Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১৩:৪৫, ২৩ নভেম্বর ২০১৭

আপডেট: ১৩:৫৩, ২৩ নভেম্বর ২০১৭

প্রিন্ট:

রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল যেন থামছেই না। বরং মাঝে-মধ্যেই কয়েকদিনের বিরতিতে আবারো পুরোদমে দলে দলে ছুটে আসছে। পূর্বের সংখ্যার সাথে যুক্ত হয়ে এ সংখ্যা এখন দশ লক্ষাধিক ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস, এভাবে চলতে থাকলে তা কোথায় এসে ঠেকবে তা বলা মুশকিল। একদিকে কূটনৈতিক তৎপরতা অপরদিকে ষড়যন্ত্র- দুটিই যেন একে অপরের হাত ধরে চলছে। এতে বন-জঙ্গল ধ্বংস হচ্ছে, বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা এবং সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের। আর অর্থনীতির যে বিরাট সমস্যা হচ্ছে সেটাই আজকের প্রবন্ধের মূল আলোচনার বিষয়বস্তু।

স্বাধীনতার পর থেকে অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে বাংলাদেশের বর্তমানে অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি একটি জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের মাথাপিছু আয় প্রায় দেড় হাজার মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। জিডিপিতে সকল উন্নয়ন সূচকই উর্ধ্বমুখী। অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে চলেছে এবং ঈর্ষণীয়ভাবে তা এখন সাতের উপরে। অদূর ভবিষ্যতে অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন যে স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে তার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে তাতে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির বছর রূপকল্প-২০২১ তে এসে তা ডাবল ডিজিটে চলে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরোও স্বপ্ন দেখছেন। তারপরে চলমান সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও এমনি ইঙ্গিত রয়েছে। এরপরে এসডিজি-২০৩০ এবং ভিশন-২০৪১ তো রয়েছেই। তাছাড়া সর্বশেষ হিসাবে বর্তমানে দেশের মাথাপিছু আয় আরেক দফা বেড়ে তা এখন ১৬১০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

তার মানে হলো বর্তমান সরকারের অনুমিত ও পরিকল্পিত রূপকল্প অনুসারে আমাদের দেশ বিশ্বের অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হবে যা সরাসরি একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তবে শর্ত থাকে সেই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিকতা। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, দেশের প্রতিটি সেক্টরে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ্য করে থাকব বাংলাদেশের এসব উন্নয়নের জন্য শুভাকাক্সক্ষীরা উৎসাহ দিচ্ছে কিন্তু নিন্দুকেরা চায় পিছনে টেনে ধরতে। তারা সবসময়ই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে কীভাবে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় উন্নয়ন অগ্রযাত্রার লাগাম টেনে ধরে রাখা যায়। সেসব ষড়যন্ত্রের কোনটা ঘটে পর্দার সামনে আবার কোনটা ঘটে পর্দার অন্তরালে।

তেমনি একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে নিয়ে। কথা উঠেছে বাংলাদেশের বর্তমানে ষোলোকোটি মানুষের সাথে মিয়ানমার থেকে আসা দশলাখ শরণার্থীকে খাইয়ে পড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখা বাংলাদেশের সরকার এবং মানুষের জন্য খুব কঠিন কাজ নয়। কিন্তু সমস্যা হলো তারা কী খেল কী পড়ল সেটা নিয়ে নয়। তাদের এখানে থাকার সাথে বিরাট অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ জড়িয়ে রয়েছে। শরণার্থীরা সমস্যায় পড়েই হয়তো সীমান্তের এপাড়ে আমাদের বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে এসেছে। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের কোমলমতি মানবিক প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে আশ্রয়ের সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালে আমাদের প্রতিবেশি ভারতে এমনি একটি পরিস্থিতিতে প্রচুর মানুষকে শরণার্থী হতে হয়েছিল। কিন্তু তখনকার প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশ-ভারত আবার মিয়ানমার-বাংলাদেশ পরিস্থিতি মোটেও এক নয়।

এখন হয়তো দেশের অভ্যন্তরে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে যেহেতু কিছু না কিছু বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সেটা যে খুবই অপ্রতুল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ ইতোমধ্যে অর্থনৈতিকভাবে প্রাথমিক সমীক্ষায় দেখা গেছে এভাবে রোহিঙ্গাদের ঢল আসতে থাকলে তাদের শুধুমাত্র খোরাকির জন্য বছরে প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। কিন্তু সেটা কতদিন থাকবে তা এখনো বলা যাচ্ছেনা। যদিওবা সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে যে মিয়ানমার শরণার্থীদেরকে আগামী সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু বাস্তবতা এবং পূর্বাভিজ্ঞতা কোনটাই সুখকর নয়। কাজে যদি বছরের পর বছর তারা সেখানে অবস্থান করতে থাকে তাহলে তাদের জন্য বছরে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হবে তা সম্পূর্ণভাবে অনুৎপাদনশীল খাতে।

তারা কক্সবাজারের মতো পর্যটন এলাকায় থেকে সেখানকার পরিবেশ পরিস্থিতিকে দিনকে দিন নষ্ট করে তুলছে যা পর্যটন নগরী হিসেবে কক্সবাজারের সৌন্দর্য প্রতিনিয়ত নষ্ট করছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সাম্প্রতিক চালু হওয়া মেরিন ড্রাইভ। এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সন্তুষ্টির কথা বলতে পারি। এ বছরেরই (২০১৭) জুলাই মাসে সপরিবারে আমি কক্সবাজারে গিয়ে সেখানকার বিপুল পর্যটন সম্ভাবনাময় মেরিন ড্রাইভ দেখে এসেছি। সেখানে ৮০ কিলোমিটারের একটি রাস্তা হয়েছে মাত্র, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক মাস পূর্বে উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু সেই রাস্তাকে কেন্দ্র করে চারিদিকে হোটেল মোটেল, আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট ইত্যাদি তৈরী করে কয়েক বছরের মধ্যেই সেই মেরিন ড্রাইভকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক আয়ের ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়।

কিন্তু এখন সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীর আশ্রয়ের কারণে সেই বিপুল সম্ভাবনাময় মেরিন ড্রাইভ তার কতটুকু সফল হতে পারবে সেটা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ মেরিন ড্রাইভের পাশের পাহাড়গুলোর গা ঘেঁষেই তৈরী হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প ও আবাসস্থল। যদিও অস্থায়ী বলা হচ্ছে সেটি কী আসলেই অস্থায়ী হয় নাকি কতদিন স্থায়ী হবে তা কেউই বলতে পারবে না। রোহিঙ্গাদেরকে নিয়ে যেসব চিন্তা করা যায় তার সবটুকুই শুধু মানবিকভাবে করলে চলবেনা। কারণ এদের সাথে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িয়ে রয়েছে যা আমরা কোনভাবেই ফেলে দিতে পারিনা। সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে সাথে চলে আসছে কিছু কিছু মহামারী রোগবালাই। আতঙ্কের সাথে জানা গেছে আগত বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইতোমধ্যে ১২৭ জন নারী পুরুষ ও শিশু রয়েছে যাদের শরীরে মরণব্যাধি এইডসের জীবাণু।

আমরা জানি, রোহিঙ্গাদের সেদেশ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে তাড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম কারণ হলো সেখানে তারা সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কর্মকা-ে লিপ্ত রয়েছে। সেটি পুরোপুরি সত্য না হলেও তার আংশিক সত্যতা রয়েছে। আর সেকারণেই সেখান থেকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের সাথে সাথে সেখানকার জঙ্গি ও সন্ত্রাসী নেতারাও আমাদের দেশে এসে এ সুযোগে আশ্রয় নিচ্ছে। আর আমরা এও দেখতে পাচ্ছি তাদেরকে অর্থ ও খাদ্যের লোভ দেখিয়ে আমাদের দেশের জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা তাদেও কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে এবং কেউকেউ ব্যবহৃত হচ্ছেও। তারা আবা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি কেউ কেউ বাংলাদেশের একশ্রেণির দালালদের সহায়তায় পাসপোর্ট তৈরী বাংলাদেশের নাম ভাঙ্গিয়ে বিদেশে গিয়েও সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে।

ইতিপূর্বে যারা রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে সেখানে বসবাস করছে তারা সুযোগ বা ফাঁক পেলেই সেকাজ করে বেড়াচ্ছে। অনেক সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এ সুযোগে চোরাকারবারীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়া। এ চোরাকারবারীদের মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে মরণ নেশা ইয়াবা, বার্মিজ বিভিন্ন অবৈধ জিনিসপত্র অপরদিকে রয়েছে মানব পাচার, দালালদের দৌরাত্ম্য ইত্যাদি। সেসব করে প্রচুর দেশীয় মুদ্রা লুণ্ঠন করে চলেছে। এতে সার্বিক অর্থনীতি টান পড়ছে। আমরা বিগত অনেক বছর থেকে বিশেষত আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলগুলোতে দেশে কোন খাদ্য ঘাটতি হতে দেখা যায়নি। উপরন্তু কয়েক বছর আমরা খাদ্য কিছুটা হলেও রপ্তানি করে দেখাতে পেরেছি। নেপালের ভূমিকম্পে আমরা খাদ্য সাহায্যও পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলাম।

কিন্তু এবছর দেশের অব্যাহতভাবে কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষত দেশের অন্যতম ধান ও মাছের ভা-ারখ্যাত হাওর এলাকায় বন্যার আঘাত, পরে জুলাই আগস্টে দেশের উত্তরাঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলের বন্যার ক্ষয়ক্ষতির প্রকোপ কাটাতে এবছর বিশ লক্ষটন টন খাবার বিদেশ হতে আমদানির প্রয়োজন হয়েছে। তারউপর মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে বানের জলের মতোই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল। এরই মধ্যে ২৫ আগস্ট ২০১৭ থেকে অক্টোবরের শেষ নাগাদ তাদেরকে অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান দেওয়ার মতো প্রধান প্রধান মৌলিক চাহিদা মেটানো হচ্ছে। যে কারণে দেশ-বিদেশে সরকার ও দেশের প্রশংসা শোনা যাচ্ছে চারদিকে। এমনকি এ সমস্যাটির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ দেখানোর জন্য বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নামও এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কারের খাতায় উচ্চারিত হয়েছে। তাঁকে দেওয়া হয়েছে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাব।

এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভরনপোষণসহ তাদের পিছনে যে পরিমাণ অর্থ বাৎসরিক ব্যয় হতে চলেছে এতে করে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা এভাবে আমাদের সামমের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়না। আর এক্ষেত্রে বিশেষ করে আমাদের অন্যান্য সৎ প্রতিবেশি এবং দীর্ঘদিনের মিত্ররা যদি সকল ষড়যন্ত্রেকে পিছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা না করে তবে আমাদের সামনের দিনগুলোতে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হবে বৈকি! সেখানে চীন, ভারত, রাশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম ও অমুসলিম দেশসমূহ শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এবং দেশের সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভূয়ষী প্রশংসা করেছে যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

তবে সেখানে একটি বিষয় খুব ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে যে, দেশগুলো সত্যিকার অর্থেই কার্যকরভাবে আমাদের সাথে আছে নাকি আমাদের অগ্রসরমান ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে শ্লথ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। যদি দ্বিতীয়টি হয় সেখানে আমাদের মানবতার পাশাপাশি দেশের এবং দেশের নিরাপত্তা তথা আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ আমাদের দেশের অর্থনীতির এ অগ্রযাত্রা অর্জনে আমরা যে কৌশল আয়ত্ত করে ফেলেছি তা যেভাবেই হোক না কেন ধরে রাখতে হবেই। তাতেই আমাদের দেশের অর্থনীতি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে। আর আমাদের দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সেটাই প্রত্যাশা।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

email: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer