Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১০ ১৪৩১, বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪

শহীদ এম মনসুর আলী আমার পিতা আমার অহংকার

মোহাম্মদ নাসিম

প্রকাশিত: ১১:২৭, ৩ নভেম্বর ২০১৬

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

শহীদ এম মনসুর আলী আমার পিতা আমার অহংকার

ঢাকা : শহীদ এম মনসুর আলী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মহানায়ক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে চারজন জাতীয় নেতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম শহীদ এম মনসুর আলী। যিনি আমার গর্বিত পিতা এবং সর্বসময় সর্বমুহূর্তে আদর্শিক নেতা। যখনি আমি কোনো কাজ করি, চিন্তা করি, আমার চিন্তা-চেতনায় সব সময় আমার পিতার স্পর্শ আর আবেগ অনুভব করি।

তিনি যেমন জীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন, মরণেও আজকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই আছেন। আমার পিতা তাঁর পরিবারের বাইরে প্রতিটি মুহূর্ত বঙ্গবন্ধুর কথা ভাবতেন, বঙ্গবন্ধুর কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়া যেন তাঁর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মাঝে-মধ্যে আমার মনে হতো তিনি যেন আমাদের চাইতে বঙ্গবন্ধুকে বেশি ভালোবাসতেন। তিনি যখন রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছেন সেই মুহূর্ত থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছাড়া তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোনো কিছু করারই চিন্তা করতেন না।

আমি তাঁর সন্তান হিসেবে দেখেছি ৬ দফার আন্দোলনে যখন বঙ্গবন্ধুর অনেক সহকর্মী তাঁকে ত্যাগ করে চলে গেছেন, কারাবন্দি অবস্থা থেকেও আমার পিতা মনসুর আলী শত প্রলোভন ও চাপের মুখেও তখনকার পিডিএম পন্থি আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান, সালাম খানদের সঙ্গে যোগদান করেননি। দীর্ঘ কারাজীবন ভোগ করেছেন, কিন্তু নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে বেইমানি করেননি।

আমার পিতার দৃঢ় অভিব্যক্তি ও মনোভাবকে দেখেছি, ৬৬/৬৭ সালে যখন শহীদ এম মনসুর আলী পাবনা কারাগারে বন্দি ছিলেন আমিও ছাত্রাবস্থায় পিতার সঙ্গে সে মুহূর্তে একই কারাগারে আটক ছিলাম। দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম শেষে যখন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানে কারাগারে বন্দি তখন আমার পিতাসহ জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে মুজিবনগর সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দেন। সেই দুঃসাহসিক ও গৌরবময় মুহূর্তগুলো দেখার বা জানার সুযোগ হয়েছে। আমি দেখেছি সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে শহীদ এম মনসুর আলী কি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ মনোভাব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে আনতে এবং জীবিত বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং কাজ করে গেছেন।

খোন্দকার মোশতাকের মতো কজন সুযোগ সন্ধানী বিশ্বাসঘাতক ওই প্রবাসী মুজিবনগর সরকারে প্রতিমুহূর্তে চেষ্টা করেছে এই চারজনের মধ্যে ফাটল ধরাবার জন্য এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ করার নানারকম প্রলোভনের জাল বিস্তার করে মুজিবনগর নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য। কিন্তু একটি বিপদগ্রস্ত এবং জাতির যুগসন্ধিক্ষণে শহীদ এম মনসুর আলী অন্য তিন নেতার সঙ্গে থেকে সব ভয়-ভীতি, অনিশ্চয়তা এবং প্রলোভন উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করেছেন। সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে আমার পিতা মনসুর আলী এই ক’মাস অনন্যসাধারণ জীবন-যাপনের মধ্যদিয়ে মুজিবনগরের রণাঙ্গনে ছুটে বেরিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকেছেন। সাহস দিয়েছেন।

প্রবাসী সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে শত শত দলীয় সহকর্মী, দেশ থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার কর্মীকে আর্থিক সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। আমি দেখেছি হাজার অনিশ্চয়তা ও অমানিশার মধ্যেও সাধারণ বাঙালির চেয়েও দীর্ঘদেহী আমার পিতার উজ্জ্বল প্রত্যয়দীপ্ত মুখচ্ছবি। তিনি সর্বদা বলতেন, বাঙালি বিজয় অবশ্যম্ভাবী এবং জীবিত বঙ্গবন্ধুকে আমরা ইনশাল্লাহ মুক্ত করব। আসলে জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে মুজিবনগরে যে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব সংগঠিত হয়েছিল তা নিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করা যেতে পারে।

একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো গড়ে তোলা, চট্টগ্রাম ও খুলনা পোর্ট পুনরায় চালু করে কার্যকর বন্দরে পরিণত করা, সর্বোপরি এক নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, স্বাধীনতা বিরোধী এবং তথাকথিত হঠকারী বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী নামধারীদের অপতত্পরতা রোধ করে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করা ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। তবু তিনি দক্ষতার সঙ্গে সে সবের মোকাবিলা করেছেন।

আমার পিতাকে চিরদিনের জন্য হারানোর আগে মাত্র কয়েক ঘণ্টা তার সঙ্গে আমি ছিলাম। ১৫ আগস্টের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সে সময় তাঁকে দেখেছি কী উদ্বেগ এবং প্রচণ্ড বেদনা নিয়ে একদিকে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর কথা মনে করেছেন, অন্যদিকে প্রতিশোধ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে দলীয় সহকর্মী এবং তদানীন্তন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। শহীদ এম মনসুর আলী আত্মগোপন থাকা অবস্থায়ও চেষ্টা করেছেন নানাভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। কিন্তু কিছু সহকর্মীর ভীরুতা, আপোষকামিতা এবং জীবন রক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা, অন্যদিকে তখনকার সামরিক-বেসামারিক নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতা, চরম কাপুরুষতার কারণে শহীদ এম মনসুর আলী ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং হতাশ হয়েছিলেন। কিছু করতে না পারার বেদনায় তাঁর অশ্রুসিক্ত চেহারা আমি দেখেছিলাম। কিন্তু একটা জিনিস ধ্রুব তারার মতো সত্য, তিনি জীবন দিবেন কিন্তু অন্য অনেকের মতো বিশ্বাসঘাতকতা করে খোন্দকার মোশতাকের হাতে হাত মেলাবেন না, সেই দৃঢ় প্রত্যয় তাঁর মাঝে আমি দেখেছি।

যে কারণে তিনি মাথা উঁচু করে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের মুখের ওপর বলেছিলেন, তোমার মতো বেইমানের সঙ্গে আমি হাত মেলাব না। জীবন দেব, প্রধানমন্ত্রী হব না। তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন। শহীদ এম মনসুর আলী আপোষ করেননি, আত্মসমর্পণ করেননি, জীবনের ভয়ে মাথানত করেননি, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দি অবস্থায় ঘাতকের হাতে জীবন দিয়েছেন। ১৫ আগস্টের পরে বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক বিশ্বাসঘাতক-কাপুরুষের জন্ম হলেও চারজন মৃতুঞ্জয়ী নেতার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরদিন। যাঁরা জীবন দিয়েছেন, জাতির জনকের সঙ্গে বেইমানি করেননি তাঁদের মাঝে একজন আমার পিতা শহীদ এম মনুসর আলী, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।

আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমার পিতা শহীদ এম মনসুর আলী। যাঁকে আমি হারিয়েছি এর চেয়ে বড় বেদনা, এর চেয়ে বড় কষ্ট আমার জীবনে আর কিছু নেই। কিন্তু আমার জীবনে সবচেয়ে বড় গর্ব ও অহংকার হলো আমি খোন্দকার মোশতাকের মতো কোনো বেইমানের সন্তান নই, শহীদ এম মনসুর আলীর মতো একজন সাহসী মৃত্যুঞ্জয়ী পিতার সন্তান।

নেতা বা নেতার আদর্শের সঙ্গে বেইমানি নয়, বিশ্বাসঘাতকতা নয়, কোনো আপোষকামিতা নয়, আমার শহীদ পিতার এই আদর্শ ধরেই আমি কাজ করছি, কাজ করে যাব, ৩ নভেম্বরে শহীদ পিতার প্রতি এটাই আমার প্রত্যয়দীপ্ত শ্রদ্ধা।

লেখক : এমপি, মাননীয় মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য।

ইত্তেফাক এর সৌজন্যে

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer