Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

শরণার্থী সংকট: এক নয় একাত্তর আর সতের’র প্রেক্ষাপট

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ০২:৪৮, ১৪ অক্টোবর ২০১৭

আপডেট: ০৩:১৫, ১৪ অক্টোবর ২০১৭

প্রিন্ট:

শরণার্থী সংকট: এক নয় একাত্তর আর সতের’র প্রেক্ষাপট

ঢাকা : শরণার্থী কারা এবং কেন মানুষ শরণার্থী হয় তা একটু সচেতন মানুষ মাত্রেই আমরা জানি। বিভিন্ন সময়েই মানুষকে বিভিন্ন স্থানে নানা কারণে শরণার্থী নাম ধারণ করতে হতে পারে। তবে কোনো স্থানে যুদ্ধজনিত কারণে অশান্তি বা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সেখান থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। এরাই মূলত শরণার্থী নামে অভিহিত হয়ে থাকে। ঠিক এমনটি হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময়। আবার এখন একটি ঘটনা ঘটেছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে। সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে আগেরটি ছিল ’৭১ সালে, আর এবারের তা হলো ’১৭ সালে। কী অদ্ভুত এক মিল-অমিল! কারণ ৭১ কে উল্টালেই ১৭ হয়। একাত্তরের উল্টো ঘটনাই ঘটেছে সতেরতে এসে। 


যেভাবেই হোক না কেন শরণার্থী শখের বশে যে হয়না তা পরিষ্কারভাবেই বলা যেতে পারে। তা না হলে শতশত মাইল পথ পায়ে হেঁটে, সাগরে ভেসে, নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, সাঁতরিয়ে নদী পেরিয়ে, রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝার ভিতর দিয়ে অনেক কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে যেভাবে এসে সীমান্তে আশ্রয় নেয় সেখানে মানবতা দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে। আমরা যে যাই বলি না কেন যদি সত্যিকার অর্থেই আগতদের দেশে জীবন-মরণের ঝুঁকি না থাকত তাহলে কে তার জন্ম ভিটা, ঘর-বাড়ি, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, পরিচিতজনদের মুখ ভুলে এভাবে বানের জলের মতো অন্যদেশে অনিশ্চয়তায় পাড়ি জমাবে।

এখানে কথা উঠেছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির বিভিন্ন সময়ে শরণার্থী হওয়া এবং শরণার্থী ধারণের বিষয়টি নিয়ে। সে প্রসঙ্গে এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বিগত ২-৩ বছরে মিয়ানমার থেকে সাগরে ভাসিয়ে মালয়েশিয়াসহ ইউরোপ আমেরিকায় মানব পাচারের মতো মানবতা বিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়েছিল তখনকার মিয়ানমার প্রশাসন। শুধু তাই নয় রোহিঙ্গাদের অত্যাচার করে তাড়িয়ে দিয়ে প্রতিবারই মিয়ানমার সুকৌশলে বাংলাদেশের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করে থাকে। কারণ এবারো যখন লাখে লাখে রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে সীমান্তে ঢুকে পড়েছে তখনো তারা এ কথা স্বীকার করছে না।

যেকোন উন্নত রাষ্ট্রও তাদের দেশে হঠাৎ করে ঢুকে যাওয়া শরণার্থীকে সামাল দিতে পারে না। এর সপক্ষের একটি বড় উদাহরণ হলো গতবছর সিরিয়া এবং তুরস্কে আইএস জঙ্গিবাদের জন্য গৃহযুদ্ধের কারণে পুরো ইউরোপজুড়ে এক লাখ শরণার্থী হয়েছিল। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রগুলির অবস্থান হলো ইউরোপে। কিন্তু তারা কয়েকটি দেশ মিলেও একলাখ শরাণার্খী ধারণ করতে হিমশিম খেয়ে গেছে। তারপরও সেখানে সাগরে আয়লান কুর্দির মতো আবেগী একটি শিশুর ছবির সৃষ্টি হয়েছিল যা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও পুরো ইউরোপের উন্নত দেশসমূহে সেসব শরণার্থীদের স্থান হয়নি যা বিশ্ববাসী অবলোকন করেছিল।

এবার আসা যাক ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের দেশের রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও পাকিস্তানি অত্যাচারী আর্মিদের তা-বে আমাদের পার্শ্ববর্তী সীমান্তবর্তী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত তখন নয়মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। সেখানে ভারত যে তখন শুধু এককোটি বাঙালি শরণার্থীকেই আশ্রয় দিয়েছিল তাই নয় তাদেরকে খাইয়ে-পরিয়ে আদর যতেœ রক্ষা করেছিল যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তারপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীদেরকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েও সহায়তা করেছিল। তখনকার প্রেক্ষাপট ছিল অন্যরকম।

ভারত হলো পাকিস্তানের চিরশত্রু একটি রাষ্ট্র। কাজেই ভারত একদিকে মানবিক কারণে বাংলাদেশকে সহযোগিতা শুরু করে এবং অপরদিকে মানবিক ও কৌশলগত কারণেই ভারত চেয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর মতো সৎপ্রতিবেশি সুলভ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সৃষ্টিকারী নেতৃত্বের আহবান তো ছিলই। সেখানে দুটি দেশের সুসম্পর্কের মধ্যেই পারষ্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই বাঙালিরা যেমন শরণার্থী হয়েছে এবং পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন নয়মাস ভারত সেখানে শরণার্থী গ্রহণ করেছে। সেভাবে যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ যেমন করে শরণার্থীদের কোনরকম শর্ত ছাড়াই ফিরিয়ে নিয়েছিল। অপরদিকে ভারতও তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় থাকা ভারতীয় মিত্র সেনাবাহিনীকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু মিয়ানমার বাংলাদেশের শরণার্থীর বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে শরণার্থী আগমন শুধু একবারই ঘটছে বিষয়টি আসলে তা নয়। বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে এ শরণার্থী শরণার্থী খেলা চলছে বিগত প্রায় তিরিশ বছর যাবৎ। যখনই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কোন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয় তখনই সেখানকার মুসলমান রোহিঙ্গাদের টার্গেটে পরিণত করা হয়। সেখানে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সেনাশাসন চলমান। কারণে অকারণে কথায় কথায় তাই রোহিঙ্গাদের উপর বিভিন্ন অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয়। আর যখনই অত্যাচার নির্যাতন চলে তখনই তারা শরণার্থী হয় পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে।

যখন অত্যাচারিত হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে থাকে তখন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদেরকে বাঙালি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। অবশ্য তার একটি কারণও তারা খোঁজে বের করেছেন। আর সেটি হলো রোহিঙ্গাদের কথ্য ভাষাটি অনেকটা কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের কথ্যভাষার সাথে মিল রয়েছে। অথচ এভাবে বিগত তিরিশ বছরে মিয়ানমার নানা অজুহাতে প্রায় পাঁচলক্ষ রোহিঙ্গাকে শরণার্থী হিসেবে ঢুকিয়ে রেখেছে। যে সময়ে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ সীমান্তজুড়ে সেসব রোহিঙ্গা শরণার্থীরাই মানবেতর জীবন যাপন করছে সেখানে এবারে বিগত এক মাসে আরো প্রায় পাঁচ লক্ষ রোহিঙ্গাকে শরণার্থী হিসেবে ঢুকিয়ে দিয়েছে তারা। সেখানে ইতিপূর্বে গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে পরিচিত হয়ে বিশ্বশান্তির জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন মিসেস অং সান সুচি। তিনি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কোন মানবতা বিরোধী কাজ হয়ছে বলে স্বীকার করেননি। সেইসাথে রাখাইনে সেনাবাহিনীর সাথে মুসলমান জঙ্গিদের সংঘর্ষের কারণে কোন রোহিঙ্গার দেশ ছেড়ে থাকেন তবে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার শর্তে ফেরত নেওয়ার বিষয়ে কৌশলপূর্ণ জবাব দিয়েছেন।

অথচ এমনিতেই দেশে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ষড়যন্ত্রমূলক আনাগোনা, দুটি বড় বন্যা ইত্যাদি কারণে যখন সরকার অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত অগ্রসরমান দেশের সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে কাজ করে চলেছেন সেটিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে এসব রোহিঙ্গা শরণার্থী। আর সেকারণেই বাংলাদেশের মানবিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি নিজেই এদের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাছাড়া তিনি এ বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি সর্বশেষ জাতিসংঘের ৭২তম সাধারণ পরিষদকে বেছে নিয়েছেন। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা সমস্যা সমধানের পাঁচদফা প্রস্তাবও দিয়েছেন যা সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আমাদেও দেশের আশ্রয় নেওয়া দশলাখ শরণার্থীকে খাইয়ে পড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখতে বাজেটের প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে। কাজেই ’৭১ আর ’১৭ এর প্রেক্ষাপট এক নয়।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

email: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer