Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

মাশরুমের খোঁজে শালবনের পথে

শাবাব মেহেবুব

প্রকাশিত: ০০:২৫, ২০ জুন ২০১৬

আপডেট: ০৩:৫৪, ২২ আগস্ট ২০১৬

প্রিন্ট:

মাশরুমের খোঁজে শালবনের পথে

ছবি-লেখক

ঢাকা : শিক্ষাজীবনে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার সঞ্চয় করে এলাম আজ, যা নিয়ে এক রকম রোমাঞ্চ গত রাত থেকেই ভর করেছিল। বলছিলাম হাতেকলমে শিক্ষা ও গবেষণায় খুব দরকারি এক সফরের কথা, যাকে আনন্দঘন এক ভ্রমণও বললেও ভুল হবে না।

সফরে আমার সঙ্গী ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল বিভাগের আমার একদল সহপাঠি।   রোববার সকাল ৬ টা। আষাঢের এ সকালে সবাই নিজ নিজ বাসা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সকাল সাড়ে ৭টায় ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল এবং জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের ১০ জন ছাত্রছাত্রী একত্রিত হই রাজধানীর উত্তরার রাজলক্ষ্মীর মার্কেটের সামনে।

আমাদের প্রথম গন্তব্য গাজীপুরের সালনায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। দ্বিতীয় গন্তব্য ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান। 

যথাসময়ে বাসযোগে প্রথম গন্তব্য বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে রওনা করি আমরা। পর্যাপ্ত আসন ফাঁকা না থাকায় মেয়েদেরকে বসতে দিয়ে আমরা দাঁড়িয়েই যাত্রা শুরু করল। অল্প কিছুক্ষণ পর অবশেষে আসন পেল ছেলেরাও। ঘন্টায় আমরা পৌছে গেলাম গাজীপুর চৌরাস্তা।

এখান থেকে আমাদের চার লেনের নয়নাভিরাম মহাসড়ক ধরে আমাদের গন্তব্যে পৌছাতে লেগোনা-টেম্পুকেই অবলম্বন করতে হল। সকাল ৯টায় আমরা পৌছে যাই আমাদের প্রথম গন্তব্য বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সুন্দর-পরিপাটি গোছানো ক্যাম্পাস দেখে সবাই মুগ্ধ, যেন প্রথম দর্শনে প্রেমের পড়ার মতো।

এই মুগ্ধতার মধ্যেই দ্বিতীয় গন্তব্য ভাওয়াল বনে যেতে আমাদের টিমে যুক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের ১০ জন অগ্রজ ভাইয়া এবং আপু। এবার আমাদের যাত্রা শুরু হল। টেম্পুতে করে শাহসূফী ফসিহ্ মাজার, পোড়াবাড়ি পার হয়ে চলে এলাম মাষ্টারবাড়ী। এখান থেকে পায়ে হেঁটেই ভাওয়াল জাতীয় বনে পৌছাব আমরা। ঢাকা থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শালবনের জৌলুস আগের মতো না থাকলেও এ বনই এককালের ঘনগভীর বিশাল ভাওয়াল বনাঞ্চলের অস্তিত্বকে স্বগৌরবে জানান দিচ্ছে।

একসময়ের বিপুল উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যর আধার এই ভাওয়াল বনের অনেক কিছু বিপন্ন হলেও এখনো হাজারো প্রাণবৈচিত্র্যর সন্ধান মিলবে এখানে। আমাদের অধ্যয়ন ও আগামীদিনের গবেষণার বিষয়ের সাথে যুক্ত এমনি এক উপাদানের সন্ধানে এখানে আসা আমাদের।

ঘড়িতে তখন ৯ টা বেজে ৩৫ মিনিট, ২০ সদস্যের দল নিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম শালবনের ভিতরে। বনে ঢুকতেই সুন্দর বনজ এক গন্ধ পেলাম, যা মনে এক বিশেষ আবহ তৈরী করে রাখলো দীর্ঘক্ষণ।

বনের মধ্যে তেমন চলার পথ নেই, নতুন শাল-গজারি গাছ জন্মিয়েছে আর তাদেরকে পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছে অনেক লতাপাতা। মাটিতে শ্যাওলা পড়ে বনের পথকে পিচ্ছিল আর দুর্গম করে তুলেছে।সাবধানতার সাথে হাঁটছি আমরা সবাই। কয়েকজন পিছলে পড়েই যাচ্ছিল। এরই মাঝে পাখিদের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কি যেন ডেকে উঠছে "চি চি চিচি", তবে তা সন্মূখে এতে তার অস্তিত্ব জানা দিল না।

আমদের উদ্দেশ্য শালবন থেকে আবিষ্কৃত বাংলাদেশি ৪ প্রজাতির মাশরুম খুজে বের করা।’বড়ফুটুস ঢাকানুস’, যার আবিষ্কারক বাংলাদেশী গবেষক ইকবাল হোসেন।(ভাওয়াল বনে মিললো বিরল মাশরুম) রাহী ভাই এবং পলাশ ভাই সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কিভাবে আমরা মাশরুমগুলোকে দেখে শনাক্ত করব। আমাদের হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিলেন যার মধ্যে ৪ প্রজাতির মাশরুমের ছবি আছে। আমরা ৫ টি দলে ভাগ হয়ে কাজ শুরু করলাম।

অনেক খোঁজাখুজি চলছে কিন্তু নির্দিষ্ট মাশরুমগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। আমি ছিলাম উত্তরদিকে একটি দলে। যার সদস্য হলেন, মাহমুদ ভাই, মহসিন, দেলয়ার ভাই এবং আমি।খুঁজতে খুঁজতে অন্য সবার থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি আমরা। এসব নিয়ে আমরা চিন্তিত নই।

হঠাৎ কান ফাটানো একটা চিৎকার! "পাইছিইইইই"...। শেষ পর্যন্ত আমাদের দলটি খুজে পেল "বড়ফুটুস ঢাকানুস" মাশরুম। তবে তার সাথে ফ্রি-তে পেলাম বড় বড় পিপড়ার কামড়। 

বনের ভিতর কিছুটা ঠান্ডা হলেও, অনেকটা ভিতরের আবহাওয়া গুমোট প্রকৃতির। তাই সবাই ঘেমে একাকার। ঘণ্টা পর দলের সবাই এক হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া হল। রোজা রেখে এই আবহাওয়ার মধ্যে আমরা অনেক ক্লান্ত। এতটাই ক্লান্ত যে চোখে সব কিছু ঘোলা দেখছি। মনে মনে ভাবছি রোজা ভেঙ্গেই ফেলবো।কিন্তু ভাঙ্গা হয় নাই।

আমি আর মাহমুদ ভাই আলাদা হয়ে মাশরুম খোঁজার কাজ চালিয়ে গেলাম। আস্তে আস্তে আমরা ২ জন আরো গভীরে চলে গিয়েছি। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম আর একটি প্রজাতির মাশরুম "আমানিতা"। এর মাঝে দলনেতার ফোন! আমরা এখনি ফিরে যাব। দুপুর সাড়ে ১২ টায় ফিরে এলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের মেয়ে সহপাঠিদের অবস্থা অনেকটাই কাহিল।

সবাই চলে গেল হলে বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে। আমি আর মাহমুদ ভাই চলে এলাম ল্যাবে। ল্যাবে এসে বন থেকে তুলে আনা মাশরুমগুলোকে ২০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখার জন্যে কাজ করে চললাম। দুপুর ২ টা আমাদের সব কাজ শেষ। বিশ্রামের জন্যে চলে আসলাম গ্রাজুয়েটদের হলে।

বিকেল ৫ টা অবধি আমার কোন হুঁশ নেই। বেঘোরে ঘুমাচ্ছি। হটাত ফোন পেয়ে উঠে পড়লাম।পল্লব ভাই ফোন দিয়েছেন ’নিচে আসো’। এরপর বাকিদেরকে ফোন দিয়ে সবাই একত্রিত হলাম।

বাকি সবার মুখে শুনলাম তারা কি করেছে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। রাহাত, মিজান এবং মুরাদ ভাইয়ের মুখে শুনলাম তারা নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরে গোসল করেছে কিন্তু তারা আমাকে ডাকে নাই। শুনে কষ্ট পেলাম। তবুও আনন্দের কি শেষ ছিল? সবাই মিলে ফাল্গুনী আপু আর শাওন ভাইয়ের সাথে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে দেখলাম। অসাধারণ পরিবেশ আর প্রকৃতি যেন বলছে থেকে যাও, শুনে যাও।

ইফতারের জন্য আর মাত্র ৫০ মিনিট বাকি। আমরা প্রবেশ করলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের ল্যাবে। ল্যাবের অধুনিক সব যন্ত্রপাতির বর্ণনা দিলেন পল্লব ভাই এবং রাশেদুল ভাই। গমের ব্লাস্ট রোগের উপর প্রেজেন্টেশন দিয়ে আমাদেরকে খুব ভালভাবে একটি ধারণা দিয়ে দিলেন পল্লব ভাই। ওদিক হতে অনবরত ফোন আসছে রাহী ভাইয়ের। কোথায় তোমারা? তাড়াতাড়ি আসো!

যেয়ে দেখি ঘাসের উপর ইফতারি নিয়ে বসে আছেন বড় ভাইয়েরা। ঘাস গুলো এমন পুরু যে, মনে হচ্ছে ঘাসের কার্পেট। সবাই বসে পড়লাম ইফতারির জন্যে। এইভাবে খোলা আকাশের নিচে এমন পরিবেশে কখন ইফতারি আগে করিনি।

এত পিপাসা নিয়ে রোজা না ভেঙ্গে এবং এমন পরিবেশে ইফতারি করে মনটাই ভরে গেল। ইফতারি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে ৭ টার বাসে তুলে দিলেন বড় ভাইয়েরা। চলে এলাম সব আনন্দের উৎসবকে ছেড়ে।

বাস থেকে নেমে পড়লাম গাজীপুর চৌরাস্তায়। এবার যার যার বাসার দিকে রওনা হলাম। শেষ হল একটি দিন। তবে এই দিনটি কখন জীবন থেকে মুছে যাবে নয়।

লেখক: ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী। 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer