Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৩ ১৪৩০, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪

ভয়ঙ্কর ‘ধুড়’ সিন্ডিকেটে পাচার হচ্ছে হাজারো নারী ও শিশু

কাজী রকিবুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১০:২২, ১ মার্চ ২০১৮

আপডেট: ১৪:০৯, ১ মার্চ ২০১৮

প্রিন্ট:

ভয়ঙ্কর ‘ধুড়’ সিন্ডিকেটে পাচার হচ্ছে হাজারো নারী ও শিশু

ছবি : সংগৃহীত

যশোর : প্রায় দুই মাস আগে প্রশাসনের এক কর্মকর্তার নিজ গ্রামের অসহায় এক লোক তার মেয়েকে চিকিৎসা করানোর জন্য ভারতে যাবেন বলে বিআরটিসি পরিবহনে উঠেছেন বরিশাল থেকে। বাসটি যশোর পুরাতন বাসটার্মিনাল এলাকায় পৌছানোর আগেই মুড়লি মোড়ে তাদেরকে নামিয়ে নেয়া হয়েছে। মুড়লি মোড়ে বাস দাঁড়াতে দ্রুত গতিতে তিনজন বাসের মধ্যে উঠেই মেয়েটিসহ তার পিতাকে নামিয়ে আনা হয়। চিকিৎসার জন্য ভারতে যাবেন-টার্মিনাল পর্যন্ত যাওয়া লাগবে না। এখন থেকে আপনাদেরকে বাসে উঠিয়ে দেয়া হবে। এখন ২ হাজার টাকা দেন। টাকা নেই বলতেই তেড়ে উঠেন। হুমকি ধামকি দিতে থাকে প্রায় আধা ঘন্টা ধরে।

-সর্বশেষ ৭শ’ টাকায় শান্ত হয় ধুড়পাচারকারী (অবৈধপন্থায় ভারতে অনুপ্রবেশকে আঞ্চলিকভাবে ‘ধুড়’ নামে ডাকা হয়, সাধারণত নিন্মআয়ের মানুষেরাই এই প্রক্রিয়ায় গমনাগমনের ঝুঁকি নেয়) চক্র। ইতোমধ্যে মোবাইলে সংবাদ পেয়ে প্রশাসনের ওই কর্মকর্তার অফিসের একজন অফিসার ঘটনাস্থলে পৌছলেই পালিয়ে যায় তারা। এর মধ্যে তাদেরকে গুণতে হয়েছে ৭শ’ টাকা। এভাবে চলছে আকবারের নেতৃত্বে ধুড় পাচার সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা।

প্রশাসনের নিরবতার কারণে আকবারের নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জনের সিন্ডিকেটের ধুড় পাচার বহাল তবিয়তে কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আকবরের নেতৃত্বে যশোর শহরের ৪ জন, বাস টার্মিনাল এলাকার ২ জন, পুরাতন বাসটার্মিনাল এলাকার ২ জন ঝিকরগাছার ২ জন, শার্শার ৩ জন, চৌগাছার ২ জন, নড়াইলের ১ জন, ফরিদপুরের ২ জন, বরিশালের ৪ জন, মাদারীপুর এলাকার ২ জন ধড় পাচারকারী সক্রিয় ভাবে কাজ করছে। প্রশাসনকে খুশি করে এসব সিন্ডিকেট টপকিয়ে ধুড় আকবার এ নেতৃত্বে এসেছেন বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন আকবার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, কুয়াকাটা, যশোর, ঝিকরগাছা বেনাপোলসহ এ অঞ্চলের বাস টার্মিনালগুলোতে ধুড় পাচার সিন্ডিকেটের ব্যাপক তৎপরতা রয়েছে। প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে ২০ সদস্যের ধুড় পাচার সিন্ডিকেট প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ভারতগামীদের অবৈধভাবে পারাপার করেও তারা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদের কাছে বেনাপোল বা শার্শায় যাওয়া সাধারণ মানুষও জিম্মি হয়ে পড়ছে। বরিশাল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, কুয়াকাটা, যশোর থেকে আসা বাসগুলো তলøাসী করে পাসপোর্ট নেই এমন যাত্রীদের জিম্মি করছে। মাথাপ্রতি ৫ শ’ থেকে ৭ শ’ ও ১ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি।

প্রায় দুই ডজন খানেকের একটি টিম নিয়ে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে বিভিন্ন জেলার ধুড় সিন্ডিকেটের প্রধানরা। অপ্রতিরোধ্য স্টাইলে এই কারবার করে চলেছে প্রতিনিয়ত পুলিশের সামনেই। প্রতিদিন সকাল থেকে যশোর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ও পুরাতন বাসটার্মিনাল (মনিহার) বাস শ্রমিকের পাশাপাশি ডজনখানেক যুবক বরিশাল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, যশোর, ঝিকরগাছা বেনাপোলসহ টার্মিনালের কয়েকটি পরিবহন টার্গেট করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে অবৈধপথে ভারতে গমনেচ্ছুক লোকজন এদের টার্গেট। বরিশাল, কুয়াকাটা, টেকেরহাট, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ঝালকাটি, পিরোজপুর, খুলনা, ফরিদপুর, নড়াইল থেকে বিনা পাসপোর্টে ভারত যাওয়ার জন্য বেনাপোলগামী বাসে ওঠে। কে লাইন পরিবহন, জিএম পরিবহন ও সীমান্ত একপ্রেস, আশিক সাগর, বিআরটিসি, ফেম, রানা পরিবহনসহ ডজনখানেক পরিবহনে এসব যাত্রী বেশি থাকে।

যে বাসগুলো ভারতের দিকে যায় তার সবগুলোতে শকুনের মত চোখ থাকে এই চক্রের সদস্যদের। বাসে উঠেই বাক বিতন্ডা করে যাত্রীর মালামাল টানাটানি ও তল্পিতল্পা ফেলে দেয়ার পরিবেশ তৈরী করে পাসপোর্টবিহীনদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। অনেকেই এসময় তাদেরকে পুলিশের সিভিলটিমের লোক মনে করেন। পাসপোর্টবিহীন ভারতগামী যাত্রী ছাড়াও ঝিকরগাছা শার্শা বেনাপোলগামী যাত্রীরাও এই চক্রের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাসপোর্ট নেই গন্ধ পেলেই তার কাছ থেকে ছিনতাই করার স্টাইলে টাকা নেয়া হচ্ছে। আর পাসপোর্ট না থাকায় ওইসব যাত্রীরা নীরবে টাকা দিয়ে দেয়।

এভাবে চলে আসছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। চক্রটির পোষাক পরিচ্ছদও ভিন্ন আঙ্গিকে। দেখলেই বোঝা যাবে বিশেষ বাহিনীর সদস্য’র লোক। তারা টার্মিনাল এলাকায় রাস্তা ও বাসে চলে হেলে দুলে। চিলের মত ছোঁ মেরে যাত্রীর মানি ব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টাকা নিচ্ছে ওরা।

বাসের সুপারভাইজারদের সাথে রয়েছে এই চক্রের সখ্যতা। প্রতিদিন শতাধিক যাত্রীর কাছ থেকে চক্রটি অর্থ বাণিজ্য করে। বাইপাস সড়ক ও শহরতলীর বিভিন্ন সড়কেও থাকে এদের সোর্স। যারা খবর দিয়ে দেয় কে ধুড়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আসা যাওয়া করা যাত্রীদের বেশ-ভূষা দেখে তারা আঁচ করে নেয় কে ভারতগামী।

সূত্র জানিয়েছে, এই ধড় সিন্ডিকেটের কেউ কেউ ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা কারবারের সাথেও জড়িত। এই সিন্ডিকেটের কারবার প্রশাসন জানলেও অজ্ঞাত কারণে তারা নীরবতা পালন করছে। বিপুল সংখ্যক লোক বিনা পাসপোর্টে ভারত যাওয়ার কারণে ধুড় সিন্ডিকেট লাভবান হলেও সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে।

পুলিশ প্রশাসনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ধুড় পাচারের তিনি খোঁজ খবর নেবেন। তিনি জানান, বিনা পাসপোর্টে ভারত যাওয়া যেমন দেশের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি তাদের জিম্মি করে কোনো চক্র আর্থিক সুবিধা নেবে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওই চক্রের অপতৎপরতা রুখতে পুলিশ কঠোর অবস্থানে থাকবে।

ধুড় সিন্ডিকেটের প্রধান আকবর বলেন, সবার পক্ষে পাসপোর্ট করা সম্ভব হয় না। যারা করতে পারে না। তাদেরকে সহযোগিতা করি। প্রশাসন কোন ঝামেলা করে না। সবাইকে সন্তুষ্ট রেখেই আমি এবং আমার লোকজন এ কাজ করে থাকি। সিন্ডিকেটের প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন এমন বক্তব্যে তিনি বলেন, বক্তব্যটা সঠিক নয় তবে, প্রশাসনের লোকজনের সাথে আমার কমবেশি বেশি জানা শোনা আছে। তাই আমাকে তারা সবাই বড় ভাই হিসেবে মানেন। কেউ কোন ঝামেলা পড়লে আমি এগিয়ে যাই।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer