Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৯ ১৪৩১, মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪

লাউয়াছড়ায় প্রাণিকূলের মৃত্যুর শেষ কোথায়?

নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

লাউয়াছড়ায় প্রাণিকূলের মৃত্যুর শেষ কোথায়?

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

মৌলভীবাজার : জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়ে বাংলাদেশের সমৃদ্ধতম বনগুলোর একটি হচ্ছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। আয়তনের দিক দিয়ে ছোট হলেও এ বনে দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। বিরল প্রজাতির প্রাণির সংমিশ্রণে উদ্যানটি জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব বহন করলেও বনের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত রেললাইন, সড়কপথ ও বৈদ্যুতিক লাইনে বন্যপ্রাণির মৃত্যু হার বেড়েই চলেছে। এই বনকে ঘিরে নানাবিধ কার্যক্রমে বনের অবক্ষয় ঘটছে ও অতিষ্ঠ হচ্ছে প্রাণিকূল। খাবার ও বাসস্থান সংকট, প্রাণি চলাচলের করিডোর বিলুপ্তি, অব্যাহতহারে বন্যপ্রাণির মৃত্যু সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, লাউয়াছড়া উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য বিখ্যাত এ বনে নানা প্রজাতির সরীসৃপ এর ভেতর অনন্য হচ্ছে অজগর। মাগুরছড়া ঘেষা লাউয়াছড়া একটি জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বন শতবছর ধরে বৃক্ষ লতাদি গুল্ম বেড়ে উঠা বিচিত্র বহু বর্ণের বন্য লতাগুল্ম, অর্কিড, পরগাছার নিবিড় সান্নিধ্যে মায়ামৃগ, ভাল্লুক, উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান, চশমা পড়া বানর, চিতাবাঘ, মথুরা, বুনোমুরগী, ধানেশ, অজগর, দাঁড়াস, কেউটে, সুতানলী, ব্যাঙ গিরকিট, তক্ষক, পেঁচা আর নাম না জানা হাজারো কীট-পতঙ্গ যার একটি বৃহদ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৯৯৭ সনে মাগুরছড়া দুর্ঘটনার দাবানলে। শ্লথ-গতি জীব-জানোয়ার কীটপতঙ্গ জ্বলে পুড়ে মাটি চাপা পড়ে কিংবা বিরূপ পরিবেশে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অনেকেই।

ইউএসআইডি’র অর্থায়নে নিসর্গ প্রকল্পের অধীনে লাউয়াছড়া বনের রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার কাজে স্থানীয় জনগনকে সম্পৃক্ত করে নিসর্গ প্রকল্পের আওতায় উদ্যানে প্রকৃতি ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে মাত্রাতিরিক্ত পর্যটকের আমগন, হাল্লা-চিৎকার গোটা পরিবেশকে ভারী করে তোলছে। বনে খাদ্য সংকটের কারনে লোকালয়ে বানরসহ বিভিন্ন প্রাণি বেরিয়ে ফসলি জমিতে হানা দেয়ার ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের ফলে লতাম, গুল্ম, বহু উদ্ভিদ এবং বিভিন্ন কীট-পতঙ্গ ও ছোট প্রাণী হারিয়ে যাওয়ায় এখন পর্যন্ত বড় বড় প্রাণীগুলোকে খাবার সংকটে ভুগতে হচ্ছে। ফলে এগুলো বনে না থেকে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে গিয়ে ধরা পড়ছে।

২০০৫ সালে মার্কিন কোম্পানি ইউনোকল বন্যপ্রাণি আইন অমান্য করে জাতীয় উদ্যানের মাঝ দিয়ে গ্যাস পাইপ লাইন বসিয়েছে। ২০০৮ সালে উদ্যানের ভেতর শেভরন ভূত্তাত্ত্বিক জরিপ কাজ চালানোর সময় বন্যপ্রাণী সমূহের দিগবিদ্ধিক ছোটাছুটি শুরু করে। এ পর্যন্ত যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে তা আজোবধি কোন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানী কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। বিভিন্ন সময়ে গাছ চোর চক্রের কারণে বনের মারাত্মক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। এক টুকরো এই বনের চর্তুপার্শ্বে জঙ্গল সংস্কার, টিলাকাটা, কৃষি আবাদ, হোটেল, কটেজ নির্মাণ এসব অপতৎপরতা বন্যপ্রাণির ক্ষতি বয়ে আনছে।

এ বনের মাঝদিয়ে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত প্রায় ৮ কিলোমিটার রেলপথ ছাড়াও সড়কপথ আর বৈদ্যুতিক লাইনের বদৌলতে বন্যপ্রাণি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অপুরণীয় ক্ষতি বয়ে আনছে। ফিবছর বনের রেললাইন ও সড়ক পারাপার হতে অজ¯্র প্রাণি রেলে কাটা বা গাড়ির নিচে চাপা পড়ে এবং বৈদ্যুতিক লাইনে পৃষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে।

লাউয়াছড়ায় সাপ নিয়ে গবেষণা করতে আসা সরিসৃপ গবেষক শাহরিয়ার সিজার জানান, তার দেখা মেলা ৩৫ প্রজাতির মধ্যে ১৪ প্রজাতির সাপই গাড়ি চাপায় মৃতাবস্থায় সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর সনাক্তকৃত বাংলাদেশে প্রথম আবিষ্কৃৃত বেন্ডেড টিংকেট ও ইরিডিসেন্ট সাপ দু’টিও মৃতবস্থায় পাওয়া যায়। শাহরিয়ার সিজারের তথ্য মতে, ২০১৩ সনে এক বছরে লাউয়াছড়ায় ৭শত সাপ মারা গেছে এবং এর অধিকাংশই জানকিছড়া এলাকায়। ২০১৬ সনের সেপ্টেম্বর মাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরাফাত নামে এক ছাত্র লাউয়াছড়ায় সার্ভে করার এক মাসের মধ্যে ব্যঙ ও সাপের ৫৬টি মৃত দেহ পান।

বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য মতে ২০১৬ সনে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৪৪টি ব্যঙ ও সাপ এবং ৫টি হরিণ মারা যায়। এর মধ্যে রেলপথে ২টি, সড়ক পথে ২টি আর স্বাভাবিকভাবে ১টি হরিণের মৃত্যু হয়। বিভিন্ন সময়ে জাতীয় উদ্যানের সড়ক পথে লজ্জাবতি বানর, সিভিট কার্ট, গন্ধগোকুল, চশমাপড়া হনুমান, লিজার্ড, শিয়াল, বনবিড়াল, দাঁড়াস, গিন্নিসাপ, ফিটভাইভার মারা গেছে। রেলপথে হরিণ, অজগর, বন্যশূকর, লিজার্ড, শংখী, দাঁড়াস, অজ¯্র ব্যঙ মারা গেছে। বৈদ্যুতিক লাইনেও পৃষ্ট বানরসহ বিভিন্ন প্রাণির মৃত্যু ঘটেছে।

নানা সময়ে গাছ চুরি হওয়ায় পূর্বের তোলনায় বর্তমান সময়ে লাউয়াছড়ায় বনজঙ্গল ও খাবার কমে যাওয়ায় বন্যপ্রাণি ঘন ঘন রেলপথ ও রাস্তা পারাপার হচ্ছে। বাসস্থান ও আবাসস্থল বিলুপ্ত, বন্যপ্রাণির করিডোর বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব কারণে রেল ও সড়কপথ অতিক্রমের সময় ট্রেন কিংবা যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণি মারা যাচ্ছে।

বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় সহকারী বন কর্মকর্তা মোঃ তবিবুর রহমান বলেন, রেল ও সড়কপথে কাটা পড়ে প্রাণি মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। এই বনের চর্তুপার্শ্বে জঙ্গল সংস্কার, টিলাকাটাসহ নানা তৎপরতার কারনেও বন্যপ্রাণির ক্ষতি বয়ে আনছে।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer