খুলনা : পণ্য বিক্রি করতে পারলেই মুনাফা। দু’দশ টাকা নয়, হাজার হাজার টাকা। লেখাপড়া করছো করো, লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করবেতো; চাকরি পাবে কোথায়? চাকুরি পেতেও টাকা লাগে। এ না করে বন্ধু জোগাড় করো, পণ্য বিক্রি করো। নিজের নাম তালিকাভুক্ত করতে কিছু টাকা প্রয়োজন হবে; এরপর শুধুই মুনাফা। লাভ আর লাভ। মাসে কয়েক লাখ টাকাও আয় করতে পারবে। এমনি লোভের ফাঁদে ফেলে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে।
লোভ দেখানোরা শুধুমাত্র টাকার লোভই দেখায় না; সেই সাথে আছে দেশের মধ্যে ভ্রমণসহ নেপাল, ভারত, ভুটান, থাইল্যান্ড, হংকং ভ্রমণের সুযোগ। যাতায়াতের সুবিধার্থে ১৫০ সিসির পালসার মোটর সাইকেল, ১৫০০ সিসির প্রাইভেট কার। বসবাসের জন্য দেয়া হবে দেশের যে কোন স্থানে পছন্দসই ফ্লাট বাড়ি। থাকছে কোম্পানীর শেয়ার হোল্ডার হওয়ার সুযোগ।
এসব কথা বলছে ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ নামের একটি পণ্য বিণননকারী সংস্থা। এর সদস্য হতে একজনকে দিতে হয় ৪২৫০ টাকা। সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যে পাতা হয় প্রেমের ফাঁদ, ফেসবুকে বন্ধুত্ব, ব্যক্তিগত পরিচিতি, একজনকে দিয়ে আর একজনকে উদ্বুদ্ধ করা। খুলনায় প্রতিষ্ঠানটির সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। এভাবেই কোম্পানীটি লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
বিভিন্ন জনের সাথে আলাপকালে জানা যায়, এই এমএলএম কোম্পানীটির ৬টি স্টার পদ্ধতিতে সার্ভিস দিতে হয়। ওয়ান স্টার ধারী একজন সদস্য মোট সদস্য থাকতে হয় ১০০ জনের। একশত জন সদস্য থাকলে তিনি প্রতিমাসে বেতন পাবেন ৩ হাজার টাকা আর বোনাস পাবেন ১৮ হাজার টাকা। এভাবে যতলোক নিতে সক্ষম হবে তত টাকা। যত লোক তত র্যাঙ্ক।
মিশন২১ লোকজনের সাথে আলাপকালে জানা যায়, খুলনা অফিসের কর্মকর্তার অধিনে প্রায় ১৭ হাজার কর্মী রয়েছে। তার বেতন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এরা টাকা আয়ের আশায় এখানে আগত শিক্ষার্থীদেও বলেন, তুমি অর্থনীতিবিদ হতে চাও নাকি অর্থেও মালিক হতে চাও। অর্থের মালিক হতে হলে আমাদেও সাথে যুক্ত হও। তুমি লেখা পড়া শিখে খুব ভাল একটা চাকরী পেলে তোমার বেতন হবে সব্বোর্চ্চ ৭০ হাজার টাকা। কিন্তু তুমি যদি আমাদেও সাথে যুক্ত হও এবং মাত্র ১ বছর সময় দাও তাহলে এর থেকে অনেক বেশি টাকা আয় করতে পারবে।
ওয়ার্ল্ড মিশনে চাকরির সন্ধানে যাওয়া খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাইয়েমুর রহমান তাইম বলেন, বুধবার দুপুরের দিকে খুলনা নগরীর শিববাড়ি মোড়ের অদুরে তাদের অফিসে যাই। ওই ভবনের ৩য় তলায় একটি ফ্লোরে গিয়ে দেখতে পাই প্রায় শতাধিক কম বয়সের ছেলে মেয়ে। আর ৫/৭জন বয়স্ক লোক। বেশ কয়েকটা (আনুমানিক ২৫ টি) ডেস্ক রয়েছে যেখানে শিক্ষার্থীদের ব্যবসা সম্পর্কে বোঝানো হচ্ছে। আমি কাজ করতে আগ্রহী এ কথা বলার পর আমাকে একটি ডেস্কে বসিয়ে দেয়া হয়। আমাকে বলা হয় এখানে তুমি যুক্ত হও লেখাপড়ার পাশাপাশি মাসে অর্ধ লক্ষ টাকা আয় করতে পারবে। তবে তারা বলে টাকা দিবে কিন্তু বাড়িতে বলবে না। বাড়িতে বললে বাবা মা টাকা দেবে না। তারা নানান কথা বলবে। উল্টা বলবে তোমাকে লেখাপড়া বাদ দিয়ে ব্যবসা করতে হবে না। লেখাপড়ার খরচ আমরা দেব। তাইম আরও জানায়, সেখানে আপ্যায়ন করা হয়।
ওর্য়াল্ড মিশন২১ এর কর্মী তাজিন আহমেদ তাজিনের সাথে কথা বলে জানা যায়, সে ডুমুরিয়া উপজেলার শাহপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। তার স্কুলের শিক্ষক পলাশ কর্মকারের মাধ্যমে এদের সাথে যুক্ত হই। তাজিন জানায়, ৫ হাজার ৫০০ টাকা টাকার পণ্য কিনে এর সাথে যুক্ত হই। তিন মাস আগে যুক্ত হয়ে এ যাবত ৮ হাজার টাকার মত আয় করেছি। এছাড়া আমি আরও ২০জনের মত সদস্য বানিয়েছি। সদস্য অর্šÍভূক্তির জন্য প্রতিজনে ৫০০ টাকা কমিশন পেয়েছি। ওয়ান স্টার, দু স্টার এভাবে ৬টি পদ্ধতিতে এখানে পদোন্নতিতে হয়।
ওয়ান স্টারের ক্যাটাগরির একজন প্রতিনিধির কমপক্ষে ১০০ সদস্য করতে হয়। আর প্রতিজনের কাজের উপর সে কমিশন পায়। তাজিন এ যাবত প্রশিক্ষণ নিয়েছে ১০টির মত। প্রতিটি প্রশিক্ষণে তাকে নির্দিষ্ট হারে টাকা দিতে হয়েছে। তাজিন জানায় অনেক চাকরীজীবীও বাড়তি আয়ের জন্য ওর্য়াল্ড মিশনে কাজ করে।
নগরীর বৈকালী এলাকার ম্যানগ্রোভ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী সুজন মুন্সী জানান, মাস খানেক আগে এক বন্ধুর মাধ্যমে এখানে আসি। তাদেও কথা শুনে ভাল লাগে। তারা আমাকে অনেক আপ্যায়ন করে। আমি বাড়িতে কলেজে টাকা লাগবে বলে ৪ হাজার টাকা নিই। তার মধ্য থেকে ৩ হাজার ৭৫০টাকা দিয়ে এখানকার সদস্য হই। আমাকে একটি ডায়েরি ও একটি কলম দেয়া হয়। আমি এ যাবত কোন টাকা পায়নি। তাই আর যাই না।
খুলনা বিএল কলেজের জীব বিজ্ঞান সম্মান শ্রেণির ১ম বর্ষের ছাত্র মো: জাকারিয়া হোসেন বলেন, তার এক বান্ধবী আনিসার মাধ্যমে ওর্য়াল্ড মিশনে আসি। ৪০৭৫ টাকা দিয়ে সদস্য হওয়ার কথা বলে। এখানকার পন্য কিনে তা বিক্রি কওে লাভ করা যাবে। তাছাড়া সদস্য ভর্তি করতে পারলে সদস্য প্রতি কমিশনও পাওয়া যাবে। যত বিক্রি তত লাভ আর যত সদস্য তত কমিশন। তিনি বলেন, এখানকার লোকজন আমাকে মোবাইল ফোনে একটি ভিডিও দেখায় । ওই ভিডিওতে দেখানো হয় ওর্য়াল্ড মিশন২১ এর কার্যক্রম সংসদে পাশ হয়েছে। এবং এর কার্যক্রম ও পণ্য বুয়েট থেকেও পাশ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, তাদেও কথা শুনে ভাল লাগেনি তাই সদস্য হয়নি। তিনি বলেন, তাদেও অফিসের ৩য় তলায় অফিস ও সেমিনার কক্ষ। আর প্রথম তলায় পণ্যেও শো রুম। তবে শো রুমে কয়েকটি ফ্রিজ, রাইস কুকার পন্য রয়েছে। তবে মোবাইলে তাদেও অনেক পণ্য রয়েছে বলে বইতে দেখান কর্মকর্তারা।
খুলনার মহিলা কারিগরী একটি কলেজের ১ম সেমিষ্টারের জনৈক ছাত্রী বলেন, তার এক ফেসবুক বন্ধুর মাধ্যমে ওর্য়াল্ড মিশন২১ এর খবর পাই। আমার বন্ধুটি সেখানে কাজ কওে দীর্ঘদিন যাবত। সে আমাকে জানায়, তার মাসে অনেক টাকা আয় হয়। ছাত্রীটি বলে বাড়ি থেকে মাসে যে পরিমাণ টাকা দেয় তাতে কলেজের খরচ, কোর্চি ফি, ম্যাচের ফিসসহ আনুসঙ্গিক খরচ চালান সম্ভব হয় না। তাই বাড়তি আয়ের জন্য এদেও ব্যবসার সাথে যুক্ত হই।
সে জানায়, ওই বন্ধুর মাধ্যমে ৪২৫০ টাকা দিয়েছি। প্রতিদিন আমাকে ওই অফিসে যেতে হয়। ২ ঘন্টা কাজ করি। তিনি জানান, গত ২ সপ্তাহ আগে এদের সাথে যুক্ত হয়েছি। এখনও কোন টাকা পায়নি। বাড়িতে কেউ জানে না। কলেজে টাকা লাগবে বলে নিয়েছি। আমার এখান থেকে সওে আসার সুযোগ নেই। কারণ আমিতো পূজি বিনিয়োগ করে ফেলেছি।
এ বিষয়ে খুলনার এ কোম্পানির খালিদ এ্যন্ড এসোসিয়েটসের এক কর্মী বলেন, সরকার আমাদের অনুমতি দিয়েছে। জাতীয় সংসদে এমএলএম কোম্পানীর ব্যবসা পরিচঅরনা সংক্রান্ত আইনও পাশ হয়েছে। তাছাড়া আমার কাউকে ঠকাচ্ছি না। পণ্য বিক্রি করছি। আর এখানে যারা যুক্ত হচ্ছে তারা পণ্য বিক্রি করেই লাভবান হবেন।
খুলনা জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান বলেন, যাদের বয়স ১৮ বছরের কম তাদেরকে কোন অবস্থাতেই কাজে নিয়োজিত করা যাবে না। মাল্টিলেভেল কোম্পানির ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি করে থাকে। তিনি বলেন, মিশন২১ নামে এমএলএম কোম্পানির কার্যক্রম সম্পর্কে খোজ খবর নিযে তাদের বেআইনী তৎপরতা বন্ধের আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
বহুমাত্রিক.কম