায় হিতে বিপরীত হতে পারে। কোনো ভাবেই শিশুর ওপর মানসিক চাপ দিয়ে কিছু অভ্যাস করানো উচিৎ নয়।
এক্ষেত্রে সবসময় মনে রাখবেন এক একটি শিশু একেক জন আলাদা মানুষ এবং আলাদা মানসিক গঠন ও ব্যাক্তিত্ব নিয়ে জন্মায়। মিসেস মলির মেয়ে যা করে, মিসেস ডলির ছেলে তা করবে এমন কোন কথা নেই। অমুকের ছেলে মেহমান দেখলে কোলে ঝাপিয়ে পড়ে, আর আপনার শিশু নতুন মানুষ দেখলে কান্না করে-এতে এতো ভাবনার কিছু নেই।
যেটি করবার আছে-তা হলো সেই শিশুকে কিছুদিন-মাস অথবা বছর সময় দেয়া এটি বোঝার জন্য যে তার ভয়ের কিছু নেই। ছয়-সাত মাস বয়স থেকে শুরু করে দেড়-দুই বছর বয়স পর্যন্ত ‘সেপ্যারাশন অ্যাংজাইটি’ কম বেশী মাত্রায় থেকে থাকে, এর পর আস্তে আস্তে কেটে যায়।
লেখক: শিশু মনোবিদ
বহুমাত্রিক.কম