Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

রোমাঞ্চকর দার্জিলিং ভ্রমণ : বন-পাহাড়ের এক স্বপ্নপুরী

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১৩:১৫, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আপডেট: ১৩:১৮, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

প্রিন্ট:

রোমাঞ্চকর দার্জিলিং ভ্রমণ : বন-পাহাড়ের এক স্বপ্নপুরী

ছবি: ইন্টারনেট

এক.
অনেক কষ্টের পর একবার যেহেতু ছয় মাসের জন্য ভারতীয় ভিসা নামক সোনার হরিণ পেলাম, সেজন্য মেয়াদের ভিতরেই আরেকবার সেখানে বেড়াতে যাওয়ার লোভ আর সামলাতে পারলাম না। আমার পরিবার তো একেবারে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে আবারো বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দিতেই। অবশ্য আমার স্ত্রী সন্তোনেরাই এর প্রধান প্রস্তাবক ও উদ্যোক্তা ছিল। কারণ মাত্র কিছু দিন আগেই বড় বড় জায়গা দেখে তাদের আগ্রহ তখনও সমুজ্জ্বল ছিল। এমনিতেই ভারতীয় ভিসা পেতে অনেক কঠিন, আর তাছাড়া বারবার তো আর ভিসা করা যাবে না। অপরদিকে আস্তে আস্তে দিনে দিনে বাচ্চাদের স্কুলের লেখাপড়া আরো গুরুত্ব বাড়তে থাকবে। তখন শত ইচ্ছা থাকলেও সবাই একসাথে মিলিয়ে যাওয়াটা বেশ কঠিন। কাজেই পরিবারের সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আমরা ভারতে আবার দ্বিতীয়বারের মতো বেড়াতে যাব। তবে এবারের ভ্রমণ হবে শুধুমাত্র ভারতের অন্যতম পাহাড়কন্যা দার্জিলিংয়ে।

যেই কথা সেই কাজ, বেরিয়ে পড়লাম বেড়াতে। যেহেতু একবার ভারতে বেড়ানো হয়ে গেছে কাজেই সেখানে যাওয়ার বিষয়টি অনেকটা ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা যাওয়ার মতো মনে হল। কারণ একবার বেড়িয়ে আসাতে অনেক ভয় কেটে গিয়েছে। তারপরও এবারো আমার পরিবারের সাথে অন্যতম সঙ্গী হলেন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী আজিজ সাহেব। আগের মতই প্যাসিফিক পরিবহনের বাসের টিকেট কিনে ফেলা হল। এবারের ভিসিট মাত্র নয় দিনের। উদ্দেশ্য দার্জিলিং যাবো। সেই উদ্দেশ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অফিস করে শুক্রবার রাতে ময়মনসিংহ-বেনাপোলের বাস সার্ভিসে উঠে পড়লাম সপরিবারে। সারারাত জার্নি শেষে ভোর পাঁচটায় সেখানে পৌঁছালেও সকাল ছ’টার আগে কাস্টমসের কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় যথারীতি বসে থাকতে হলো বেনােেপাল স্থলবন্দরের বাস স্টপেজে। তবে এবারে আগের মতো আর অচেনা কিংবা বোরিং লাগল না। কারণ গতবারেই এসব অভিজ্ঞতা আমাদেও হয়েছে। আর বারবার যাতায়াতের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আজিজ সাহেব তো আমাদের সাথে রয়েছেনই।

কাস্টমসের গেইট পেরিয়ে সহজেই ঢুকে গেলাম ভারতের মাটিতে। সেখানে গিয়ে আজিজ সাহেকে নিয়ে আমাদের সকলের পূর্ব পরিচিত এজেন্সির কাছে গিয়ে প্রয়োজনীয় বাংলাদেশী টাকা এক্সচেঞ্জ করে নিয়েছি। সেইসাথে প্রত্যেকে আবার একটি করে ইডিয়ান মোবাইল সিম কিনে নিলাম। সিম কিনে নিয়েই দেশের গুরুত্বপূর্ণ পরিচিতজনদের ফোন করে করে সে মোবাইল নম্বরটি দিয়ে দিলাম। আগেই বলেছি গত ট্রিপে আজিজ সাহেবসহ আরো একটি পরিবার মিলে আমরা পেট্রাপোল থেকে কলকাতা পর্যন্ত একটি জিপ গাড়ি ভাড়া করে নিয়েছিলাম। কিন্তু এবারে ভিন্নতর অভিজ্ঞতা নেওয়ার খায়েশ হলো মনে। সেজন্য এবারে আমার পরিবার ও আজিজ সাহেব মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম পেট্রাপোলের অদূরেই বনপাড়া রেলস্টেশন থেকে কলকাতা পর্যন্ত আমরা ট্রেনে যাব।

যেই কথা সেই কাজ। পেট্রাপোল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার রাস্তা যওয়ার জন্য একটি মাহেন্দ্র টেম্পুাতে উঠে পড়লাম সপরিবারে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেখানে গিয়ে পৌঁছালাম। আধাঘণ্টা পর পর এখান থেকে কলকাতায় ট্রেন যাতায়াত করে। তবে সমস্যা হলো ট্রেনগুলো হলো সব লোকাল। কিন্তু লোকাল হলেও দেখতে অনেক সুন্দর এবং চলাচলে অনেক সুবধারই মনে হল। ট্রেন প্ল্যাটফরমে এসে দাাঁড়াবার সাথে সাথেই দরজাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায়। যা হোক সকাল ৮টার মধ্যেই বনপাড়া স্টেশনে এসে মনে হল এখানে একটু হালকা নাস্তা সেরে নেওয়া যাক। আমার পরিবারের লোকজনও তাই চাইছিল। পরে স্টেশনের প্ল্যাটফরমেই আলুরদম ও লুচি দিয়ে হালকা নাস্তা সেরে নিয়েছি। ভারতে সব জায়গার সহজপ্রাপ্য ডিসপোজেবল একবার ব্যবহারযোগ্য পাত্রে সহজপ্রাপ্য এসব আলুর দম এবং লুচি সত্যিই খুব সুস্বাধূ। এ বিষয়টি নিয়ে আমার খুবই মজার অভিজ্ঞতা রয়েছে যা পরে আরো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করবো সময় পেলে।

দুই.

ট্রেনের টিকেট নিয়ে গাড়িতে উঠে সিট পেলাম এবং সবাই মিলে জায়গা নিয়ে বসে পড়লাম। গাড়িটি লোকাল হওয়ার কারণে প্রত্যেকটি স্টেশনেই থামছে। প্রত্যেক স্টেশন থেকেই একগাদা করে লোক উঠছে, আর নামছে খুবই কম। তার কারণ হলো ভারতে ট্রেনের যাতায়াত এতো সুবিধাজনক যে সেখানে দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিয়ে মানুষ অনেক দূর-দূরান্ত থেকে আসা যাওয়ার মাধ্যমে কলকাতায় অফিস করে থাকে। সেজন্য বনপাড়া থেকে কলকাতা অনেক দূরে হলেও মাত্র ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের পথ। সেখান থেকে গিয়ে সহজেই অফিস করতে পারছে। আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে সেই ট্রেইনে একটি সমস্যার মধ্যে পড়লাম। আমরা বাংলাদেশের মতো ভাবলাম। দেখা যায় দেশে কোন ট্রেন বা গাড়িতে টিকেট নিয়ে উঠে সেই সিটগুলো নিজেদের দখলেই রাখার চেষ্টা করি। সেখানেও তা করতে গিয়ে দেখলাম যে রাখা যাচ্ছে না।

একটি অদ্ভুত নিয়ম দেখতে পেলাম সেখানে। যে যেখান থেকেই উঠুক না কেন যারা আগে থেকেই বসে আসছে নতুনরা পুরাতনদের উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে দিয়ে বসে পড়ছে। এমন অবস্থা দেখে আমাদের আর কিছুই করার রইল না। শুধু বলতে চেষ্টা করলাম যে আমাদের সাথে মহিলা কিংবা বাচ্চা আছে। আর তাছাড়া বিদেশি লোক। একথা শোনার পর মনে হয় অরো বেশি করে বিরক্ত করা শুরু করল। কিন্তু তাতেও তারা কর্ণপাত না করে সকলকেই পালাক্রমে উঠিয়ে দিয়ে বসে পড়ল। আমরা এতে আশ্চর্য তো হলামই কিন্তু কিছুটা অপমানিতও বোধ করলাম। তবে অপমান গায়ে মাখালাম না এজন্য যে আমরা তো কোন অন্যায় করিনি। উপরন্তু তাদের দেশের মানুষ সম্পর্কে আমাদের একটি ধারণা হয়ে গেল। অথচ আমরা বাঙালিরা কতো অতিথি পরায়ন।

আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত সরকার এবং সীমান্তের এ মানুষগুলোর পুর্ব পুরুষেরাইতো এককোটি বাঙালিকে আশ্রয় দিয়েছিল। শরনার্থী হিসেবে খাইয়ে পরিয়ে রেখেছে। শুধু তাই নয় নয়মাসের মুক্তিযুদ্ধের জন্য কতকিছুই না করেছে ভারত সরকার ও এ মানুষগুলো। এসব কথা মনে করে রাগ কিছুটা কমানোর চেষ্টা করলাম। আর মনে মনে শপথ নিলাম এবার না হয় অভিজ্ঞতার জন্য এভাবে লোকাল ট্রেনে গেলাম, অন্যকোন সময় এভাবে আর যাতায়াত করা যাবে না। তবে ভ্রমণের সফরে এ ধরনের অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। তাহলে সবার সবধরনের অভিজ্ঞতাই সঞ্চিত হয়। এ সময়ে আমি আজিজ সাহেবের মুখের দিকে এবং আজিজ সাহেব আমার মুখের দিকে- আর আমার পরিবারের সদস্যরাও একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। কারণ বিদেশ বিভুই বলে কথা। কোন রকমে কলকাতার শিয়ালদাহ স্টেশনে এসে নামলাম। তবে এখানে একটি কথা স্বীকার করতে হবে, লোকাল ট্রেন বলে যতটুকু সমস্যা হবে বলে মনে করেছিলাম তার কোনটাই হয়নি। বরং ঠিক সময়ের মধ্যেই অর্থাৎ ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের মধ্যেই ট্রেন পৌঁছে গেছে। সেকারণে অর্ধেকের বেশি রাস্তা বসে আসতে পেরেছি আর বাকীটা দাঁড়িয়ে। তবে মহিলা ও বাচ্চাদের শেষ পর্যন্ত বসিয়ে আনতে পেরেছিলাম।

তিন.

আমি এর আগেরবারে ভারত ভ্রমণে সেখানকার তেমন কোন সমস্যার কথা বলি নাই। কিন্তু এবারকার ভ্রমণে দুয়েকটি সমস্যার কথা না বললে আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে যারা পরবর্তীতে সেসব জায়গাতে বেড়াতে যাবেন তারা তখন কিছুটা বিব্রত ও বিপদে পড়ে যেতে পারেন। সেজন্য সত্যিকারের অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করা দরকার। আমার ময়মনসিংহ বসবাস করেন এবং প্রায়ই ভারতে বেড়াতে যান এমন এক অভিজ্ঞ ভদ্রলোক অসীম বাবু যাকে অসীম দা বলে ডাকি তিনি এর আগেরবার আমার সফর সঙ্গী হয়েছিলেন পেট্রাপোল থেকে জিপে যাওয়ার সময় যা আগেই উল্লেখ করেছিলাম। তিনি শিয়ালদাহ রেলস্টেশনের পাশেই আচার্য প্রফুল্ল চ্যাটার্জি রোডের পাশেই একটি আবাসিক হোটেলের ঠিকানা দিয়েছিলেন। মিলন নামের উক্ত হোটেলের এক ম্যানেজারের সাথে দেশ থেকে যাওয়ার আগে যেরকম আলাপচারিতা হয়েছিল তাতে তাকে বেশ সহযোগী মনে হয়েছিল। কিন্তু যখন তার হোটেলে আমার পরিবারবর্গসহ গিয়ে উঠতে চাইলাম তখন দেখলাম অনেক বেশি বাণিজ্যিক কথা বলছেন। আমার সাথে তখনো আজিজ সাহেব ছিলেন। কারণ তিনি আমাদেরকে হোটেলে উঠিয়ে তারপর তাঁর উচ্চ শিক্ষাস্থল কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। আর আমরাও শিয়ালদাহ স্টেশনের কাচাকাছি থাকতে চেয়েছিলাম যাতে সহজেই এখান থেকে টিকেট ম্যানেজ করে শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং যেতে পারি।

কিন্তু সে আমার মনে হয় কিছুটা হোঁচট খেল। তখন আবার আমার নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন একজন ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুন বাবু যিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, তার স্মরণাপন্ন হলাম। আমরা আসছি শুনে তিনি আগে থেকেই অনলাইনে আমাদের স্ক্যান করা পাসপোর্ট নিয়ে শিয়ালদাহ-এনজেপির জন্য কাঞ্চনজঙ্গা এক্সপ্রেসের টু টায়ার স্লিপিং এসি বার্থের টিকেট করে রেখেছে। জুন মাসের ১১-১২ তারিখের কথা। তখন খুবই রোদের মধ্যে কলকাতাজুড়ে গা না সহা গরম চলছিল। এরই মধ্যে প্রফুল্ল চ্যটার্জি লেন থেকে একটি এসি ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে তাড়াতাড়ি কলকাতায় বাংলাদেশিদের অনেক পরিচিত জায়গা মার্কুইস স্ট্রিটে পূর্ব পরিচিত একটি হোটেলে গিয়ে উঠলাম। বেচারা আজিজ সাহেব একেবারে আমাদের সেই হোটেলে তুলে দিয়ে সেখানে একটু ফ্রেশ হয়ে সবাই একসাথে একটি মুসলিম হোটেলে আচ্ছামত গরুর মাংসের ভুনা দিয়ে খেয়ে কল্যাণীতে গেলেন। মার্কুইস স্ট্রিট জায়গাটি ঢাকা থেকে কলকাতায় যে বাসগুলো যায় সেগুলোর স্ট্যান্ড। সেটি নিউমার্কেকেটের খুবই কাছে। সেখান থেকে নিউমার্কেটে পায়ে হেঁটেই চলে যাওয়া যায়। এখানে বাংলাদেশি টাকা সহজেই এক্সচেঞ্জ করা যায়।

আমাদের ২-৩ দিন আগে আমার আরেক সাবেক সহকর্মী কৃষিবিদ আব্দুর রহমান সস্ত্রীক কোলকাতায় গিয়েছেন। তাঁর স্ত্রীও কৃষিবিদ এবং তিনি ঢাকাস্থ শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা। তাঁর নাম ড. নুরমহল আক্তার ডরিন। রহমান মূলত তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসার্থে কলকাতা গিয়েছেন। আমরাও যাচ্ছি জেনে রহমান যোগাযোগ রক্ষা করল যাতে আমরা সেখানে গিয়ে নিজেরা দুই পরিবার মিয়ে কিছুটা সময় ব্যয় করতে পারি। তো সেদিন কলকাতা পৌঁছেই রহমানকে যোগাযোগ করলাম। তারপর হোটেলের অবস্থান জানাতেই ঐদিন বিকালেই তাঁরা হোটেলে আমাদের লাউঞ্জে এসে দেখা করে। তারপর সাথে সাথেই বিকাল বেলাতে হাঁটতে হাঁটতে দুই পরিবার মিলে নিউমার্কেট চলে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা যেহেতু এবারে মূলত এসেছি দার্জিলিং বেড়ানোর জন্য, সেজন্য ফেরার পথে কিছু কেনাকাটা করে ব্যাগ ভারী করব- এ কারণে কিছুই কিনি নাই। তবে সবাই মিলে ব্যাপক ঘুরাফেরা করে এটা সেটা খাওয়া-দাওয়া করেছি। তবে খাওয়ার মধ্যে খুব বেশি নামী কিংবা দামী খাবার খাইনি। সেখানকার ঐতিহ্যগত আলুর দম ও লুচি, মাটির কাপে চা ইত্যাদি খেয়েছি। তারপর রাতে হালকা খাওয়া সেরে বাবুর কাছ থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার ট্রেনের টিকেটের এসএমএস নিয়ে হোটেলে চলে গিয়েছি।

চার.

সকাল ছ’টায় শিয়ালদাহ স্টেশন থেকে কাঞ্চনজঙ্গাতে উঠতে হবে। তাই রাতে একটু কম ঘুমিয়ে ভোররাত চারটার দিকে সকলে উঠে একে একে বাথরুম সেরে রেডি হয়ে ব্যাগ গোছ-গাছ করে শিয়ালদাহ স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। সেখানে ঠিক সময়মতো পৌঁছে গাড়ি ধরতে পেরেছি। আগে যেমন রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনটি পুরোটাই এসি ছিল, কিন্তু এ ট্রেনটির কয়েকটি বগিমাত্র এসি। অনেক লম্বা মেল ট্রেন, সেজন্য আমাদের কামরাটি খোঁজে পেতে একটু সময় লাগল। ট্রেনে উঠে সহযাত্রীদের সাথে আলাপ করে জানতে পারি যে, ট্রেনটি এনজেপিতে পৌঁছাতে ১১-১২ ঘণ্টা সময় লাগে। অর্থাৎ আমরা উঠেছি সকাল ছ’টায়, সেখানে পৌঁছাবো সন্ধা ৫-৬’টার মধ্যে। আমার সাথে যে দুটো বাছাধন তকি ও নাফি রয়েছে তারা সহজেই সহযাত্রীদের সাথে সখ্যতা তৈরী করে নিতে পারে। এর আগে কলকাতা-দিল্লী যাওয়া-আসার সময়ও তারা তাদের বাক পটুতা দিয়ে এ কাজটি সহজেই করতে পেরেছিল। এবারেও ট্রেনে তার বিকল্প হলো না। তবে ব্যতিক্রম হয়েছিল শুধু বনপাড়া থেকে কলকাতায় আসার সময়।

সকাল ছ’টা থেকে বিকাল ছ’টা- তার মনে হলো সারাদিন। অর্থাৎ এ ট্রেন জার্নিটি ছিল পুরো দিনের বেলায়। দিনের বেলায় জার্নির অন্যতম একটি সুবিধা হলো চারিদিকে দেখে দেখে যাওয়া যায়, যে কারণে ভ্রমণ খুবই উপভোগ্য হয়ে উঠে। সেজন্য যদিও স্লিপিং বার্থ নিয়েছিলাম কিন্তু তা কোন ঘুমের জন্য কাজে লাগেনি। তবে সকালের দিকে সবাই একটু একটু করে ঘুমিয়ে নিয়েছে। স্লিপিং বার্থের সুবিধা শুধু ঘুমিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যথায় তা একটি বিরক্তির কারণ হয়। স্লিপিং বার্থে যদি সবাই একসাথে ঘুমায় তাহলেই সুবিধা, কিন্তু যদি কেউ ঘুমিয়ে কিংবা কেউ বসে যেতে চায় তাহলে সমস্যা হয়ে যায়। কারণ মাথার উপরে একটি স্লিপিং বার্থ বাধা থাকলে সেখানে নিচে আর বসা যায় না। মোটামোটি সকাল দশটার পরে সবাই ঘুম থেকে জেগে উঠেছে এবং সবাই স্লিপিং বার্থ গুটিয়ে যে যার জায়গায় আরামে বসে পড়েছে।

ট্রেন চলছে আমরা যাচ্ছি। মাঝে মধ্যে পাশের এর-ওর সাথে এক কথা দুকথা বলতে অনেক জমিয়ে খাতির হয়ে উঠল। এ ট্রেনটির মধ্যে কর্তৃপক্ষের কোন সরবরাহকৃত খাবার ছিল না। খাবার নিজেদেরই কিনে খেতে হল। আমার নাফি ও তকি খাবার দাবারে খুবই দুর্বল প্রকৃতির। তারা সারাদিনেও ভারী কোন খাবার জোর করে না খাওয়ালে নিজে থেকে কখনোই খাবার চেয়ে খাওয়া অভ্যাস ওদের নেই। সেদিক থেকে একটু স্বস্তিতে থাকলেও তারা কতক্ষণ পরপর বাদাম ভাজা, চানাচুর ভাজা, চিপস, ঝালমুড়ি ভাজা, আচার, শনপাপড়ি, চা, কফি ইত্যাদি কিনে কিনে দেওয়া হচ্ছে। তা আমরাও খাচ্ছি আর ওদেরকেও দিচ্ছি। তাছাড়া নাফি, তকি ইতোমধ্যে পুরো কামরার সবার সাথে ভাব জমিয়ে বসেছে। সেজন্য যে যাই কিনে খাচ্ছে সবকিছুই নাফি, তকিকে সেধে সেধে খাচ্ছে। তার কোনটা মন চাইলে ওরা খাচ্ছে, আবার মন না চাইলে খাচ্ছে না। আমরা ট্রেনের ভিতর ভারী কোন খাবার খাচ্ছি না, কারণ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে সেখানে একটি ভালো হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে তারপরে ভালোভাবে খাওয়া দাওয়া করবো।

জুন মাস। আমের মৌসুম। যেতে যেতে সারা ট্রেনের ভিতর থেকে দুধারে গাছে গাছে আমের থোকা ধরে রয়েছে দেখতে পাচ্ছি। ট্রেনের ভিতর মাঝেমধ্যে দুয়েকজন ফেরিওয়ালা পাকা আম নিয়ে উঠছে। কিন্তু ট্রেনটি যখন মালদাহ স্টেশনে থামল তখন দেখি ঝাঁকে ঝাঁকে ফেরিওয়ালা ব্যাগ ভরে ভরে আম নিয়ে ফেরি করছে ট্রেনের ভিতর। দেখতে পাচ্ছি ৫ কেজি আমের ব্যাগ ১০০ টাকা এবং ১০ কেজি আমের ব্যাগ ২০০ টাকায় বিক্রি করছে। ট্রেনের অনেকেই তা দেদার কিনছে। কেউ কেউ কিনে ট্রেনের ভিতরেই খেয়ে নিচ্ছে। আম আমার খুব প্রিয় ফল। মনের খুবই খায়েশ হতে থাকল যেন একব্যাগ আম কিনে নেই। কারণ মালদার আম নাকি খুব ভালো। কিন্তু কোথায় নিব আম সে চিন্তায় আর কেনাও হলো না, আর খাওয়াও হলো না। তবে এটা মনে লেগে রইল যে ট্রেন থেকে এনজেপিতে যেখানেই নামব সেখানেই সুযোগ পেলে আম খাব।

মালদার আম যে খুব ভাল তার একটি কারণ রয়েছে। আর সেটি হলো ভারতের মালদার দক্ষিণ পাশেই হলো বাংলাদেশের রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা। কাজেই একই ধরনের আবহাওয়া, জলবায়ু এবং মাটির গুণাগুণের কারণে দু জায়গারই আম সুস্বাধূ। মালদাহ পেরোতেই দেখলাম তিস্তা ব্যারাজ যার উপর দিয়ে ট্রেনলাইন গিয়েছে। সেটা পেরোতেই রেল লাইনের দুপাশে সুন্দর সুন্দর ছোট ছোট চা বাগান দেখতে পেলাম। কারণ ওপাশে বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের চা বাগান রয়েছে। সেখানেও দুপাড়ে একই আবহাওয়া, জলবায়ু ও মাটির প্রকৃতি। সেখানে চা বাগানগুলো কৃষকদের নিজস্ব জমিতে নিজের উদ্যোগে চাষ করা। বড় কোন চা বাগান সেগুলো নয় বলেই মনে হলো। একটি মজার ব্যাপার হলো- কলকাতা থেকে নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত ট্রেনের লাইনটা একেবারে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে গিয়েছে। ট্রেনে জার্নি করার সময় আমার মোবাইল সেটে ইন্ডিয়ান একটি সিমের সাথে দুটি অপশন থাকায় গ্রামীণ ফোনের সিমটিও লাগানো ছিল। ট্রেন থেকে ডানদিকে বা দক্ষিণদিকে তাকালে বাংলাদেশের সীমান্ত কাঁটাতারের বেড়া বা সীমান্ত খুঁটি এবং বৈদ্যুতিক খুঁটি, মোবাইল ফোনের টাওয়ার দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, মাঝেমধ্যে ট্রেনের ভিতরে গ্রামীণ ফোনের নেটওয়ার্কও পাওয়া গেছে।

পাঁচ.

ট্রেন থেকে নেমেই স্টেশনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি টেম্পু রিজার্ভ করে আমরা সেখান থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে হিলকার্ট রোডের একটি ভালো হোটেলে উঠি। সেই ৫ কিলোমিটার রাস্তা শিলিগুড়ি জেলা শহরের ভিতর দিয়ে গিয়েছিলাম। আর হিলকার্ট রোড এইজন্য যে পরদিন সকাল বেলা সেখান থেকেই দার্জিলিং এর জন্য চাঁন্দের গাড়িখ্যাত টাটা-সুমো গাড়িতে উঠতে হবে। আশ্চর্যের বিষয় হলো ময়মনসিংহ থেকে কলকাতা পর্যন্ত আমার সাথী আজিজ সাহেব থাকলেও এখানে কিন্তু আমরা একটিই পরিবার এসেছি বেড়াতে। সাহস হলো আগের অভিজ্ঞতা এবং গাইড হলো বাংলাদেশের আমার অসীম দার বড়ভাই যিনি দীর্ঘদিন ইন্ডিয়াতেই থাকছেন, তার সাথে টেলিফোনের মাধ্যমে কিছু পরামর্শ ও নির্দেশনা নেওয়া। হোটেলটি ভালই পাওয়া গেল। সেখানে হোটেলে উঠে যথারীতি ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবারের জন্য বেরিয়ে পড়ি। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে মানুষকে জিজ্ঞেস করতে করতে একটি ভালো হোটেলে উঠে সেখানে বাঙালি খাবার তৃপ্তি সহকারে খেলাম। তারপর খেয়ে-দেয়ে ফেরার সময় আমার প্রিয় আম রাস্তায় পেয়ে একাই দুই কেজি কিনে খেয়ে নিলাম। কারণ আমার পরিবারের অন্য সদস্যরা এসব খাওয়া দাওয়ায় এতটা পটু নয় যা আগেই আমি বলেছি।

রাতে ভালোভাবে ঘুমিয়ে সকালে বেরিয়ে পড়লাম দার্জিলিং যাওয়ার উদ্দেশ্যে। বের হওয়ার আগে হোটেল থেকেই আলু পরোটা ও ডাল, ডিম ভাজা ও কফি দিয়ে নাস্তা সেরে রওয়ানা করলাম। নাস্তার এ মেনুটি আমার পরিবার খুব ভালো পছন্দ করেছে। হোটেল থেকে ক্ষাণিক হাঁটতেই সেই বিখ্যাত পাহাড়ের উপযোগী চাঁন্দের গাড়ির স্ট্যান্ড। বিশেষ ধরনের গাড়িতে প্রথমেই ড্রাইভারের সাথের সিটগুলো নিয়ে নিলাম আমাদের জন্য। তারপর অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি যাত্রিতে ভরে যাওয়ার পরই ছেড়ে দিল দার্জিালং-এর উদ্দেশ্যে। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিংয়ের দূরত্ব মাত্র ৬০-৬৫ কিলোমিটার। কিন্তু পৌঁছাতে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। কারণ পাহাড়ী রাস্তায় ঘুরে ঘুরে উঠতে হয়। শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে ছাড়তেই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখে পড়ল দৃষ্টিনন্দন পাহাড় ও চা বাগান। পাশে দিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের বিশেষ চলার উপযোগী ঐতিহ্যবাহী একটু সংকীর্ণ ধরনের ট্রয় ট্রেন লাইন। যেতে যেতে রাস্তায় পড়ছে ছোট ছোট পাথরভরা নদী-খাল, বাংলাদেশের মধুপুর ও ভাওয়ালের জাতীয় উদ্যান সদৃশ বিশেষ ধরনের বন-বাগান। শুরুর দিকেই যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মনটা ভরে গেল।

প্রথম দিক থেকেই গাড়িতে সবাই ছবি তোলর ব্যাপারে খুবই তৎপর ছিল। কিন্তু যতই সময় ও রাস্তা পেরোতে লাগলাম ততই যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অরো বেশি মুগ্ধ হতে লাগলাম। মনে হলো যেন আগের ছবিগুলো তুলে শুধু শুধু ক্যামেরার মেমোরি নষ্ট করেছি। গাড়ি চলছে পাহাড়ের চারিদিকে ঘুর্ েঘুরে। যতই উপরে উঠছি ততই তার নিচের রাস্তার পরতে পরতে উপর থেকে দেখা যাচ্ছে। রাস্তাগুলোও খুবই সুন্দরভাবে করা। প্রতিমুহূর্তে শতশত গাড়ি ক্রস করছে। রাস্তার একদিকে পাহাড়, পাহাড়ের সাইডে টয় ট্রেনের লাইন এবং অন্য পাশে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একেবারে হাজারো ফুট নিচপর্যন্ত চলে গিয়েছে। যতই উপরের দিকে উঠছি প্রথম দিকে একটু ভয় পেলেও পরে সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আস্তে আস্তে কখন যে সবারই ভয় কেটে গেছে তা আর মনে নেই। দেড় ঘণ্টার মতো জার্নি করার পর গাড়িটা রাস্তার পাশে একটি রেস্টুরেন্টের কাছে চা-নাস্তা, রিফ্রেশমেন্ট এবং প্রাকৃতিক কার্যক্রম সাড়ার জন্য একটি ব্রেক দিল।

সেই ব্রেকের পরে গাড়িটি আরো প্রায় দেড়ঘণ্টার মতো পাহাড়ের উপরের দিকে উঠতে চলল। রাস্তার পাশে কখনো সখনো হাট-বাজার, মার্কেট, রেস্ট হাউজ, হোটেল, মোটেল ইত্যাদি দেখতে পেলাম। আমাদের গাড়িতে যেসব যাত্রি উঠল তাদের সবাই যে পর্যটক তা নয়। সেখানে ঐসব পাহাড়ি এলাকার কিছু বাসিন্দাও উঠেছিল আমাদের গাড়িতে। তারা সময়ে সময়ে পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে নামছিল। যেহেতু জুন মাস চলমান, সেজন্য ক্ষণে ক্ষণে থেমে থেমে বারবারই বৃষ্টি আসছিল। আর আমরা যতই পাহাড়ের উপরের দিকে উঠতে লাগলাম মাঝেমধ্যে যেন দলা দলা মেঘ-বৃষ্টি গাড়ির ছাদ ছুঁয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া মাঝে-মাধ্যেই মেঘরাশি কুয়াশার মত কালো হয়ে রাস্তায় অন্ধকার সৃষ্টি করছে। পুরোটাই একটি অন্যরকম অনুভুতি যা নিজ চোখে না দেখলে বলে বোঝানো কঠিন। আমরা যখন এ বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম তখন অনেকেই বলেছিল বর্ষাকালে না যাওয়ার জন্য। কিন্তু এ সময়ে না গেলে এসব অভিজ্ঞতা মিস করতাম বলেই মনে হয়। এভাবেই পৌঁছালাম স্বপ্নের দার্জিলিং শহরে।

ছয়.

দার্জিলিং একটি পর্যটন শহর। এটি সমতল থেকে স্থানভেদে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার ফুট পর্যন্ত উপরে। পরতে পরতে ধাপে ধাপে উঠতে হয়। তবে প্রত্যেকটি পরতেই মনুষ্য বসতি স্থাপিত হয়েছে। সেজন্য উপর থেকে নিচের দিকে তাকালে মানুষ, গাড়ি ইত্যাদিকে পিঁপড়ার মতো মনে হয়। চাঁন্দের গাড়ি থেকে দার্জিলিং টয় ট্রেনের স্টেশনের পাশে নেমেছি। এখন সেখান থেকে ভালো একটি আবাসিক হোটেলে উঠে তারপর এখানে ওখানে দর্শণীয় স্থানগুলো পরিদর্শন করার পরিকল্পনা আমাদের। কিন্তু স্টেশনের কাছে নামতেই পরিবারসহ পর্যটক দেখার সাথে সাথে একদল দালাল আমাদের পিছু নিল যাতে তাদের পছন্দ মতো হোটেলে উঠি। পরে অনেক কষ্টে একটি দালাল চক্রের খপ্পর থেকে কোনরকমে পার পেয়ে ভেবেছিলাম খুব সাধারণ একজনের সহায়তা নিয়ে একটি হোটেলে উঠি। কিন্তু যেহেতু পরিবার ও ব্যাগসহ চলাফেরা, কাজেই ইচ্ছা করলেও বেশিদূর তো ঘুরা যায় না। তারপর সাধারণ ভেবে যখন আরো কয়েকজনের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম সেখানে আসলে সাধারণ বলতে কেউই নেই, সবাই কোন না কোনভাবে দালাল। সেজন্য শেষপর্যন্ত একজন দালালের মাধ্যমেই দার্জিলিংয়ের কেন্দ্রস্থলে একটি ভালো হোটেলে উঠে পড়ি।

যে হোটেলটিতে উঠেছি সেখান থেকে আশেপাশের দর্শণীয় সবস্থানই কাছাকাছি। দার্জিলিংয়ের একটি প্রধান বিশেষত্ব হলো সেখানে সারাবছরই শীতকাল। আমরা যখন গিয়েছি তখন কলকাতাতে দেখে গেলাম ৪০ ডিগ্রি সে. বেশি তাপমাত্রা। অথচ দার্জিলিংয়ে তখন তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রির নিচে। সেজন্য আমাকে সেখানে যাওয়ার আগে, অভিজ্ঞ অনেকে সেখান থেকে শীতের কাপড় কিনে আনার পরামর্শ দিয়েছিল। আমরা আসলে করেছিও তাই। যেকারণে সেখানকার কোন হোটেল কিংবা বাড়িঘরে কোন ফ্যান নেই। নেই তো নেই-ই এমনকি কোন বাসা কিংবা হোটেলে ফ্যানের পয়েন্টও নেই। কারণ সেখানে সারাবছরের কখনোই ফ্যানের প্রয়োজন হয় না। সেখানে পানির একটু সমস্যা রয়েছে। কারণ বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে পানির চাহিদা মেটানো হয়ে থাকে। সেজন্য হোটেলে প্রথমেই একটি সতর্কবার্তা সম্বলিত নোটিশ সকলের চোখে পড়বে যে, ‘অযথা বাড়তি পানি ব্যবহার করা নিষেধ’।

রাতে দিনে এখানে ওখানে ঘুরছি, এটা সেটা খাচ্ছি, নাফি, তকি বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনে দেওয়ার বায়না ধরছেতো কিনে দিচ্ছি। দার্জিলিংয়ে প্রথম রাতের ১২টার পর টয় ট্রেনের স্টেশনে গেলাম। সেখানে গিয়ে রাতের দার্জিলিং শহর দেখলাম। মনে হলো যেন পাহাড়ের ভাজে ভাজে আকাশের তারকারাশি জ্বলজ্বল করছে। যে হোটেলে উঠেছি সেখানকার জানালা দিয়েই হিমালয় পর্বতের কয়েকটি শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। সেখানকার বিশেষ ধরনের পর্যটন উপযোগী টয় ট্রেন যা উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ইউনেস্কোর বিশ্ব-ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত, স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত। যেমনি করে আমাদের দেশের সুন্দরবন ইউনেস্কোর বিশ্ব-ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। সেখান থেকে ‘টাইগার হিল’ যেখানে সূর্যোদয় সরাসরি স্বচক্ষে দেখা যায়, তারপর ‘আলিপুর দোয়ারা’ ইত্যাদি আরো অনেক দর্শণীয় স্থান ছিল। এগুলো দেখার জন্য খুব ভোরে সূর্য উঠার আগেই গিয়ে উপস্থিত হতে হয় এবং পাহাড়ের আরো অনেক উপরে উঠতে হয় যা খুবই সতর্কভাবে করতে হয়। কিন্তু আমরা ছোট বাচ্চাদের নিয়ে যেতে কিছুটা ভয় পাওয়ায় সেখানে আর যাওয়ার সাহস করিনি।

প্রত্যেকটি মার্কেটে যেতে হলে উপর-নিচ সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় এবং আবার নামতে হয়। এরই মধ্যে বাঙালি খাওয়া দাওয়ার জন্য একটি ইসলামী হোটেল খোঁজে বের করেছি। সেখানে তিরবারই গিয়ে গরুর মাংসের ভুনা, ছোটমাছ, বিভিন্ন ধরনের ভর্তা, ভাজি, ডাল, আলু পরোটা ইত্যাদি খেয়ে সময় পার করছি। সেখানে চলাফেরা করার সময় মাঝেমধ্যে আকাশের মেঘ মাথা ছুয়ে গিয়েছে। তাতে মনে হয়েছে যেন আমরা বিমানে ঘুরছি। এভাবে সেখানে দুইরাত-দুইদিন থেকে অন্যত্র কোথাও যেতে না পেরে আবার একইভাবে শিলিগুড়িতে ফিরে এসেছি। তার আগে বাবুকে দিয়ে এনজেপি থেকে কলকাতার হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত শতাব্দী এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি চেয়ারকোচের টিকেট করিয়ে নিয়েছি যার অনলাইন ভার্সান আমাকে এসএমএসের মাধ্যমে মোবাইলে পাঠিয়ে দিয়েছে। ট্রেনের সময় আবারো সে ভোর পাঁচটা। তবে আসার সময়ের তুলনায় যাওয়ার সময় উত্তেজনা এবং ভয় দুটোই কম কাজ করেছে।

সাত.

এবার শিলিগুড়িতে ফিরে এসে আরেক দালালের খপ্পরে পড়তে পড়তে উদ্ধার হয়েছি। চাঁন্দের গাড়ির স্ট্যান্ডে নেমে আগের হোটেলটিতে গিয়ে আমাদের ট্রেনের সময়সূচি মত উঠার জন্য ভোরে গাড়িতে পৌঁছে দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় আমরা স্টেশনের কাছে কোন হোটেলে উঠার মনস্থির করেছি। শিলিগুড়ি স্ট্যান্ড থেকে এনজেপি রেল স্টেশনের কাছাকাছি একটি হোটেল পাইয়ে দেওয়ার শর্তে মাথায় শিখের পাগড়ি পরিহিত এক টেম্পু ড্রাইভারের গাড়িতে রিজার্ভে উঠলাম। তখন বিকাল বেলা। রাস্তায় যেতে যেতে কথায় কথায় পরিচিত হলাম লোকটির পূর্বপুরুষের বাড়ি বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায়। তিনি ঈশ্বরগঞ্জের যেসব এলাকার নাম বলছিলেন সেসব এলাকা আমারও চেনা। কারণ আমার বাড়ি যেহেতু কিশোরগঞ্জে সেজন্য দীর্ঘদিনের যাতায়াতের রাস্তা এটি। দেশি লোক পেয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম।

ভাবলাম অন্তত এ দেশি মানুষটি আমাদের ঠকাবে না। কিন্তু কথায় আছে, ‘চোরায় না শুনে ধর্মের কাহিনী’। তিনিও একই কাজ করলেন। আমাদের একটি কোনরকম হোটেলে উঠিয়ে দিয়ে তিনি যখন তার দক্ষিণা নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন তখনই তার প্রতি রাগ কে বললাম, ‘আপনাকে তো দাদা বিশ্বাস করেছিলাম, ইন্ডিয়ান মনে করি ন্ইা। তখন তিনি ক্ষাণিক লজ্জার ভাব করে শেষপর্যন্ত স্টেশনের কাছে একটি ভালো হোটেলে নিয়ে আসলেন। তবে আমি ব্যাগ নিয়ে উপরে উঠার পর সে লোক আবার হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে তার কমিশনটি নিয়ে নিল, তা আর আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না। তবে তাকে যাওয়ার সময় শুধু বললাম, ‘আপনি যদি আমার সাথে চালাকি না করে আগেই ভালো জায়গায় নিয়ে আসতেন তাহলে আমিই খুশি হয়ে আপনাকে এর থেকে অনেক বেশি বকশিস দিতাম’। লোকটি চলে গেল কিন্তু রইল অভিজ্ঞতা।

রাতে উক্ত হোটেলে অর্ডার দিয়ে খাবার তৈরী করিয়ে মনপুে ও পেটপুরে খেলাম। শিলিগুড়িতে অনেক কেনাকাটার মার্কেট ও শপিং মল থাকলেও গিন্নিকে আর রাতে সকথা মনে করিয়ে দিলাম না। তাতে আমার টাকা, সময় ও পরিশ্রম সবই বেঁচে গেল। হোটেলটি এনজেপি রেল স্টেশনের খুবই কাছে। তাই রাতেই একবার হেঁটে হেঁটে স্টেশন থেকে ঘুরে এলাম। সকালে যথারীতি একটি গাড়ি নিয়ে যথাসময়ে শতাব্দী এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠে পড়লাম। তবে এ ট্রেনটি কাঞ্চনজঙ্গার চেয়ে ভালো এবং পুরো গাড়িই এসি। সেখানে খাবার সাপ্লাই আছে কর্তৃপক্ষের নিকট থেকেই। প্রতিবারই আমরা শিয়ালদাহ স্টেশনের সাথেই পরিচিত। এবারে সুযোগ হলো হাওড়া স্টেশনেও অভিজ্ঞতা নেওয়ার। দুটি স্টেশনেই সমানে সমান। হাওড়া থেকে সেই আগের মার্কুইস স্ট্রিটের হোটেলেই আবার উঠলাম। কলকাতায় পৌঁছে আবার আজিজ সাহেব, রহমানকে ফোনে রিপোর্ট করলাম এবং টিকেট দিয়ে সার্বিক সহযোগিতার জন্য বাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন করলাম। সেখানে বাবুর সাথে ময়মনসিংহেরই মনির নামের আরেকটি ছেলে একই সাথে রবীন্দ্রভারতীতে চারুকলায় ডিগ্রি করছে, তিনিও আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন।

কলকাতায় রহমান পরিবারের সাথে পরদিন কিছু কেনাকাটায় সময় দেয়া হলো। সকালে কলেজ স্ট্রিটের কয়েকটি শাড়ির দোকানে গিয়ে শাড়ি কেনা হলো। এর আগের বারও ভারতে গিয়ে সেসব দোকানে কেনাকাটা করা হয়েছিল। সে দোকানগুলোতে কেনাকাটা করার জন্য ইন্ডয়ান টিভি চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়ে থাকে। সেগুলো হলো ‘আদি ঢাকেশ্বরী’, ‘আদি মোহনীমোহন কাঞ্জিলাল’, ‘আদি ইন্ডিয়ান সিল্ক’ ইত্যাদি নাম করা শাড়ির দোকান। যেহেতু পরদিন দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেজন্য বিকালে আবার শেষ সময়ের কিছু কেনাকাটা করার জন্য নিউমার্কেট গিয়ে শেষ করা হয়। শেষরাত হিসেবে সেরাতেই রহমান, ডরিন, বাবু, মনির, আজিজ সাহেবসহ সবাই মিলে একসাথে রাতের খাবার খাই। পরদিন সকালে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করব। অর্থাৎ এদিন থেকেই রমজান শুরু। রহমান তাদের চিকিৎসা কাজ শেষ না হওয়ায় অরো কিছুদিন থাকবে। আজিজ সাহেব এবং আমরা ফিরবো বলে আজিজ সাহেবের মাধ্যমে আগেই ময়মনসিংহের প্যাসিফিক পরিবহনের গাড়ির টিকেট নিয়েছি। কিন্তু বেনাপোল পর্যন্ত যাওয়ার জন্য কলকাতা-ঢাকার সাউদিয়া পরিবহনের একটি বাসের টিকেট সংগ্রহ করি।

রাতে হোটেলে সেহরি খেয়ে তারপর আমার প্রিয় ফল আম খেয়েছি। কলকাতা থেকে সকাল ১১টায় রওয়ানা করে বিকাল ৫টায় এসে পৌঁছেছি পেট্রাপোল সীমান্তে। এত সময় লাগার কারণ হলো রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়া। সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত পারাপারের জন্য পোর্টের কার্যক্রম চালু থাকে। এদিনের পারাপার মিস করলে সীমান্তেই হয়তো রাত কাটাতে হতো আমাদের। কারণ পরের দিন ২০ জুন তারিখেই ছিল আমার ভিসার ছয়মাস মেয়াদের শেষ দিন। সেজন্য তাড়াতাড়ি করে এসে কোনরকমে দৌড়ে স্থলবন্দরের কাস্টমস হাউজে ঢুকে পড়েছি যাতে সময় চলে গেলেও কাজ সারতে পারি। কিন্তু আল্লাহর রহমতে সবকিছুই সময়মতেই শেষ করতে পারলাম। পরে প্যাসিফিক পরিবহনের রেস্ট হাউজে গিয়ে পৌঁছানোর সাথে সাথেই প্রথম রোজার ইফতারের সময় হলো। তখন তৃপ্তি সহকারে সবাই মিলে ইফতার করলাম আর মনে হলো দুইদেশ মিলিয়ে প্রথম রোজাটি পালন করলাম। রাতের জার্নিতে আবারো বেনাপোল থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম। পথে যশোরের একটি হোটেলে রাতের খাাবর খেয়ে নিলাম।

মাঝরাতের দিকে লালন সেতু পার হলাম, তারপর যমুনা বঙ্গবন্ধু ব্রিজের ওপাড়ে হানিফ রেস্ট হাউজে সেহরি সেরে আবারও গাড়িতে উঠে সময়মতোই ময়মনসিংহে এসে পৌঁছাবো বলে ভাবছি। ঠিক সেই মুহূর্তে ভোরবেলার দিকে দেখি মধুপুর বনে এসে সামনে একটি ট্রাক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। এর জন্য আরো প্রায় তিন-চার ঘণ্টা কষ্ট করতে হলো, কারণ সে সময়টা আমরা সেখানে আটকে ছিলাম। যেন শেষ হয়েও হলো না শেষ। এখানে একটি পাদটীকা দেওয়া দরকার। আর সেটি হলো- ভ্রমণে যেমন আনন্দ আছে আছে তেমন কষ্ট ও বিড়ম্বনা। যদি বিড়ম্বনাকে বড় করে দেখি তবে কোনদিনও বেড়ানো হবে না। ভ্রমণে আনন্দ ও বিড়ম্বনা একসাথে কাধে কাধ মিলিয়ে হাঁটে। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে কল্পনা করা যায় না। কাজেই কোনটা ভুল আর কোনটা মধুর ভুল। তবে আনন্দের কাছে সেই সমস্যাগুলো একেবারেই তুচ্ছ যা একেবারে ঝেড়ে ফেলা দেওয়া যায়। তাহলেই যেকোন ভ্রমণ অনন্দময় হতে বাধ্য।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

email: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer