Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

মাগুরছড়া ট্রাজেডির ২১ বছর : ক্ষতিপূরণের দাবিতে মানববন্ধন

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৩:০৬, ১৫ জুন ২০১৮

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

মাগুরছড়া ট্রাজেডির ২১ বছর : ক্ষতিপূরণের দাবিতে মানববন্ধন

ছবি : বহুমাত্রিক.কম

মৌলভীবাজার : বৃহস্পতিবার ১৪ জুন পূর্ণ হচ্ছে মাগুরছড়া গ্যাস কূপ বিস্ফোরণের ২১ বছরপূর্তি। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়ায় মার্কিন অক্সিডেন্টাল কোম্পানি গ্যাসকূপ খননের সময় ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন ভয়াবহ বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

১৪ জুন বৃহস্পতিবার মাগুরছড়া বিস্ফোরনের ২১ তম দিবসে বেলা ১ টায় শ্রীমঙ্গলস্থ পাহাড় রক্ষা সোসাইটি মাগুরছড়ায় দুর্ঘটনা কবলিত এলাকায় ও বেলা ২টায় কমলগঞ্জ উপজেলা চৌমুহনায় কমলগঞ্জ উন্নয়ন পরিষদ পৃথক পৃথক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।

শ্রীমঙ্গলস্থ পাহাড় রক্ষা সোসাইটির মানববন্ধন চলাকালে বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন, শ্রীমঙ্গলস্থ পাহাড় রক্ষা সোসাইটির চেয়ারম্যান মোঃ সালাহউদ্দীন আহমদ, মৌলভীবাজার পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী, প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ প্রমুখ। কমলগঞ্জ উন্নয়ন পরিষদ এর মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন কমলগঞ্জ উন্নয়ন পরিষদ এর সভাপতি এম.এ.ওয়াহিদ রুলু, নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ, পিন্টু দেবনাথ প্রমুখ।

মার্কিন অক্সিডেন্টাল কোম্পানির ড্রিলিং চলাকালে ১৯৯৭ সনের ১৪ জুন মধ্য রাত ১টায় কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া গ্যাস কূপে ভয়াবহ বিষ্ফোরণে বন, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, রেল ও সড়কপথ, পানজুম, বিদ্যুৎ লাইনসহ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও বন বিভাগ কোন ক্ষতিপুরণ পায়নি। বন ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি দীর্ঘ ২১ বছরেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রতি বছর ১৪ জুন আসে আর যায়। তবে বন ও পরিবেশের ক্ষতিপুরন আদায়ে কার্যকরী কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, লাউয়াছড়া ফরেষ্ট বিটের অভ্যন্তরে মাগুরছড়া এলাকায় ১৯৮৪-৮৬ ও ১৯৯৪ সালের দায়িত্ব পায় যুক্তরাষ্ট্রের তেল গ্যাস উত্তোলনকারী অক্সিডেন্টাল কোম্পানী। দায়িত্ব গ্রহণের পর অক্সিডেন্টাল গ্যাস ফিল্ডের ড্রিলিং কাজের জন্য সাবলিজ প্রদান করে ডিউটেক নামের জার্মান কোম্পানীর কাছে। ১৪ নং ব্লকের মাগুরছড়াস্থ মৌলভীবাজার-১ গ্যাসকূপ খননকালে বিষ্ফোরণে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের পরিবেশের জীববৈচিত্র্য, রেল ও সড়কপথ, ফুলবাড়ি চা বাগান, খাসিয়া পুঞ্জির বাড়িঘর ও পান জুম, পিডিবির ৩৩ হাজার বিদ্যূৎ লাইনের। পরোক্ষভাবে ২৮টি চা বাগান সহ ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়া ২শ’ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়, যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার।

মাগুরছড়ার সাথেই লাউয়াছড়া জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বনে শত বছর ধরে বৃক্ষ লতাগুল্ম বেড়ে উঠা বিচিত্র বহু বর্ণের বন্য অর্কিড, পরগাছার নিবিড় সান্নিধ্যে মায়ামৃগ, ভাল্লুক, উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান, চশমা পড়া বানর, চিতাবাঘ, মথুরা, বুনোমুরগী, ধানেশ, অজগর, দাঁড়াস, কেউটে, সুতানলী, ব্যাঙ গিরকিট, তক্ষক, পেঁচা আর নাম না জানা হাজারো কীটপতঙ্গ যার একটি বৃহদ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৯৯৭ সনে মাগুরছড়া দুর্ঘটনার দাবানলে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের ফলে লতাম, গুল্ম, বহু উদ্ভিদ এবং বিভিন্ন কীট-পতঙ্গ ও ছোট প্রাণী হারিয়ে যাওয়ায় এখন পর্যন্ত বড় বড় প্রাণীগুলোকে খাবার সংকটে ভুগতে হচ্ছে।

দূর্ঘটনার দুই বছরের মধ্যে ফুলবাড়ি চা বাগানের ক্ষতিগ্রস্ত টি প্ল্যান্টেশন এলাকার ক্ষতিপূরণ, খাসিয়া পুঞ্জির ক্ষয়ক্ষতি বাবদ ২ কোটি ৫ লাখ টাকা দাবীর মধ্যে ৫০ লাখ টাকা ও বাস মালিক সমিতিকে ২৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। ২০০৮ সালে মাগুরছড়া ও লাউয়াছড়ায় শেভরন ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্নকালে বিভিন্ন এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়।

বন বিভাগের হিসাবমতে প্রত্যক্ষ ক্ষতি ৩২ দশমিক ৫৩ কোটি এবং অন্যান্য ক্ষতি মিলিয়ে মোট ১৭৬ দশমিক ৯৭ কোটি টাকা। এই সময়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় পুরো হিসাব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬০৯ কোটি টাকা নিরূপন করে অক্সিডেন্টালের কাছে দাবি জানায়। দুর্ঘটনার সময়ে তৎকালীন অওয়ামীলীগ সরকারের খনিজ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার পর কমিটি ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পেশ করেছিল। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী অক্সিডেন্টালের দায়ীত্বহীনতাকেই দায়ী করা হয়।

মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিসন প্রধান সুচিয়ান বলেন, এ ঘটনার মধ্যদিয়ে প্রাকৃতিক বনের যে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারবে না। আমরা যারা এই বনে বসবাস করছি তা বুঝতে পারছি। সিলেট বিভাগীয় বন্যপ্রাণী বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, বনের ১৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি নিরূপন করে দেয়া হলে এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মাগুরছড়া দুর্ঘটনায় শুধু পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে ৬শ’ কোটি টাকা। ১৯৯৯ সালের আগষ্ট মাসে অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া গ্যাসকূপসহ তাদের ব্যবসা মার্কিনের অন্য কোম্পানী ইউনিকলের কাছে হস্তান্তর করে। ইউনিকল দায়িত্ব নেয়ার পর ক্ষতিপূরন বিষয়ে টালবাহানা শুরু করে। ২০০৮ সনের ত্রি-মাত্রিক ভূ-ত্বাত্তিক জরিপ অনুয়ায়ী কমলগঞ্জের পাত্রখোলা চা বাগান থেকে দেওড়াছড়া চা বাগান এলাকা পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকায় ৫ শতাংশ এলাকায় গ্যাস রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির দেয়া এক রিপোর্টে জানা যায়, লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্টের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা গ্যাসের আগুনে ক্ষতি হয়। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ২০ দশমিক ৫০ একর এলাকা। ক্ষতির পরিমান ৫ কোটি টাকা। একইভাবে ৪১.৫০ একরের ২২.৮২৫ ঘনফুট গাছ-গাছালিরও আংশিক ক্ষতি ধরা হয়। সব মিলিয়ে পুড়ে যাওয়া গ্যাস, ক্ষতিগ্রস্ত বন ও পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি আদায়ে মার্কিন কোম্পানী সমূহের টাল বাহানায় মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরনের ২১ বছরে ৩ কোম্পানীর হাত বদলের মধ্য দিয়ে এখনও শেভরন পার্শ্ববর্তী স্থান থেকে গ্যাস উত্তোলন করলেও পুুরো ক্ষতিপূরণ আদায়ে কোন পদক্ষেপ আজও গৃহীত হয়নি।

বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু মুসা সামসুল মোহিত চৌধুরী বলেন, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরনে ক্ষতিপূরণ আদায় হয়নি। বন ও পরিবেশের এই ক্ষতিপূরণ আদায় হওয়া আমাদেরও দাবি।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer