Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৪ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪

মন্তব্য প্রতিবেদন : ভোলায় ভেজাল মশলা ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম

ফয়সল বিন ইসলাম নয়ন

প্রকাশিত: ০১:৪৬, ১৮ আগস্ট ২০১৮

আপডেট: ০১:৫২, ১৮ আগস্ট ২০১৮

প্রিন্ট:

মন্তব্য প্রতিবেদন : ভোলায় ভেজাল মশলা ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম

ছবি : বহুমাত্রিক.কম

ভোলা :  আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে হলুদ ও মরিচ না হলেই নয়। সেই হলুদ ও মরিচে যখন ভেজাল দেয়। বিশেষ করে ইটের গুড়া, পচা চাউল, পচা ডাইল নয় হলুদ-মরিচের শুকনো গাছগুলো গুড়ো করে বাজারে বিক্রির জন্য পাঠায়। তখন এই হারাম বা বিষাক্ত পণ্য না খেয়ে পারছিনা।

এই বিষ খেয়েই আমরা বেঁচে আছি। আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগে বাসা বাধে এ ভেজাল পণ্যের কারণে। অথচ আমাদের চোখের সামনে এসব ভেজাল খাদ্যদ্রব্য তৈরী হচ্ছে। প্রশাসন ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারছিনা।

ভোলা সদর উপজেলার লাখো মানুষ মাত্র ৬ জন অবৈধ হলুদ-মরিচ গুড়া ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মী। এরা এতটাই শক্তিশালী যে, এদেরকে আটকিয়ে তো রাখা যাই না’ ছাড়া পেয়ে ঘুরে-ফিরে একই কাজ করে।

ভোলা সদর উপজেলাতেই নয়, বরং পুরো জেলা এমনকি জেলার বাহিরে রয়েছে এদের সিন্ডিকেট। মাত্র ৬ জন অবৈধ হলুদ-মরিচের গুড়োয় ভেজাল মিশানো ব্যবসায়ীর কাছে ভোলার মানুষ জিম্মি হয়ে থাকবে ? এরা এতটাই শক্তিশালী যে, এদের কাছে প্রশাসন অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে।

জনমনে এখন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আগের এডিএম ছিল বিতর্কিত, কিন্তু এখনকার সৎ, নিষ্ঠাবান এডিএম দ্বারা এ অবৈধ ব্যবসায়ীদেরকে পাকড়াও করা সম্ভব। আজ ধর্য্যর শেষ প্রান্তে এসে পড়েছে। প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে, জনগণই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে এবং রুখে দাঁড়াবে। এদের এতটাই ক্ষমতা যে, এরা এ অবৈধ কাজগুলো লোকের সামনেই করে। এটা এখন ওপেন সিক্রেট।

এ অবৈধ ব্যবসায়ীরা একদিকে মানুষের জীবন নাশের ক্ষতি করে, অন্যদিকে সরকারকে লাখ লাখ টাকা (টেক্স) ঠকাচ্ছে। আমরা সেসব ব্যক্তিদের কথা বলছি, যারা আপনার-আমার সকলের পরিচিত, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছি না। না পারার কারণে দিনে দিনে হলুদ-মরিচের সাথে ভেজাল বৃদ্ধি করেই চলছে।

অবৈধ ব্যবায়ীদের অন্যতম খালপাড়ের (স্টারসিপ ফারুক), হাসান রাইস এন্ড ফ্লাওয়ার মিল, ইয়াপি এন্টার প্রাইজ এন্ড ফ্লাওয়ার মিল (জিলাদার), তুলাতুলির শরীফ হলুদের গুড়া’র বাছেদ, ভোলা বাস টার্মিনালের আনোয়ারা মিলের সাহাবুদ্দিন ও সার্কুলার রোডের মুন্সির মিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে ধুরন্দর স্টারসিপ ফারুক। তার মিলের কোন সাইনবোর্ড নেই। খালপাড়ের ইলিয়াছ মিয়া মাঠের এক কোনে তার মিল। এমন এক জায়গায়, কেউ না দেখলে বিশ্বাস করবে না, এখানে ভেজাল হলুদ-মরিচের মিল। মোবাইল কোটের টিম আসার আগেই সে জেনে যায়। তার হাত নাকি অনেক বড়।

ফারুক বলেন, আসছে ঈদে ২ হাজার মন হলুদ-মরিচ সাপ্লাই দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কথা হয় খালপাড়ের ইয়াপি এন্টারপ্রাইজ এন্ড ফ্লাওয়ার মিলের মালিক মজিবরের সাথে। ইয়াপি’র পরিবর্তে জিলাদার নামের সাইবোর্ড উঠালেন কেন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ব্যবসা করতে হলে মাঝে মধ্যে এগুলো করতে হয়। তার টেনশন নেই।

দেদারসে মাল তৈরী করছেন আর বিক্রি করছেন। কেউ কোন বাঁধা দিচ্ছে না। তারও ঈদকে সামনে নিয়ে মহা পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, জরিমানা দিব, ব্যবসাও করবো।

হাসান রাইস মিল এন্ড ফ্লাওয়ার মিলের মালিক হাসানকে পাওয়া যায়নি। তিনি ফোনও রিসিভ করেন নি। তাই তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তিনিও এর আগে জরিমানা খেয়েছেন। তারপরও এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করেন নি।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে খালপাড়ের এক ব্যবসায়ী বলেন, ২ বছর আগে এই হাসান রাস্তায় রাস্তায় হাটতো। এখন হলুদ-মরিচের সাথে ভেজাল দিয়ে আজ রাতারাতি কোটিপতি। যে হাসানের সাইকেল ছিল না, সে এখন ২ লাখ টাকা দামের পালসার হোন্ডা চালায়। মোবাইল কোর্ট জরিমানা করলে হাসানের এ অবৈধ কাজের পরিধি দ্বিগুন বেড়ে যায়।

ভোলার আরেক ভেজাল ব্যবসায়ী হচ্ছেন তুলাতুলির ‘শরীফ হলুদের মিল’র মালিক মো: বাছেদ। তিনি তুলাতুলি ব্যবসা রেখে, ভোলার খালপাড়ে দোকান নিচ্ছেন। আগে যে পরিমানে করতেন, এখন তার দ্বিগুন করার জন্য খালপাড়ের বাসু মিয়ার ঘর নিচ্ছেন। বাছেদের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ভাই আমার বক্তব্য নিয়ে কোন লাভ নাই, আমি ভোলার সকল ঘাট ম্যানেজ করেই ব্যবসা করি। কাজেই আমার ব্যবসা আপনি বন্ধ করতে পারবেন না।

সার্কুলার রোডের মুন্সির মিলের চিত্র ভিন্ন। সে এটতাই চালাক, তাকে ধরা কারোর ক্ষমতা নেই। সে সকলের সামনেই হলুদ-মরিচে ভেজাল মিশাবে, তা কেউ বুঝতে এবং ধরতে পারবে না।

ভোলা বাস টার্মিনালের আনোয়ারা মিলের মালিক হচ্ছেন সাহাবুদ্দিন। তার ব্যবসা সকলের চোখে পড়াতে বাস টার্মিনালের পূর্বপাশে আধা কিলোমিটার ভিতরে তার নিজ বাড়ীর দরজায় মসজিদের পাশে মিল তৈরী করেন। তিনি খুব চতুর। তাই ধরা দেন না।

অনুসন্ধানে গেলে দেখা যায়, লাইনে লাইনে রিক্সা দিয়ে মাল আসছে এবং আবার তা যাচ্ছে। তার সাথে কথা বললে তিনি জানান, আগে বেশি ভেজাল দিতাম, এখন একটু কম দেই। তাছাড়া এবার হজ্জ্বে যাবতো, তাই ভেজাল কমিয়ে দিয়েছি।

তিনি আরো বলেন, আরে ভাই মানুষে আমার কাছে নিয়ে আসে, আমি কি করবো। ভোলা জেলা ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মো: সুলাইমান এব্যাপারে বলেন, ভেজাল খাদ্যই বলেন আর ভেজাল পণ্যই বলেন, পণ্যে মোরক না দেয়া সবই একই অপরাধে অপরাধী।

সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদন্ড, ২ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে। লোকবলের অভাবে আমরা সরাসরি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারছি না। প্রশাসন থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে আমাদেরকে জানালে তখন আমরা যাই। তবে এবার মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হবে খুব কড়া-কড়ি ভাবে, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এমনটাই জানালেন ভোলা ভোক্তা অধিকারের সহকারী পরিচালক মো: মাহমুদুল হাসান।

এব্যাপারে হলুদ-মরিচে ভেজাল দেয়ার বিষয়ে ভোলা স্বাস্থ্য বিভাগের সিভিল সার্জন ডা. রথিন্দ্রনাথ মজুমদারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বলেন, হলুদ-মরিচের সাথে যাদি ক্যামিকেলসহ অন্য কোন পদার্থ কিংবা ভেজাল মিশানো হয়, তাহলে সেটা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর এতে কোন সন্দেহ নাই। এতে আমাদের পাকস্থলি, খাদ্য নালি, লিভার, কিডনিসহ বিভিন্ন সাইটে সমস্যা তৈরীর সাথে সাথে ক্যান্সার পর্যন্তও হতে পারে। আমরা সেনেটারি ইন্সপেক্টর দিয়ে হলুদ-মরিচের প্যাকেট এনে টেস্টের জন্য ল্যাবে পাঠাই। ভেজাল প্রমাণিত হলে সাথে সাথে মামলা দিয়ে দেই। তার সাথে কোন আপোষ করি না।

এব্যাপারে ভোলার প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম সিদ্দিকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অনিয়ম-অন্যায়ের সাথে কখনোই আপোষ করবো না। আমরা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেব।

উল্লেখ্য, গত ১৯ মে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট খান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন ভোক্তা অধিকার আইনে ৩৪ ও ৪৩ ধারায় হাসান রাইন এন্ড ফ্লাওয়ার মিলকে ২০ হাজার এবং ইয়াপি এন্টারপ্রাইজ এন্ড ফ্লাওয়ার মিল (বর্তমানে জিলাদার) কে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন।

ফয়সল বিন ইসলাম নয়ন : ভোলা প্রতিনিধি, বহুমাত্রিক.কম

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer