Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ২ ১৪৩১, মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪

যেমন আছেন চুকনগর গণহত্যাস্থলে পাওয়া সেই ‘শিশু’

শেখ হেদায়েতুল্লাহ, নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০১:২২, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬

আপডেট: ১৪:৪৩, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রিন্ট:

যেমন আছেন চুকনগর গণহত্যাস্থলে পাওয়া সেই ‘শিশু’

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

খুলনা : ভালো আছেন সেই সুন্দরী। একাত্তরের চুকনগর গণহত্যাস্থলে মৃত মায়ের বুকে দুধ পান করার চেষ্টা করছিলেন মাস ছয়েকের যে শিশুটি, একজন এরশাদ আলী যাকে পিতৃস্নেহে বড় করে তুলেছিলেন, সেই শিশু জীবনের নানা বাঁক ঘুরে বর্তমান সরকারের দেয়া একটি কাজের (চাকুরি) সুবাদে এক জায়গায় থিতু হয়েছেন।

খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরার সীমানায় খুলনার ডুমুরিয়ার চুকনগর। এখানে ভদ্রা ও ঘ্যাংরাইল নদীতীরে একটি বাজার। ১৯৭১এর ২০ মে এই নদীতীরের পাতাখোলা বিল, মন্দির, সড়ক প্রভৃতি জায়গায় ছিল জীবন নিয়ে ছুটে পালানো মানুষের ভিড়ে ঠাসা। বেলা দশটা নাগাদ সেখানেই হামলে পড়ে পাকিস্তানী সেনারা।

এদেশীয় সহযোগীদের সহায়তায় চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে পথযাত্রায় ক্লান্ত মানুষদের সেনারা পাখির মত গুলি করে হত্যা করে। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে, গাছে চড়ে, কোন আড়ালে লুকিয়ে পড়েও মানুষ বাঁচতে পারেনি। নৌকা ভর্তি মানুষকে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। বটগাছের শিকড়ের মধ্যে লুকানো মানুষকেও হত্যা করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সেখানে কমপক্ষে দশহাজার মানুষকে তারা হত্যা করে। পাতাখোলা বিলের মধ্যে হত্যার শিকার এক হতভাগ্য মায়ের বুকে পড়েছিল ফুটফুটে এক শিশু। দুধ পানের চেষ্টা করছিল। না পেয়ে তারস্বরে চিৎকার করছিল। সেই শব্দে এগিয়ে আসেন এরশাদ আলী মোড়ল। যিনি সেখানে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে হত্যার শিকার তাঁর পিতা চিকন আলী মোড়লের লাশ খুঁজছিলেন।

শিশুর কান্নায় এরশাদ আলি ক্ষণিকের জন্যে ভুলে যান তাঁর পিতার লাশ খোঁজার কথা। পরম মমতায় তুলে নেন দুগ্ধপোষ্য শিশুটিকে। দ্রুত বাড়ি ফেরেন। শিশুটিকে খাওয়ান। সুশ্রী ওই শিশুটির নাম দেন সুন্দরী। শিশুটির মায়ের কপালে সিঁদুরের চিহ্ন ও হাতের শাঁখা দেখে তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন সে হিন্দু ঘরের সন্তান, তাই তার এক প্রতিবেশী বন্ধু মান্দার দাশের পরিবারে রেখে শিশুটিকে বড় করেন। এরশাদ আলী পিতৃস্নেহে তাকে আগলে রাখেন।

সেই শিশুটি একদিন বড় হয়। নিত্য অভাবের সংসারে তার লেখাপড়া শেখা হয়নি। একদিন সুন্দরী বিয়ের উপযুক্ত হন। কিন্তু কে তাঁকে বিয়ে করবে! পিতৃ-মাতৃহীন এক শিশু, একজনের সহযোগিতায়, অন্য একজনের বাড়িতে যিনি বড় হয়েছেন, তিনিতো পাত্রী হিসেবে মোটেই গ্রহণযোগ্য নন। শেষ পর্যন্ত তাঁর বর জোটে ঋষি পরিবারের এক বিপত্নীক বাটুল দাশ। যে পরিবারে সতীনের দুটো সন্তান ছিল, নিত্যদিন গঞ্জনা ছিল, আর ছিল অসীম ক্ষুধা। পেটের জ্বালা মেটানোর জন্যে সুন্দরী পরের বাড়িতে কাজ করেছেন, দিনমজুরি করেছেন।

শিশু সুন্দরী একসময় মা হন। তার দুটো ছেলে। দিনমজুরি করেই ছেলেদের বড় করেছেন, স্বামীকে খাইয়েছেন। ছেলে দুটোকে লেখাপড়া শেখানোর সুযোগ হয়নি। তারা দিনমজুরি করেন। এক সময়ে দুই ছেলের বিয়ে দেন। ভাগ্য ফেরাতে বড় ছেলে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে পৃথক হন। ছোট ছেলে চলে যায় তার শ্বশুর বাড়ি। সুন্দরী বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে তাদের এক আত্মীয়ের দেয়া জমিতে ঘর বেঁধে পড়ে থাকেন। এক সময় মারা যান স্বামী বাটুল দাশ। সুন্দরী হয়ে পড়েন একা। কি করবেন! পেটের জ্বালা জুড়াতে, জীবিকার জন্যে ইটের ভাটায় কাজ নিয়ে এলাকা ছাড়েন। তা নিয়েও নানা অপবাদ জুটে।

তাঁর এই জীবন-সংগ্রামে সব-সময়ই পাশে ছিলেন এরশাদ আলী। তাঁর (এরশাদ) অর্থ-বিত্ত নেই। তবে হৃদয় আছে। সুন্দরীকে তিনি নিজের সন্তানের চেয়েও আপন ভাবেন। তেমনি পরামর্শ দেন। আর নানান সময়ে সুন্দরীকে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন চুকনগর গণহত্যা ’৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ এবিএম শফিকুল ইসলাম।

১৯৯৯-২০০০ সালের দিকে সুন্দরীকে নিয়ে প্রথম লেখালেখি হয়। দেশের অনেকে জানতে পারেন গণহত্যাস্থলে কুড়িয়ে পওয়া এক হতভাগ্য সুন্দরীর কথা। অনেকেই সহায়তার হাত বাড়ান। তবে অভাব ঘোচে না। বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে সুন্দরীকে ১১ শতক জমি লিখে দেয়া হয়েছে। সুন্দরী ওই জমির দলিল পেয়েছেন, তবে জমির দখল পাননি। বরাদ্দ দেয়া জমিটুকুর অর্ধেক অংশ একটি পুকুরের মধ্যে, কিছু অংশ পাশের একটি মসজিদের সীমানার মধ্যে, কিছু অংশ একটি মাছ কোম্পানির সীমানার মধ্যে।

বাকী দুই শতক জমি পড়ে আছে, তবে সেখানে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। তাই ওই জমির কাগজে-কলমের মালিক সুন্দরী হলেও তা তাঁর নিজের হয়নি। সরকারের পক্ষে স্থানীয় প্রশাসন জমির দলিল করেই দায় এড়িয়েছেন; জমির কি অবস্থা তা যেমন দেখেননি, তেমনি জমির দখলও বুঝে দেননি।

অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলামের সহায়তায় গত বছরের ২ ডিসেম্বর সুন্দরী ঢাকায় যান। তাঁরা দেখা করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকির সাথে। তিনি শিল্পকলা একাডেমিতে সুন্দরীর একটি চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন। এখন তাকে শিল্পকলা একাডেমি ডুমুরিয়া অফিসে বদলি করা হয়েছে। সরকারি কোয়ার্টারে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুন্দরীর এখন নতুন জীবন। সপ্তাহের সাতদিনই তিনি সকাল ৯টায় শিল্পকলা একাডেমির কলাপসিবল গেট খোলেন। অফিসে বসেন। আবার বিকেলে একাডেমি বন্ধ করে সরকারের দেয়া বাসায় ফেরেন।

চুকনগর গণহত্যার দিনে বেঁচে যাওয়া সুন্দরীর সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, আমার বাবা-মা কে, তা আমি জানি না। আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন এরশাদ আলী মোড়ল। যিনি আমাকে অন্যের বাড়িতে রেখে বড় করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী সবকিছু করেছেন। আমিও তাঁর কথামত চলার চেষ্টা করেছি। মনে রেখেছি এই দেশের জন্যেই আমার মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন জীবন দিয়েছেন।’

সুন্দরী কৃতজ্ঞ বর্তমান সরকার ও শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকির প্রতি। তাঁর ভাষায়, লাকি স্যার আমাকে কাজ দিয়েছেন, এটিই আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন; আমি এখন ভালো আছি।’

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer