Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৯ ১৪৩১, বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪

‘মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বহু না পাওয়ার কষ্ট লাঘব করবে’

আশরাফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭

আপডেট: ০১:০৮, ১১ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রিন্ট:

‘মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বহু না পাওয়ার কষ্ট লাঘব করবে’

ছবি : বহুমাত্রিক.কম

(পূর্ব প্রকাশের পর)
বহুমাত্রিক.কম : একাত্তরের সেই দিনগুলোতে গফরগাঁও-য়ের কথা শুনতে চাই আপনার কাছে। পাকিস্তানি জান্তাদের বীভৎসতার যে দৃশ্য আপনি দেখেছেন, বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে স্মৃতি এখনও কাতর করে আপনাকে-

মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল : ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সকাল সোয়া ৯টায় গফরগাঁও-এ বোমা পড়ে। আমাদের সংগ্রাম পরিষদের মিটিং হওয়ার কথা ছিল সকাল ১০টায়। আমি তখন ভাসনী-ন্যাপ করি। আওয়ামীলীগ থেকে তখন বেলাল, নজরুল, গফুর, মশাখালীর রাজ্জাক জং-চার খলিফা বলা হতো তাদের...। সেই সঙ্গে আলাল আহমেদ, বদরুল, মশাখালীর সালাম-আমরা সবাই মিটিংয়ে বসবো সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু সোয়া ৯টার সময়েই বোমাবর্ষণ শুরু হল। বীভৎসব দৃশ্য! আমি গফরগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে ঘুরতেছি-এরই মাঝে দেখলাম একটি বিমান আসতেছে।

প্রথমে ওই বিমানটিকে দেখলাম হলুদ রঙের কী ছেড়ে দিয়ে গেল। পেছন থেকে আরেকটি বিমান থেকে শেল নিক্ষেপ শুরু হল। প্রথম বোমাটা ফেলছে আবদুল ব্যাপারির বাড়ির গেটের কাছে। গেটের কাছে থাকা আবদুল ব্যাপারি বোমায় আক্রান্ত হন। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন-পানি পানি...। আমি তাকে ড্রেন থেকে তুলে পানি খাওনোর চেষ্টা করেও পারলাম না। তাকে দ্রুত নিয়ে গেলাম পুরান হাসপাতালে। ওইখানে নিয়ে যাওয়ার পরে যে ডাক্তার ছিল, সে দেখেই স্ট্রোক করে মারা যান। দ্বিতীয় বার যে বোমাবর্ষণ হয়-তাতে বহু মানুষ নিহত হন। লাশের ছড়াছড়ি, কোনো রাজনৈতিক নেতা-কর্মী কাউকে পায়নি। আমি, গোপাল বাবু, আনিস-এয়ারফোর্সে চাকরি করতো, ছাত্রলীগ করে পরবর্তীতে জাগপার সেক্রেটারিও হয়েছিল।

ঠিক করলাম যেভাবেই হোক মুমূর্ষ রোগীদের ময়মনসিংহে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। আনিসকে বললাম, একটি কামরা (রেলের বগি) আনতে। অনেক রোগীর মাঝে একজনের নাম এখনও মনে আছে-মিন্টু, জগদীশ বাবুর ভাতিজা। তার শরীরের এক পাশ দিয়ে শেল ঢুকে-অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আরেকজন আহত এয়ারফোর্সে লোক, পাকিস্তান থেকে আসছে-বোমাবর্ষণে তাঁর শরীরে শেল ঢুকে বড় আকারে বেরিয়ে গেছে। মরণাপন্ন অবস্থায় সে শুধু আমাকে বলছে, সুবল ভাই আমারে একটা রাইফেল দেন। আমি তখন রিক্সায় তুলে হাসাপাতালে পাঠিয়ে দিলাম।

এরই মধ্যে বহু লাশ পড়েছিল রাস্তায়। কোথাও শরীরের এক টুকরো মাংস, কোথাও হাত বা পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে-শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, সেগুলো আমি বস্তায় ভরে আমার করা গোরস্তানে নিয়ে মাটিচাপা দিই । সেইসব হতভাগ্য মানুষের মুখ আজও ভেসে উঠছে। তখন একজনের কথা মনে পড়ছে। পরিচিত মুখ যমুনার মা নামেই সে পরিচিত ছিল। বিশাল দেহের, পেশায় মেথর। বোমায় তার দু’টি স্তন উড়ে গেছে, মগজ বেরিয়ে গেছে-সাদা কাপড় পরনে ছিল, আমি তাকে চিনতে পারি। আমি সাদা কাপড় দিয়ে লাশটা ঢেকে শরীরের বিচ্ছিন্ন অংশগুলো তার কাপড়ের নীচে দিয়ে একটি ঢালি ওপের দিয়ে রাখি, যাতে কাপড় উড়ে না যায়।

বহুমাত্রিক.কম : কিভাবে শরণার্থী শিবিরে গেলেন-

মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল : ১৭ এপ্রিল রাতে গফরগাঁও থানার অস্ত্র লুট হয়, আমার তখন ভয় লাগলো। সেই সময় অরাজকতার সুযোগে লুটপাটও হচ্ছে। অনেকের মত আমিও শঙ্কিত হয়ে পড়ি জীবনের নিরাপত্তায়। বিশেষ করে গফরগাঁওয়ের রৌহা গ্রামের দু’জন লোকের ভয়ে ওইদিন রাতে ২টায় আমার মা, বাড়ির সব মেয়ে-ছেলে, আমার ভগ্নিপতির বাড়ি সাইন্দাইন মৌলনা সাবের বাড়িতে রেখে এলাম। তারপর যাত্রদলের হেমন্ত ঘোষ (বাড়ি ফরিদপুর) নামে একজনকে নিয়ে রাতেই হাটা শুরু করলাম ময়মনসিংহের পথ ধরে ডিবি রোড দিয়ে। হাটতে হাটতে ভোরে গিয়ে ময়মনসিংহে পৌছলাম। নদীর ওপাড় শম্ভুগঞ্জ পার হয়ে আবার হাটা শুরু করলাম। ১৮ এপ্রিল গিয়ে পৌছলাম ভারতের ডালুতে। সেখানে গিয়ে পেলাম গফরগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধা আলাল আহমদ-কে (শহীদ বেলাল আহমদের ভাই)। তিনি জানতে চাইলেন-কিভাবে এলাম। গফরগাঁওয়ের কী অবস্থা? সেখান থেকে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম। বাগমারা-মহিষখলা দিয়ে মধ্যনগর হয়ে শেলবরস-ধরমপাশায় এসে পৌছালাম। সেখানে এসে শুনতে পেলাম যাত্রা দলের অনেক মেয়ে-ছেলে, যাত্রার মালিককে আটকে রাখছে নদীর পাড়ে। নিজে নগন্য যাত্রদলের কর্মী হওয়ায় মায়া লাগলো-সেখানে আসলাম। কৌশলে সিদ কেটে তাদের মুক্ত করে নৌকাযোগে রাত্র ১২টার পর রওনা করলাম অজানা গন্তব্যে। চলতে চলতে মুক্তারপুর এসে পৌছালে ডাকাতদলের কবলে পড়ি আমরা। মেয়েদের সব স্বর্ণালঙ্কার আমার কাছে রাখা-১ কেজির মতো হবে। ডাকাতরা ঘেরাও দিলে আমি প্যান্টের নীচে জাঙ্গিয়ার ভেতরে সব ভরলাম, ডাকাতরা কাছাকাছি এলে আমি নদীতে ঝাঁপ দিলাম।

ডাকাতরা নৌকায় তেমন কিছু পায়নি, সামান্য কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে ছেড়ে দেয়। আমি সাঁতারাতে সাঁতরাতে অনেকদূর চলে আছি। পরের দিন নাগরপুর গ্রামে এসে উঠি। হিন্দু বসতি এলাকা। জানতে পারলাম ওই গ্রামেই হেমদাশের বাড়িতে যাত্রার লোকজন এসেছে। সেখানে গিয়ে সবার স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে দিলাম। শুনলাম ওই এলাকোতে পাঞ্জাবিরা নৌকায় টহল দিচ্ছে। আমরা সেখান থেকে ১৮ মে হিন্দুপল্লীর মানুষ ও যাত্রার মেয়েছেলেদের নিয়ে নৌকাযোগে চলে এলাম বাদাঘাট। ওপাড় উঠলাম বটছড়া। সেখান থেকে হেটে ওয়ারাংকা পৌছলাম। ওই এলাকায় লোকবসতি খুবই কম। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে বন্যপ্রাণিদের কবল থেকে বাঁচতে মাইক ছেড়ে দিলাম কয়েকটা। জুলাইয়ে স্রোতের মত মানুষ আসা শুরু করল বাংলাদেশ থেকে। এই স্রোত আগস্ট-অক্টোবর পর্যন্ত চললো। নভেম্বরের শেষের দিকে একটি গ্রুপ গেল। কলেরা-ডায়েরিয়া তখন ব্যাপক ভাবে লেগেছে শরণার্থী শিবিরগুলোতে। আমাকে তখন ইন্ডিয়ান রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি ও রাশিয়ান মেডিক্যাল টিম আমাকে নিয়ে গেল-স্যালাইন কিভাবে তৈরি করতে হয়, স্যালাইন কিভাবে পুশ করতে হয়-এইগুলো শেখাতে। আমি স্যালাইন পুশ করা, স্যালাইন দেওয়ার কাজ করতে থাকলাম শরণার্থী শিবিরগুলোতে। আহত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা যারা আসছে তাদেরকেও স্যালাইন দিলাম আবার মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে বেশি আসছে শরণার্থী হাজার হাজার, তাদেরকেও সেবা দিতে থাকলাম। শিলং থেকে পাহাড়ি খাসিয়া এক মেয়ে কিছু কিছু স্যালাইন এনে দিত। আমাদের ভেতরে যাত্রাদলের সুরকার ছিলেন গোপাল দত্ত। তখন তিনি শুধু যাত্রার সুরকার নন, রেডিও ও টেলিভিশনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গাইতেন। সেই গোপাল দত্তের অসুখ হল, আমি তখন স্যালাইন দিলাম। আর শশ্রুষা করল গৌরাঙ্গ আদিত্য, যে নেত্রোকোনায় যাকে সূর্যসন্তান হিসেবে অভিষিক্ত করা হয়েছিল। গোপাল দত্ত সুস্থ হয়ে উঠলেন। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে অরানকা, মলাই, পানছড়া-এই তিনটি ক্যাম্পে চললো আমাদের এই সেবাদান। নভেম্বরের শেষের দিকে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র নিয়ে ঢুকছে-আমার মাথায় গোটা ৩০টি স্যালাইন। হঠাৎ চেয়ে দেখে ওই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ফজলু (পরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার) গফরগাঁওয়ের নিগুয়ারী বাড়ি, সলিম চেয়ারম্যান, মফিজুল চেয়ারম্যানসহ আরও অনেকে। তাদের কাছে শুনলাম গফরগাঁওকে শেষ করে দিয়েছে পাক হানাদার বাহিনী। সব পুড়িয়ে দিয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল।

জানতে চাইলাম তোমরা কেন এসেছো? তারা বললো-গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা এসেছেন। অরানকা ছাড়িয়ে পানছড়া যেতেই বিএসএফ কমান্ডার তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে ফেলে। অ্যারেস্ট করে বালাট ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ওই ক্যাম্পের চার্জে তখন হামিদ ভাই, ইটনা-মিঠামইনের এমপি, আমাদের বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। জানতে পারলাম বিএসএফ কমান্ডার বি আর খান (বশির খান) ও থানা ইনচার্জ নাগ বাবু মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যারেস্ট করেছেন। আমি বললাম এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামীলীগ করে গোলাবারুদ শেষ হওয়ায় তারা আসছে, তাদের কেন অ্যারেস্ট করেছেন? কর্মকর্তারা বললেন, উপরে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি-এখন তো আর ছাড়া যাবে না। তখন গিয়ে দেখি চতুর্দিকে দিয়ে ক্যাম্প করে কাটাতারের বেড়ার মধ্যে রাখা হয়েছে। তারপর আমি এটা নিয়ে কলকাতায় থাকা আমাদের গফরগাঁওয়ের এমপি আবুল হাশেম, যিনি তখন কলকাতার সার্কাস রোডে থাকতেন-তাকে চিঠি লিখলাম। চিঠির জবাবে তিনি জানালেন, তিনি অসুস্থ তারপরও বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কাছে বার্তাটি পৌছে দিবেন তিনি। পরবর্তীতে তারা মুক্তি পান।

বহুমাত্রিক.কম : সেই সময়ে আপনার সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা বলে কোনটিকে বর্ণনা করবেন আপনি?

মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল : ১৬ ডিসেম্বর বিএসএফ কমান্ডার বি আর খান, সেখানকার রানী রেজিনা ও বিএসএফ ইনচার্জ নাগ বাবু এসে আমাকে বললেন, আজকে আপনার দেশের এমপি হামিদ সাহেব বক্তৃতা দেবেন মৈলামে, আপনাকে লোকজন নিয়ে যেতে হবে সেখানে। আমি ওয়ারাংকা, মলাই ও পানছড়া ক্যাম্প থেকে হাজার তিনেক লোক নিয়ে বিকাল চারটার দিকে উপস্থিত হলাম। বালাট ক্যাম্প থেকে আবদুল হামিদ এই ক্যাম্পে আসবেন। বেলা ৪ থেকে সন্ধ্যা ৭টা পেরিয়ে যাচ্ছে, তবু তিনি আসছন না। আমি সেই ঐতিহাসিক মিটিংটি পরিচালনা করছি। ৪০ জনের বক্তৃতা। ৭টার পর হঠাৎ বিআর খান এসে বললেন, ওই যে তোমাদের নেতা আসছেন। তখন আমি মাইকে তাকে স্বাগত জানালাম। উপস্থিতদের মাঝে ঘোষণা দিলাম, এখন আপনাদের মাঝে বক্তৃতা দেবেন স্বাধীন বাংলাদেশের এমপি আবদুল হামিদ। আমরা দেশে ফিরে গিয়ে কী কী কাজ করব তার নির্দেশনাও চাইলাম তার কাছে। বলতে পারি, স্বাধীন বাংলাদেশে এমপি আবদুল হামিদ সাহেবের ওইটাই ছিল প্রথম ভাষণ।

বহুমাত্রিক.কম : এত ঘটনার সাক্ষী হয়ে, এত অবদান রেখেও কেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি আপনি?

মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল : আমারও প্রশ্ন, এত শ্রম দিলাম-পরিশ্রম করলাম-আমি কেন মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট পেলাম না। আমি দারিদ্রের সঙ্গে নির্মমভাবে জর্জরিত। ১০ বছর চেয়ারম্যান ছিলাম, টাকা কামাই নি। আমার এখন চার লাখ টাকা ঋণ, ছেলেমেয়েরা খেতে পায় না। চিকিৎসা করাতে পারছি না। আজ ৮৪ বছরে পা রেখেছি। অনেকে মুক্তিযোদ্ধা ছিল না, অথচ তারা আজ দাবি করে। আমাকে একটি সনদপত্র দিয়েছেন এমপি হাশেম সাহেব। এছাড়া বিএসএফ কমান্ডার বি আর খনসহ তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে আমাকে প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন। কিন্ত দুর্ভাগ্য নদীতে লঞ্চডুবি হয়ে ওইসব কাগজপত্র সব হারিয়ে গেছে। হাশেম ভাইকে (সাবেক এমপি আবুল হাশেম) বলার পর তিনি বললেন, তুমি মুক্তিযোদ্ধা। যেখানে বলা লাগবে বলে দেব। একই কথা বললেন মুক্তিযোদ্ধা আলাল আহমদ। বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সলিম বলছিলেন, সুবল ভাই মুক্তিযোদ্ধা না হলে আমরা কেউ মুক্তিযোদ্ধা না। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতির জন্য কাগজপত্র সাবমিট করেছিলাম, কিন্তু মামলা করে দেওয়ায় এখন যাচাই বাছাই কার্যক্রম স্থগিত আছে।

মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে আমার জিজ্ঞাসা, আমি মুক্তিযুদ্ধের সময়গুলোতে অতন্দ্র প্রহরীর মত বাঘ-ভল্লুকের ভয়ভীতি সত্ত্বেও হাজার হাজার শরণার্থীর সেবা দিয়েছি-মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছি, আমি কী মুক্তিযোদ্ধা না? সেই সময়ে কোনো অবদান না রেখেও বহুজনকে সার্টিফিকেট পেতে দেখি, তাহলে আমি কেন পাব না? তাই এই শেষ জীবনে অন্তিম সময়ে আমার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটটা চাই।

বহুমাত্রিক.কম : বহুমানুষকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আপনি। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আপনার স্বীকৃতি এখন হবে কেন? সমস্যাটি কোথায়?

মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল : আবেদন আগেও একবার করেছি নাজমুল কমান্ডার থাকার সময়ে। সে আমার আবেদন ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। প্রতিহিংসা। আমি মুক্তিযোদ্ধা হলে হয়ত কমান্ডার হয়ে যেতে পারি-সেই ভয়। তবে সব শেষ করা আবেদনে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আলাল ভাইও আমার জন্য লিখেছেন। তার জন্যই অপেক্ষা।

বহুমাত্রিক.কম : মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল অবদান, বিশেষ করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সারিয়ে তুলতে আশ্রয় ক্যাম্পে আপনার সেবাদানের কথা তো সর্বজনবিদিত। তা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পেতে আর কী ধরণের বৈরী অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন-

মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল : এই স্বীকৃতির বিষয়ে আসলে বহুদিন নিজেই উদাসীন ছিলাম। বহুজনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেতে আমিই সহযোগিতা করেছি, নিজের কথা ভাবিনি। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় বার্ধক্যের প্রান্তে দাঁড়িয়ে যখন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিকে দরকার মনে করেছি তখন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির বিষয়ে সবাই আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। আজকের দিনের মনে পড়ে সেইসব দিনগুলো কথা। একাত্তরের কথা। কিন্তু হিসেব মিলাতে পারি না। নিজেই নিজেকে শান্ত¡না দিই, সারা জীবন দেশের জন্য-মানুষের জন্য লড়লেও জীবন সায়াহ্নে নিজের জন্যই লড়তে হচ্ছে। সে লড়াই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি হয়ত বহু না পাওয়ার কষ্টকে কিছুটা হলেও লাঘব করবে।

বহুমাত্রিক.কম : আমরা জানি এক দশক জনপ্রতিনিধিত্ব করে এবং তারও আগে বহুদশক ধরে আপনি পীড়িত-দুঃস্থ মানুষদের সেবা করে আসছেন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবন আপনার-নিতান্তই কুঁড়েঘরে বসবাস

মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল : আসলে আমার অহংকার করার মত এটাই আছে। আমি কোনো দুর্নীতি করিনি, নিজে বিত্তবান হওয়ার চেষ্টা করিনি। কুঁড়েঘর আমার অহংকার। এই কুঁড়েঘরে মওলানা ভাসানীর মতো নেতা, কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন, ক্যাপ্টেন হালিমসহ বহু বরেণ্য রাজনীতিবিদ এসেছেন।

বহুমাত্রিক.কম : জনপ্রতিনিধি হিসাবে গফরগাঁওয়ের সালটিয়া ইউনিয়নের কী কী উন্নয়ন আপনার হাত ধরে হয়েছে-

মীর মোনায়েম সালেহীন সুবল : গফরগাঁওয়ের বিশ্বরোডের যে ব্রিজটি চরাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করেছে, তার বাস্তবায়নটি আমার নেতৃত্বেই হয়েছে, তবে এর মূল অবদান লোকমান হাকিমের। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী আমি কাজ করেছি। গফরগাঁও-ভালুকা সড়ক এরশাদ সরকারের আমলে ৫ কোটি টাকা আমিই অনুমোদন করিয়েছি। গফরগাঁও আদর্শ শিশু নিকেতন স্কুল আমার হাতে গড়া। গোরস্তান যেগুলো রয়েছে, রেলের ও অন্যান্য সেগুলোর আমার অবদান। আমি নিজে হাজারো মানুষের দাফন করেছি। ভারতে শরণার্থী শিবিরে যা শিখে এসেছিলাম-১৯৭৩-৭৪ ও ৭৫ সালে তা কাজে লাগিয়েছি। তখন দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ মারা যান-তাদের দাফন করেছি। এছাড়া জীবনের প্রতিটি দিনই কোনো না কোনোভাবে জনকল্যাণে কাজ করে গেছি-আমৃত্যু করে চাই।

রাষ্ট্রপতির কাছেই মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি চান মীর সুবল

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer