Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৩ ১৪৩০, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪

‘মা-বোনের সম্ভ্রম রক্ষায় বড় শিক্ষা ইয়াসমীন ট্রাজেডি’

নাজমুল ইসলাম নয়ন, দিনাজপুর প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০১:২৯, ২৫ আগস্ট ২০১৬

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

‘মা-বোনের সম্ভ্রম রক্ষায় বড় শিক্ষা ইয়াসমীন ট্রাজেডি’

ছবি-বহুমাত্রিক.কম

দিনাজপুর : ইয়াসমীন ট্রাজেডির ২১তম দিবসকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক এই আন্দোলনের সুচনাকারী নেতা মনোরঞ্জন শীল গোপাল এমপি বলেছেন, আন্দোলনটা আমরা শুরু করেছিলাম। দিনাজপুরের আপামর জনতা আমাদের সাথে যুক্ত হয়ে আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতিতে পৌছায়।

ইয়াসমীন ট্রাজেডির ২১তম দিবসে বহুমাত্রিক.কম-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন তিনি।

কেমন করে সেই দিনগুলোতে জনআন্দোলন সফলতা পেয়েছিল-জানতে চাইলে মনোরঞ্জন শীল গোপাল বলেন, সে সময়ের গণঅভ্যূত্থান অন্ততপক্ষে সমগ্র বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিল। মর্যাদা রক্ষার জন্য দিনাজপুর পারে এবং মর্যাদা রক্ষায় দিনাজপুরের মানুষ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পারে।

স্বাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, ইয়াসমীন আন্দোলন বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলের আন্দোলন ছিল না। এ আন্দোলন ছিল সমগ্র দিনাজপুরবাসীর আন্দোলন। যার কারণে তদানীন্তন সরকার বাধ্য হয়েছিল জনতার দাবি মেনে নিতে। যদিও তারা দাবিগুলো বাস্তবায়ন করেনি।

তিনি বলেন, ৮ দফা দাবি মেনে নিয়ে তৎকালীন সরকার প্রধানের প্রতিনিধি তদানীন্তন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী প্রয়াত কর্ণেল আকবর হোসেন এসে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়। তিনি আরো বলেন, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষা নিয়েছে বোনের, মায়ের সম্ভ্রম কি ভাবে রক্ষা করতে হয়। আমরা সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি উদাহরণ।

আন্দোলন সুচনালগ্নের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনাটি দশমাইলে প্রথম শোনবার পরে দশমাইলের সাহসী মানুষদের নিয়ে প্রথম প্রতিবাদ সমাবেশ করে এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করি। সেই সভাতেই ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেয়া হয়-এর মধ্যে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার দাবি জানানো হয়। কিন্তু তদানীন্তন পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা পাল্টা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করবার অপকৌশল অবলম্বন করলে এবং আমাকে ব্যাক্তিগতভাবে হুমকি-ধামকি প্রদান করলে আমরা দিনাজপুরের মানুষ হিসেবে বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করি।

আন্দোলনের সফলতা সম্পর্কে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য গোপাল বলেন, আমরা আন্দোলনে সফলতা অর্জন করেছি। এই আন্দোলন একটি মাইলফলক। আমরা দিনাজপুর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি-দিনাজপুরের সম্মান মর্যাদার জন্য কিভাবে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।

বিচার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমরা বিচার পেয়েছি। বিচারের রায়ে ৩ অপরাধীর যথার্থ শাস্তি হয়েছে। এ বিচারের বিষয়ে আইনী সহায়তা দিতে যিনি অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি হলেন সংবিধান প্রণেতা সাবেক সাংসদ এ্যাডঃ আব্দুর রহিম। দিনাজপুর জেলা দায়রা জজ আদালত থেকে মামলাটি রংপুর দায়রা জজ আদালতে নিয়ে যাওয়া হলে প্রতি নিজ উদ্যোগে তিনি উপস্থিত থাকতেন। বিচারিক বিষয়ে জনাব এম আব্দুর রহিমের প্রতি দিনাজপুরবাসী কৃতজ্ঞ।

ইয়াসমীন আন্দোলনের পরবর্তী সময় একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে আন্দোলন সুচনাকারী নেতা হিসেবে আপনার নাম নাই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটাও একটা ইতিহাস। দিনাজপুরবাসী জানে-কারা আন্দোলন করেছিল। ইতিহাস বিকৃতি করে প্রকৃত ইতিহাসকে দাবিয়ে রাখা যায় না। একদিন সত্য প্রকাশ পাবেই। তাছাড়া দিনাজপুরবাসী তো জানেই।

আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সরকারের কি ভূমিকা ছিল ? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার কথা দিয়ে কথা রাখেনি। তারা ৮ দফার ভিত্তিতে সমঝোতা করলেও একটি শর্ত তারা পূরণ করেনি। ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রথমেই জনতার উপরে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করে অপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেন। যার প্রেক্ষিতে অপরাধীরা যথার্থ শাস্তি পেয়েছে। মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ১৩ টি মামলা হয়েছিল জনগনের বিরূদ্ধে। যার মধ্যে ৯টিতে আমাকে আসামী করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, আন্দোলনে আমাদের অর্জন থাকলেও কিছু ব্যর্থতার মধ্যে আমরা এখনো ক্ষতিগ্রস্থ-নিহতদের পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিলেও যথারীতি পূণর্বাসন করা সম্ভব হয়নি। আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে- সারা দেশে ২৪ আগষ্ট নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালিত হচ্ছে। ইয়াসমীন এখন সারা বিশ্বে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের একটি প্রতীক। তার মানে আমরা বলছি না যে, এখনও সে ধরণের ঘটনা ঘটে না।

ধর্ষণ-হত্যা ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের করনীয় কি ? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আইন দিয়ে ধর্ষণ-হত্যা ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা সম্ভব না। তাই সামাজিক আন্দোলন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

ইয়াসমীন আন্দোলনের সার্বিক সফলতা বা আমাদের অর্জন কি? প্রশ্নের উত্তরে মনোরঞ্জন শীল গোপাল বলেন, অর্জন তো অবশ্যই আছে। আমরা মেয়েদের সম্মান রক্ষার জন্য একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। এ দৃষ্টান্ত আগামী দিনের পাথেয় হবে। শুধু তাই নয়, দিনাজপুর এখন ইয়াসমীন এখন নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রতীক হিসেবে সারা বিশে^ পরিচিত একটি নাম। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদকারী হিসেবে দিনাজপুর জেলার মানুষের মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই আন্দোলনের আপনার জীবনের কোন ঝুঁকি ছিল কি না শেষ এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তদানীন্তত সরকারের মদদপুষ্ট বিপদগামীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, ঝুঁকি তো থাকবেই। সে সময় আমাদের সুযোগমত পেলে হয়তো হত্যা করা হতো। কিন্তু দিনাজপুরের প্রতিবাদি মানুষ সেই সময়ে বিএনপি সরকারের সকল ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে দিয়েছে। দিনাজপুরের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে আমরা শান্তিপ্রিয় কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদকারী।

সেদিন যা ঘটেছিল

১৯৯৫ সালের ২৪ আগষ্ট ভোরে ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী হাছনা এন্টারপ্রাইজ নৈশ কোচ-এর সুপার ভাইজার ইয়াসমিন নামে এক তরুণীকে দিনাজপুরের দশমাইল মোড়ে নামিয়ে দেয় এবং এক চায়ের দোকানদারকে বলে সকাল হলে তরুণীটিকে যেন দিনাজপুর শহরগামী বাসে উঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সেখানে পৌছে নৈশ্য টহল পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান।

পুলিশ সদস্যরা চায়ের দোকানে বেঞ্চে বসে থাকা তরুণী ইয়াসমিনকে নানা প্রশ্ন করে এক পর্যায়ে দিনাজপুর শহরে পৌছে দেয়ার কথা বলে জোরপূর্বক পুলিশ ভ্যানে তুলে নেয়। এরপর তারা দশমাইল সংলগ্ন সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ রাস্তার পাশে ফেলে রেখে চলে যায়।

এ ঘটনায় দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে দোষীদের শাস্তির দাবি করা হয়। ২৬ আগষ্ট রাতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী জনতা কোতয়ালী থানা ঘেরাও করে। ২৭ আগষ্ট সকাল থেকে প্রতিবাদী মানুষেরা শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে।

দুপুর ১২টার দিকে কয়েক হাজার জনতা বিক্ষোভ মিছিল সহকারে দোষীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি প্রদান করতে যায়। এ সময় পুলিশ বিনা উস্কানিতে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে ৭ জনকে হত্যা করে। আহত হয় প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ। শহরের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শহরে ১৪৪ ধারা (কার্ফূ) জারি করা হয়। শহরে নামানো হয় বিডিআর। দিনাজপুর থেকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি ৩টি আদালতে ১শ’ ২৩ দিন বিচার কাজ শেষে ১৯৯৭ সালের ৩১ আগষ্ট রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মতিন মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার রায়ে আসামী পুলিশের এ,এস,আই মঈনুল, কনষ্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পুলিশের পিকআপ ভ্যান চালক অমৃত লাল বর্ম্মনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান ‘৯৫-এর ৬ (৪) ধারায় ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন।

আলামত নষ্ট, সত্য গোপন ও অসহযোগিতার অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় এ,এম,আই মঈনুলকে আরো ৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। অপর দিকে দন্ডবিধির ২০১/৩৪ ধারায় আলামত নষ্ট, সত্য গোপন, অসহযোগিতার অভিযোগে অভিযুক্ত আসামী দিনাজপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেব, ডাঃ মহসীন, এসআই মাহতাব, এসআই স্বপন চক্রবর্তী, এ,এস আই মতিয়ার, এসআই জাহাঙ্গীর-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত না হওয়ায় আদালত তাদের খালাস দেন।

চাঞ্চল্যকর ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলার দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় ৮ বছর পর অর্থাৎ ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। মামলার অন্যতম আসামী এ.এস.আই মইনুল হক, পিতা-জসিমউদ্দীন, গ্রাম-বিশ্রামপাড়া, উপজেলা-পলাশবাড়ী, জেলা-গাইবান্ধা ও কনষ্টেবল আব্দুস সাত্তার, পিতা-এস.এম খতিবুর রহমান, গ্রাম-চন্দনখানা, উপজেলা-ডোমার, জেলা-নীলফামারীকে রংপুর জেলা কারাগারের অভ্যন্তরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় ১ সেপ্টেম্বর ’০৪ মধ্য রাত ১২টা ১ মিনিটে। অপর আসামী পিকআপ ভ্যান চালক অমৃত লাল বর্মন, পিতা-লক্ষীকান্ত বর্মন, গ্রাম-রাজপুর, উপজেলা-সদর, জেলা-নীলফামারীকে রংপুর জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয় ২৯ সেপ্টেম্বর ’০৪ মধ্য রাত ১২টা ১ মিনিটে।

প্রতি বছর দিনাজপুরে সর্বদলীয়ভাবে দিবসটিকে পালনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। প্রতিবারের ন্যায় এবারও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, ২৪ আগষ্ট দিনাজপুর শহরের প্রতিটি ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাচ ধারণ ও শোক র‌্যালি। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পৃথক পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

নিহত ইয়াসমিনের মা শরীফা বেগম ২৪ আগষ্ট তার বাড়িতে ফকির, মিসকিনদের মাঝে খাদ্য বিতরণ ও দোয়া খায়ের-এর আয়োজন করেছেন।

এছাড়াও দিবসটি পালনে ইয়াসমীন আন্দোলনের প্রথম প্রতিবাদকারী ও আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বর্তমানে দিনাজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল প্রতিবারের ন্যায় এবারো ব্যাপক কর্মসুচি পালনের কর্মসুচি গ্রহণ করেছেন।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer