ছবি : বহুমাত্রিক.কম
ঢাকা : মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল। ৮৪ বছরে পা দেওয়া এক কর্মবীর, জনসেবক। বর্তমানে রাজনীতির মাঠে-ময়দানে ‘জননেতা-সমাজসেবক’ ইত্যাদি অভিধায় যাকে-তাকে ভূষিত করার যে সস্তা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় মীর মোনায়েম সালেহীন সুবলের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। গণমানুষের জন্য, নির্যাতিত-নিপীড়িত ও দুস্থদের জন্য তাঁর যে গভীর আন্তরিক সংহতি এবং নিবেদিত প্রচেষ্টা তা বর্তমান সমাজ কাঠামোতে রীতিমত বিরল।
ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার রওহা গ্রামের মীর বাড়ির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে গত শতাব্দির ত্রিশের দশকে জন্ম নেওয়া সুবল জীবনে দু’বার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন-তাও আবার বার্ধক্যকে আলিঙ্গন করার বয়সে এসে। গফরগাঁও-এর প্রাণকেন্দ্র সালটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে তাঁর যতখানি পরিচিতি-তা ছাপিয়ে আরও বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি সমাজের দুস্থ ও পীড়িত হাজারো মানুষের কাছে এক সাক্ষাৎ দেবদূত।
গফরগাঁও-এর ভৌগলিক সীমানাতেই সীমাবদ্ধ নেই তাঁর পরিচিতি-তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলসহ দেশজুড়ে লাখো মানুষের প্রিয়মুখ। তাঁর নীরব ও অকাতর জনসেবার পাশাপাশি যে কারণে তিনি সবার শ্রদ্ধার আসনে অভিষিক্ত-তা হচ্ছে ক্ষমতা এবং খ্যাতির চূড়ায় আরোহণ করেও ব্যক্তিগত জীবনে এই মানুষটি সৎ ও অতিমাত্রায় অনাড়ম্বর-নির্লোভ। ইউপি চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়েও নিতান্তই সাধারণ কুঁড়েঘরে ছিল তাঁর বাস। ইস্ত্রি করা পরিচ্ছন্ন পাঞ্জাবি-লুঙ্গি আর চিরচেনা গোঁফের অনন্যসাধারণ এক ব্যক্তিত্বের সুবল চেয়ারম্যানকে বাহির থেকে দেখে বোঝার জো নেই ব্যক্তিজীবনে তিনি কতটা দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জড়িত।
বলা যায় মীর মোনায়েম সালেহীন সুবলের জীবনের প্রতিটি দিনই কেটেছে জনসেবায়। তাঁর এই জনসেবার জীবনে সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়টি হচ্ছে ১৯৭১। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল। ২৫ মার্চ বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরু পরে সেইসময়ের ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র ব্রহ্মপুত্র তীরের গফরগাঁও-ও আক্রান্ত হয়েছিল। সেখানেও চলে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। গফরগাঁও-এর পথে পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল স্থানীয়দের বিভৎস মরদেহের অংশবিশেষ। মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল অসীম সাহসিকতার সঙ্গে অসংখ্য মরদেহের সৎকার করে মানবতার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
১৭ এপ্রিল বহু মুক্তিকামী মানুষের মত তিনিও বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ১৮ এপ্রিল ভারতের ডালু নামক স্থানে পৌছান। সেখান থেকে তিনি আরও দূরে রেডক্রসের একটি শরণার্থী শিবিরে যোগ দিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, অসুস্থ শরণার্থীদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তাদের তিনি স্যালাইন দেওয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসায় অন্যান্য সহযোগিতা দেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাতে তিনি শরণার্থী শিবিরে হাজারো মানুষের সেবা দেন।
তখনকার সময়ে তাঁর সবচেয়ে স্মরণীয় দিন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভারতের মৈলাম শরণার্থী ক্যাম্পে নব্য স্বাধীন জাতির আত্মপ্রকাশে এক বিশেষ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল। বিএসএফ কমান্ডার বিআর খানের তত্ত্বাবধানে সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে ভাষণ দিয়েছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি ও তৎকালীন কিশোরগঞ্জের তরুণ এমপি মো. আবদুল হামিদ। উপস্থিত শরণার্থীদের মাঝে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মীর সুবলই সেদিন আবদুল হামিদকে আহ্বান জানান শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখার।
স্বাধীন দেশে অন্য সবার মত সুবলও দেশে ফেরেন। চালচুলোহীন এই জনসেবক ফের আত্মনিয়োগ করেন পীড়িত মানুষের সেবায়। এর মাঝে কেটে গেছে চার দশকেরও বেশি সময়। মুক্তিযুদ্ধে বিরাট অবদান রাখা মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল পাননি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি। সারাজীবন যশ-খ্যাতি আর প্রাচুর্যকে পায়ে ঠেলে সততাকে অবলম্বন করে এগিয়ে যাওয়া এই মুকুটহীন সম্রাট বার্ধক্যের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিটুকু চান। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি স্যালুট নিয়ে অন্তত শেষ বিশ্রামের আকাঙ্খা তাঁর।
এখনও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে মীর সুবলের প্রশ্ন-হাজারো মুক্তিযোদ্ধা আর শরণার্থেীদের অকাতর সেবাদানের কী কোনই মূল্য নেই? স্মৃতিতে এখনও ঝলঝল করা একাত্তরের সেই দিনগুলিতে নিজের অবদানের যথার্থতা যাচাইয়ে খোদ রাষ্ট্রপতি ও একাত্তরের তরুণ এমপি আবদুল হামিদের সাক্ষৎ চান অশীতিপর এই ব্যক্তি। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নিজের নাম অন্তর্ভূক্তির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছেই ‘পরীক্ষা’ দিতে চান তিনি। কেননা একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে মৈলাম ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও এমপি আবদুল হামিদ-কে উষ্ণ অভ্যর্থনা প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা যে মীর সুবলই রেখেছিলেন। সেই অধিকারেই রাষ্ট্রপতির কাছে সাক্ষাতের সুযোগ চান তিনি।
সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসাপতালে বহুমাত্রিক.কম-কে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব আকাঙ্খার কথা জানিয়েছেন মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল। জানিয়েছেন দীর্ঘ জীবনের হাজার হাজার অসহায় মানুষদের পাশে থাকার অসংখ্য গল্প। তুলে ধরেছেন কালের সাক্ষী হয়ে অবলোকন করা সমাজ-রাজনীতির বিবর্তনের বহু অগ্রন্থিত ইতিহাসও।
বহুমাত্রিক.কম