Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

মুক্তমত মানেই যা ইচ্ছে তা লেখা নয়

নাসিমা হুসেইন মুক্তা

প্রকাশিত: ০০:১০, ২০ নভেম্বর ২০১৬

আপডেট: ০০:১৯, ২০ নভেম্বর ২০১৬

প্রিন্ট:

মুক্তমত মানেই যা ইচ্ছে তা লেখা নয়

নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে: নিউইয়োর্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিউমেন রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট’ এ বিবিএ করার সময় আমার মাইনর ছিল ‘আর্ট’। অর্থাৎ কোন ছাত্র-ছাত্রী যদি পাশ করে তার মেজর সংক্রান্ত কোন চাকুরি না পায় অন্তত যেন মাইনর বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। সেজন্যে মাইনর বিষয়টিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

মাইনরের সুবাদে আমাকে আর্টের উপরে অনেকগুলো ক্লাস নিতে হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ক্লাস ছিল ‘আর্ট ইন নিউইয়োর্ক সিটি’। এই ক্লাসটি কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হতো না। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে তিন ঘন্টার এই ক্লাসটির মুল উদ্দেশ্যই ছিল সিটির বিভিন্ন আর্ট মিউজিয়াম, ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফ সেন্টার অথবা আর্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্থা ভিজিট করা। আর হোমওয়ার্ক ছিল যা দেখেছি তার উপরে তিন চার পাতার ক্রিয়েটিভ রচনা লিখে টাইপ করে পরের সপ্তাহে জমা দেয়া।

চার মাসের সেমিস্টারের শেষ ক্লাসটি ছিল নিউইয়োর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রাইটিং সেন্টার’ এর ‘ফেয়ার’ ভিজিট করা। এই ফেয়ারে উপস্থিত অতিথিরা ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন কালচারের (সংস্কৃতির) ছাত্র লেখক এবং শিক্ষক লেখকরা।

বর্গাকৃতি এই ফেয়ারের কোথাও একগুচ্ছ ছাত্র-ছাত্রী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লেখকদের (যারা লেখার টেকনিক জানে) লিখালিখি সম্পর্কে কৌতুহলী বিভিন্ন প্রশ্ন করছে, কোথাও একগুচ্ছ আফ্রিকান ছাত্র-ছাত্রী মিউজিক্যাল যন্ত্র নিয়ে তাদের সংস্কৃতির গান গেয়ে তাদের স্বাধীনতাকে তুলে ধরছে। আবার কোথাও একগুচ্ছ ইউরোপীয় ছাত্র-ছাত্রী মাইকেল এ্যাঞ্জেলো, রাফায়েল অথবা লিউনার্দো দা ভিঞ্চিকে নিয়ে মাতামাতি করছে। এই ফেয়ারের মূল লক্ষ্যই ছিল নতুন লেখকদের মুক্তপ্রাণে লিখায় উৎসাহী করা।

‘মুক্ত লিখা’ এর মানেটা একটু পরিষ্কার করি। এ ক্ষেত্রে আমাকেই উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করব। যেমন, বাংলাদেশের নোয়াখালীর ফেনীতে আমার জন্ম আর আমার বাবা মায়ের জন্মস্থান কুমিল্লায়। আমাকে বলা হলো, এই দুটি স্থানের মধ্যে কোনটি তোমার প্রিয় এবং কেন তা লিখ। তো আমি লিখলাম, আমার প্রিয় স্থান ফেনী এবং কারণ হিসেবে লিখলাম ছোট্ট এই শহরটি আমার জন্মস্থান। এটিই আমার কাছে ইমোশনাল এবং তার মূল্য অনেক। কেউ এখানে যুক্তি দাঁড় করাবেনা যে, আমার কুমিল্লাকেই প্রিয় বলা উচিত ছিল, কারণ সেখানে আমার বাবা মায়ের জন্ম হয়েছে।

আর ‘টেকনিক’ মানে হলো, লেখার সময় কতগুলো পদ্ধতি অবলম্বন করছি কিনা। অন্য অর্থে, আমি যা লিখছি তা প্রমাণ করতে পারব কিনা। এক্ষেত্রে, আমাকে প্রমাণ করতে হবে ফেনী নোয়াখালিতে অবস্থিত কিনা, এই শহরটি ছোট কিনা এবং আমার বার্থ সার্টিফিকেটে জন্মস্থান হিসেবে ফেনীর নাম উল্লেখ আছে কিনা। আর তা পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে ইনক্রেডিবল সোর্স (বই, ম্যাগাজিন, পত্রিকা, অনলাইন কলাম) সাপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করেছি কিনা।

সবশেষে ঠিকমত বিব্লিওগ্রাফি অর্থাৎ যে সোর্স ব্যবহার করেছি তাতে লেখকের নাম, কলামের শিরোনাম, তারিখ এবং স্থান যেখানে কলাম, ম্যাগাজিন বা বইটি ছাপা হয়েছে তার নিয়মমাফিক উল্লেখ দিয়ে আমার লিখাটি লিখেছি কিনা তা এর আওতায় পড়ে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ও কবি আনিসুল হক তাঁর ‘মা’ বইয়ের সপ্তম পাতার `দ্বিতীয় সংস্করণের ভুমিকা`য় লিখেছেন, ‘‘উপন্যাসের ব্যাপারে আমি একটা পুরনো সূত্র এখনও মাথা থেকে তাড়াতে পারিনা-- কি বলা হলো তার চেয়েও কিভাবে বলা হলো, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।’’ এখানে আমি যে টেকনিকের কথা উল্লেখ করেছি, লেখক তারই ইঙ্গিত করেছেন।

মুক্ত লেখা মানে যা ইচ্ছে তা লেখা কিংবা কাউকে হুমকি দেয়া নয়। এসব চরমপন্থীদের লেখা কেউ খায়না এবং তাদের কেউ চেনেও না।

আহা কি আনন্দই না সেদিন পেয়েছিলাম। এদেশে কি অফুরন্ত স্বাধীনতা কথা বলার আর লেখার। সেই আনন্দের অনুভূতিটুকু বুকে নিয়ে যখন ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছিলাম তখন বুঝতে পারলাম মন আমার আস্তে আস্তে ভারাক্রান্ত হয়ে আসছিল। ভারাক্রান্ত হয়ে আসছিল এই ভেবে যে, বাংলাদেশে কোন কোন লেখক ওই চরমপন্থীদের হুমকির চাপে চিরদিনের জন্যে দেশছাড়া হয়। আবার কেউ কেউ যা খুশি তাই লিখে, কোনরকম নিয়ম কানুন অবলম্বন না করেই। সবকিছুই হয়ত সম্ভব ওই দেশে।

আমি পরের সপ্তাহে হোমওয়ার্ক করতে লেখা রচনার উপসংহারে লিখেছিলাম, আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং গর্বিত এদেশের নাগরিক হয়ে। এদেশ আমাকে কথা বলার ও লেখার স্বাধীনতা দিয়েছে। কিছু লেখার কারণে এদেশ থেকে আমাকে কখনো বের করে দেয়া হবেনা। এদেশের সরকার যেমন তার মৌলিক অধিকার পাচ্ছে, ঠিক একইরকম ভাবে আমিও পুরণ করছি আমার মৌলিক অধিকার। এদেশ আমার মেধার মুল্য দিয়েছে। আমি আমার আয়ের উপযুক্ত পরিমাণ কর সরকারকে দিচ্ছি তার বিনিময়ে সরকার আমার নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ বিভিন্ন পাবলিক সার্ভিস দিচ্ছে।

আমি জানি এবং মানি বাংলাদেশেও এমন লেখক জন্মেছেন বা আছেন, যাদের লেখা মানুষ খায়, পড়ে, সেই লেখা দিয়ে স্নান করে এবং তা বুকে জড়িয়ে ঘুুমিয়ে পড়ে। এমন লেখক মরেও চিরকাল বেঁচে থাকবেন-এই বাংলা তথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer