Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৯ ১৪৩১, মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪

ভারত ভ্রমণ : বিশ্ব দেখার অভিজ্ঞতা যখন একসাথে

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ০২:২০, ২৫ জুন ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

ভারত ভ্রমণ : বিশ্ব দেখার অভিজ্ঞতা যখন একসাথে


এক.
আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী ভারতে বেড়ানোর জন্য দূর-দূরান্তের অনেক দেশের ভ্রমণ পিপাসুরা চলে আসেন সেদেশের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য। এবারে (২০১৬ সালে) পবিত্র ঈদুল ফিতরের সময় ভিসা দেওয়া সহজীকরণ হিসেবে বিশেষ পর্যটন ভিসা প্রদান ক্যাম্পেইনে বাংলাদেশী পর্যটকদের জন্য প্রায় ৫০ হাজার ভিসা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে অনেকে খুব সহজেই ঈদের ছুটিতে ভারতে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন। আর প্রদত্ত ভিসার মেয়াদ একবছর এবং মাল্টিপল প্রকৃতির হওয়ায় সেটা দিয়ে কোরবানির ঈদসহ সারাবছরই বেড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

ভারত শুধু পর্যটনের জন্য নয়, অনেক কারণে আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর এবং মাত্র ২৮৩ কিলোমিটারের মিয়ানমার সীমান্ত বাদ দিলে বাংলাদেশের তিনদিকের প্রায় চার সহ¯্রাধিক কিলোমিটারের সাথে আমাদের দেশের অনেক কিছু জড়িত। তাছাড়া বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের ওপাড়ে ভারতের সাতটি প্রদেশ রয়েছে, যেগুলোকে সেভেন সিস্টার্স বলা হয়ে থাকে।

সেজন্য প্রয়োজনটা দুপক্ষেরই। ব্যবসা-বাণিজ্য, নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, নদ-নদীর পানিবণ্টন, পর্যটন, ধর্মীয়, পারস্পরিক আত্মীয়তা ইত্যাদি এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যেখানে দুদেশের সম্পর্ক কাজে লাগেনা। সেই সম্পর্কের বন্ধন আরো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয় যখন দুদেশের মধ্যে যাতায়াত ঠিকমতো কাজ করে। বিষয়টি একটি উদারণ দিয়ে আরো বোধগম্য করা যেতে পারে।

ধরুন, দুটি পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তা কিংবা অন্য যেকোন কারণে সুসম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্ক রাখার দায়িত্ব উভয়ের উপরেই বর্তায়। যত ভালো সম্পর্কই থাকুক না কেন দীর্ঘদিন যোগাযোগ না থাকলে তা দূরত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে এক পর্যায়ে শেষ হয়ে যেতে বাধ্য। ঠিক তেমনি দেশে দেশে সম্পর্কও তাই। কাজেই মনোরঞ্জনের জন্যই যে যোগাযোগ দরকার তা নয় বরং এর বহুমাত্রিক প্রয়োজন রয়েছে। আর সেজন্য যেকারো ব্যক্তিগত কাজে বেড়ানো হলেও প্রকারান্তরে তা রাষ্ট্রেও কাজে লাগে। আর সেজন্যই আমরা বেড়াতে গেলেও আমাদের আনন্দতো হলোই সেইসাথে দুদশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তা প্রচ্ছন্ন ভুমিকা রাখবে। এখন না হয় বিশেষ ক্যাম্পেইনের কারণে ভিসা পেতে সহজ হয়েছে, কিন্তু আমি আমার পরিবারের চারজনের ভিসা এত সহজে পাইনি। যাহোক, একবার যেহেতু ছয়মাসের ভিসা পেয়েছি, সেজন্য এর পুরোটাই উসল করবো বলে ভাবছিলাম। আর সেজন্যই সপরিবারে প্রথম বারের মতো ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি।

আমার বিয়ের পর যেখানে নিজের শশুরবাড়ি, নিজের বাড়ি এবং চাকুরিস্থল ছাড়া আর কোথায়ও দেশের ভিতরেই বেড়ানোর সুযোগ পাইনি, সেখানে সপরিবারে ভারত বেড়াতে যাওয়া স্বপ্নের মতো লাগছিল। তবে বিগত কিছুদিনে সপরিবারে অন্যান্য পারিবারিক বন্ধু-বান্ধবদের সাথে নিয়ে বেশ কয়েকবার দেশের অভ্যন্তরে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন এবং পরে আবার এক বন্ধুর বিয়েতে পারবারিক একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সেখানে বেড়ানোর কারণে যে সাহস সঞ্চিত হয়েছে, সেটাই আবার ভারত বেড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছে সবাইকে।

এখানে একটি বিষয় আমার জন্য খুব আনন্দের এজন্য যে, সেখানে যখনই আমি ভারত বেড়াব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম তখনই আমার পরিবারের অন্যদেরকে জানানোর পর তারা খুবই উৎফুল্ল হয়ে সাগ্রহে গ্রহণ করেছিল। আমাকে তাদের রাজি করানোর ক্ষেত্রে কোন বেগ পেতে হয়নি। সেজন্য পাসপোর্ট করার জন্য ছবি তোলা, ভিসার জন্য আবেদন ও তার জন্য ইন্টারভিউ প্রত্যেকটি কাজে একটু বাড়তি সমস্যা অনুভুত হলেও তাতে তাদের সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ খুবই উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। এতে আমিও প্রত্যেকটি কাজে বেশ আগ্রহ পেয়েছি। আর সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শীতকালীন ছুটির পুরো দুইসপ্তাহ সময় ভারতে বেড়িয়ে কাটাবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে সেভাবেই প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম।

দুই.
বছর দুয়েক আগে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি খুব গুরুত্বসহকারে পড়ছিলাম। সেখানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক আরো অনেক বিষয় তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। তারমধ্যে লেখাপড়া ও রাজনীতির পাশাপাশি সময় পেলেই তিনি ভারতের বিভিন্ন দর্শণীয় স্থান কখনো নিজে এবং কখনোবা সদলবলে বেরিয়েছেন। তাঁর সেসব ভ্রমণের নিখুঁত বর্ণনা আমাকে দারুণ ভাবে উদ্বেলিত করেছিল। তিনি তাঁর বর্ণনায় আগ্রার তাজমহল, মোঘল রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষী ফতেহপুর সিক্রি, পবিত্রস্থান বা পূণ্যভূমিখ্যাত আজমীর শরিফ এবং তারই পাশে সবচেয়ে বড় দিঘী আন্নাসাগর দিঘী, জয়পুরের আম্বার পোর্ট, পিংক সিটি, দিল্লিতে মোঘল আমলের হুমায়ুন টম্ব, ঈসা খাঁর দুর্গ, কুতুব মিনার, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজার ইত্যাদি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। আর সেজন্য এগুলো দেখার উত্তেজনায় আমার মনে আরো বেশী করে আগ্রহ জন্মাতে লাগল।

আগে যেহেতু কখনো এসব দেখা হয়নি, বিশেষত তাজমহল দেখতে গেলে অবশ্যই সেখানে সহধর্মিনীকে নিয়ে যাওয়া উচিত বলে আমি মনে করলাম। কারণ তাজমহল হলো প্রেম প্রেয়সিদের প্রেমের প্রতিদানের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সেখানে নিজের অর্ধাঙ্গিনী সাথে থাকলে তাকে মমতাজ মমতাজ এবং নিজেকে ক্ষাণিকক্ষণের জন্য হলেও স¤্রাট শাহজাহান ভাবতেন কোন অসুবিধা হবে না। তাছাড়া কথায় আছে, কান টানলেই মাথা আসে। সেখানে যদি আমি নিজে এবং আমার মমতাজকে নিয়ে যাই তাহলের আমাদের সাথে আদরের দুই যুবরাজ যাবে তাতো আর বলার প্রয়োজন নেই।

এখানে বলে রাখা দরকার যে, আমার মমতাজসম সহধর্মিনী হলেন একজন কলেজ শিক্ষিকা মোস্তাফিজা রুস্তী নিশু, আর দুই যুবরাজের একজন হলেন ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া এএম হাসিন শাহাদ নাফি এবং একই প্রতিষ্ঠানে কেজি শ্রেণিতে পড়ুয়া এএম হাসিন ইশরাক তকি। আমার কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শীতকালীন ছুটি, বাচ্চাদের ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষার পর ফলাফলের জন্য অপেক্ষায় থাকা এবং আমার স্ত্রীর কলেজ থেকে দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়ে সপরিবারে ভারত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আমার বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন সহকর্মী ভারতে পিএইচডিতে অধ্যয়নরত আজিজুর রহমানসহ ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের ২ তারিখে বেরিয়ে পড়লাম। ময়মনসিংহ থেকে বাসে বেনাপোল এবং বেনাপোল হতে আজিজ সাহেবসহ রাস্তায় বাসের মধ্যে পরিচিত হওয়া ময়মনসিংহের আরেক সপরিবারে বেড়াতে যাওয়া অসীম দাদার পরিবারসহ সকলে মিলে জিপে চড়ে ঐতিহাসিক কলকাতা শহরে পদার্পণ করি। সেখানে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন ছাত্র বাবুর সহযোগিতায় আগে থেকেই ঠিক করে রাখা একটি আবাসিক হোটেলে উঠি। আমার স্ত্রী একটু বেশী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার পরেও প্রথম দেখাতেই তার সেই থাকার আবাসিক হোটেলটি পছন্দ হল।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে বিটি রোডে এ হোটেলটির নাম হলো ‘ইয়থ হোস্টেল কলকাতা’। এখান থেকে সবকিছুই একটু দূরে মনে হলেও নিরিবিলি থাকার কারণে জায়গাটি সবার খুব পছন্দ হলো। তবে শহরের ভিতরে যতই দূরে হোক না কেন কলকাতা শহরের যাতায়াতব্যবস্থা এতটাই ভালো যে, কোন দূরত্বই আর দূরে মনে হয়নি। হোটেলে বসেই আজিজ সাহেবকে নিয়ে দুইসপ্তাহ সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য একটি ভ্রমণ পরিকল্পনা করা হল। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে যে স্থানগুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সুনিপুন বর্ণনা করা হয়েছে, সেগুলোই দেখার পরিকল্পনা করি প্রাথমিকভাবে। ভারতে মধ্যবিত্তের বেড়ানোর সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও সহজ মাধ্যম হলো ট্রেন। তবে ভালো ভালো ট্রেনের ভাড়াও যেমন বেশী, ঠিক তেমনি আরামপ্রদও। সে যা হোক ভারত তো আর বারবার যাওয়া যাবে না। আর বাচ্চারা এখন যা দেখবে, যা শিখবে তা তাদের সারাজীবনের একটি স্মৃতি হয়ে থাকবে, এই চিন্তায় বাবুর মাধ্যমে কলকাতা থেকে দিল্লি যাওয়ার জন্য সবচেয়ে নামী-দামী ট্রেন হিসেবে ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’ ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করলাম।

তিন.
চাইলেই কী আর সে ট্রেনের টিেিকট সংগ্রহ করা যায়! কারণ এ সকল ট্রেনের টিকেট কাটতে চাইলে কমপক্ষে দুই-তিন মাস আগে থেকে বুকিং দিতে হয়। কিন্তু বিদেশি পর্যটকদের জন্য অবশ্য ‘ফেয়ার প্লেস’ নামে একটি অপশন রয়েছে যেখান থেকে খুব সহজেই যার যার বৈধ পাসপোর্ট ও ভিসা দেখিয়ে নিয়মতান্ত্রিক লাইনের মাধ্যমে টিকেট থাকা সাপেক্ষে সৌভাগ্যক্রমে পাওয়া যেতে পারে। তবে সেখানেও রয়েছে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ। আবার সময়মত টিকেট প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি বিষয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। আবান অনলাইনে ‘তৎকাল’ নামক আরেকটি পদ্ধতির রয়েছে টিকেট সংগ্রহের জন্য। যদি কারো জরুরি প্রয়োজন হয়, সেখানে অনলাইনে টিকেট সংগ্রহ করা যায়। তবে সেখানেও টিকেট পেতে হলে সার্বক্ষণিক অনলাইনে বসে থাকার মতো সময় সবার হয়না। সেজন্য সেখানেও দালাল রয়েছে টিকেট সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য, রয়েছে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ। তাদের কাজই হলো দেশি-বিদেশি ভ্রমণ পিপাসুদেরকে ট্রেন কিংবা বিমানের টিকেট সংগ্রহ করে দেওয়া। তাই বাবুকে দিয়ে সেসব ব্রোকারেজ হাইজ কিংবা দালালদের মাধ্যমে কলকাতা-দিল্লি টিকেট সংগ্রহ করার জন্য ব্যবস্থা করতে বলি। নির্দিষ্ট দামের চেয়ে প্রায় দেড়-দ্বিগুণ দামে আমরা চারজনের জন্য তিনটি টিকেট সংগ্রহ করতে পেরেছি। সেই টিকেট নিয়ে বিকেল বেলায় চলে যাই কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত রেলস্টেশন শিয়ালদাতে।

রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনের বৈশিষ্ট হলো- ইলেকটট্রিক ট্রেন, পুরোগাড়িই এসি, গাড়িতেই ‘ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ক্যাটারিং এন্ড ট্যুরিজম করপোরেশন (আইআরসিটিসি)’র ব্যবস্থাপনায় উন্নতমানের খাবারের সরবরাহ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য তিন-চারটি স্টপেজ ছাড়া কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত আর কোন স্টপেজ নেই। রাস্তায় অন্যকোন ট্রেনের সাথে ক্রসিং নেই, দ্রুতগতিতে চলে বিধায় প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার পথ মাত্র আঠার ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। ডাবল কিংবা ট্রিপল টায়ার স্লিপার আছে বিধায় পুরো জার্নি পিরিয়ডেই সচলে-বিচলে, আরাম-আয়েশে, অনায়াসে ঘুমিয়ে যাওয়া যায়। শীতের মধ্যে ট্রেনের বগিতে এসি চলমান ছিল। সেজন্য ট্রেনের ভিতরে এতটা ঠাণ্ডা অনুভুত হয়নি। তবে ট্রেনে ঘুমানোর জন্য বালিশ, কম্বল, টাওয়েল সবই রয়েছে। সেইসাথে মোবাইল চার্জ দেওয়ার জন্য এবং ল্যাপটপ চালানো ও চার্জ করার জন্য পয়েন্ট রয়েছে। কতক্ষণ পরপর খাবার সরবরাহ তো রয়েছেই।

প্রত্যেক যাত্রির রুচির কথা চিন্তা করে ভেজ বা ননভেজ অর্থাৎ আমিষ ও নিরামিষ সবই রয়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই গরম গরম খাবার চলে আসছে। বিমানের মতো অবস্থা। সেজন্য আমার স্ত্রী-সন্তানেরা এসব খাবার দেখতে দেখতে এবং খেতে খেতে অত্যুক্তি হয়ে গেছে। ট্রেনের মধ্যে সিট ও স্লিপারগুলো এমন যে, শোয়ার আগে বসার সিট ভাঁজ করেই শোয়ার স্লিপার বানিয়ে নিতে হয়। সেজন্য কেউ ঘুমোতে না চাইলেও কিংবা শুতে না চাইলেও অন্যরা শুয়ে থাকলে তখন পাশের জনকেও শুতে হয়। কারণ নিচে তিনজনের বসার জায়গা, তারউপর আরো দুইটি স্লিপার। কাজেই উপরেরগুলো ছেড়ে দিলে সবাইকেই শুয়ে পড়তে হয়।

চার.
আমরা যে তাজমহল, আজমীর, দিল্লির উল্লেখযোগ্য স্থানসমূহ দেখার জন্য আগে থেকেই আমার ব্যবসায়ী বন্ধু তারিফ আনামের পরিচিত আরেকজনের সূত্রে প্রাপ্ত দিল্লির এক ট্রাভেল এন্ড ট্যুর অপারেটর শরাফত খানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তার সাথে আবার আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী আজিজ সাহেবেরও পূর্ব পরিচয় ছিল। যে কারণে টেলিফোনে আগে থেকেই শরাফত খানের সাথে যোগাযোগ করে রাখা হয়। সেই শরাফত খানের দেশের বাড়ি আবার বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলে। সেজন্য ব্যবসার জন্যই হোক আর নিজের দেশের মানুষ বলেই হোক শরাফত খান আমাদের রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনটি সারারাত চলে চলে বেলা ১২ টার দিকে দিল্লি স্টেশনে এসে পৌঁছালে আমাদেরকে সপরিবারে রিসিভ করার জন্য রেল স্টেশনে তার লোক পাঠিয়ে দেয়।

সারারাত ট্রেন চলার সময় আমার দুই রাজপুত্র তাদের শিশুসুলভ আচরণ দ্বারাই আমাদের অন্যান্য সহযাত্রিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল। ট্রেন তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, আমার ছেলেরা সবার সামনে একেকটি গল্প বলছিল আর সহযাত্রিরা মজা পাচ্ছিল। যাত্রিদের কেউকেউ তাদের আপন করে নিয়েছিল এবং ভালবাসার ডাক তুমি থেকে তুইয়ে নেমে এসেছিল। মনে হয়েছিল তারা যেন আমাদের চেয়ে বেশী জনপ্রিয় ট্রেনের সেই কম্পার্টমেন্টে। শরাফত খানের লোককে পেয়ে নিজের লোক মনে হতে লাগল এ কারণে যে, অনেক রেফারেন্স ছিল। অতঃপর দিল্লি শহরে ট্রেন থেকে নেমে মাটিতে পা রাখতেই একটি অন্যরকম অনুভুতি হচ্ছিল, কারণ ভারতের রাজধানী শহর বলে কথা। স্টেশনের ঠিক পাশেই শরাফত খানের অফিস। এত আরামের ট্রেন এটি যে, সারারাত জার্নি করেও ট্রেন থেকে নেমে জার্নির কোন ক্লান্তি শরীরে ছিলনা। রাতে হাল্কা একটু ঘুমও হয়েছে সেজন্য শরীরটা একটু ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিল। শরাফত খানের অফিসে গিয়ে তার একটু আতিথেয়তা হিসেবে চা পান করে তাকে আমাদের ভ্রমণ প্ল্যানটি বলি। তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটি রোডম্যাপ তৈরী করে তদানুযায়ী আমাদের চার সদস্যবিশিষ্ট পরিবারে উপযোগী একটি এসি প্রাইভেট কার ও একজন লং ড্রাইভে এক্সপার্ট ড্রাইভারকে আমাদের সাথে ট্যাগ করে দেন। সেইসাথে এ ট্যুরের জন্য শুধু খাওয়া-দাওয়া বাদে হোটেলসহ সবকিছু মিলে একটি প্যাকেজ করে দিলেন। তদানুযায়ী হিসাব করে টাকা অগ্রীম পরিশোধ করে দিলাম।

পাঁচ.
সেখান থেকে সেই ড্রাইভার বাবুকে দিয়ে ক্যারোল বাগ নামক একটি জায়গায় হোটেল ‘দিল্লি প্রাইড ইন্টারন্যাশনালে’ পাঠিয়ে দেয় একরাত দিল্লি শহরে থাকার উদ্দেশ্যে। হোটেল থেকে একটু ফ্রেশ ও ক্ষাণিক রেস্ট করে পরে দুপুরে আবার দিল্লিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ দেখানো হলো শরাফত খানের গাড়ির ড্রাইভারের মাধ্যমে। আমরা হোটেলে এসে গোছল দিয়ে বাচ্চাদের একটু রেস্ট করাতে করাতে আবার বেরিয়ে পড়ার জন্য শরাফত খানের গাড়ি এসে হোটেলের সামনে অপেক্ষা করতে থাকে। তবে বাচ্চারা বেড়ানোর উত্তেজনায় এতটা বেশী উৎফুল্ল যে সেখানে তাদের আর রেস্ট নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। বরং তারা গাড়িতে চড়ে বেড়াতে পারলেই খুশি। মহিলাদের একটা প্রবণতা থাকে, যেখানেই যাবে সেখান থেকেই কোন একটা কিছু কিনে ফেলা। আমরা কেবল বেড়াতে শুরু করেছি, কত জায়গায় যাওয়া হবে। সেখানকার অনেক বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থাকতে পারে, সেগুলো কিনতে হবে। কাজেই আগে থেকে এটা সেটা কিনে ব্যাগ ভরার কোন প্রয়োজন নেই বলে বুঝালাম। কিন্তু কে শুনে কার কথা!

বিকালে হুমায়ুন টম্ব এবং একই কম্পাউন্ডে ঈসা খাঁর দুর্গ পরিদর্শন করি। সেখানে ঢোকার সময় বিদেশি পর্যটক হিসেবে পাসপোর্ট দেখিয়ে ফরেন কারেন্সি রেইটে টিকেট কিনে যেতে হয়। কিন্তু এখানে একটি মজার ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে, আমরা বাংলাদেশী হওয়ার পরেও পাসপোর্টে আমার নাম হুমায়ুন দেখে আমাদের টিকেট ভারতীয় মুদ্রার হারে নিয়েছে। তারপর নিজামমুদ্দিন আউলিয়ার মাজার, প্রেসিডেন্ট ভবন, পার্লামেন্ট ভবন, হাইকোর্ট ভবন ইত্যাদি দেখা হল। এগুলো একটি কমপ্লেক্সের ভিতর একই সাথে অবস্থিত। দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট ইমারতগুলোর মতই। তবে ইন্ডিয়ান পার্লামেন্ট ভবনটির বিবেচনায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন অনেক উন্নত বলে মনে হল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দেখে খুবই ভালো লাগল। সেটি হলো ইন্ডিয়া গেট। ইন্ডিয়া গেটটি শুধু মামুলি একটি গেটের মত দেখা গেলেও সেই গেটের দেয়ালে দেয়ালে লেখা রয়েছে সেদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নিহত সকল শহীদদের নাম।

আমরা যখন ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ইন্ডিয়া গেট ভ্রমণ করি তার মাত্র কয়েকদিন পরেই অর্থাৎ ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এসেছিলেন। সেজন্য তখন সেখানে নিরাপত্তা বিষয়টিতে একটু কড়াকড়ি থাকলেও পর্যটকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। তারপর আমরা চলে যাই ইন্দিরা মেমোরিয়াল যাদুঘর দেখার জন্য। সেখানে ঢোকার পর বাংলাদেশের ধানম-ি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘরের মতো মনে হতে লাগল। সেই যাদুঘরের প্রত্যেকটি আনাচে-কানাচে শুধু নির্মমতার চিহ্ন। প্রথমে ইন্দিরা গান্ধীকে আততায়িরা হত্যা করেছিল, পরে একই কায়দায় আবার রাজীব গান্ধীকেও হত্যা করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই। সেখানে তাদের রক্তভেজা জামাকাপড়সহ অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন দেখলে চোখের পানি সংবরণ করা যায় না। প্রধানমন্ত্রী অবস্থায় যে বাড়িতে তাঁরা ছিলেন, সেই বাড়িটিকেই যাদুঘরে রূপান্তরিত করে দেওয়া হয়। সেজন্য বাড়ির অবস্থা দেখে মনে করতে কারোর অসুবিধা হয়না যে, তারা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও কত সাদামাটাভাবে দিনাতিপাত করতেন।

যাদুঘর দেখতে দেখতে সেখানে আমাকে কয়েকটি বিষয় খুব আবেগাপ্লুত করেছিল। তারমধ্যে একটি বিষয় ছিল- সেখানে বঙ্গবন্ধুর জন্য একটি আলাদা কর্নার স্থাপন করা। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইন্দিরা সরকারের সাথে বঙ্গবন্ধুর সরব যোগাযোগের সচিত্র প্রমাণ ফুটে উঠেছে। আর সবচেয়ে যে বিষয়টি দেখার পর আমার শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সেটা হচ্ছে, ভারতকে নিয়ে ইন্দিরা সরকারের মিশন ও ভিশন সম্বলিত একটি তালিকা দেখে। ছয়-সাতটি উদ্দেশ্য সম্বলিত সেই তালিকায় ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক ভারতের প্রতি কর্তব্যের তালিকার মধ্যে তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানে রয়েছে ‘ভারত সরকারের অন্যতম একটি কাজ হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সহায়তা করা’। এটি দেখে দেশপ্রেমিক যে কোন নাগরিকের আমার মতই অনুভুতি হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সাত.
দিল্লি শহরের ভিতরে থাকা এ স্থাপনাগুলো দেখতে দেখতে সেদিন সন্ধ্যা হয়ে যায়। তখন আমার গিন্নির মনের স্বাদ আংশিক পূরণ করার খায়েশে কেনাকাটর জন্য রাতের কিছুটা সময় নির্ধারণ করা হয়। আগেই শরাফত খানের কাছে জিজ্ঞাসা করে রাখা হয়েছিল যে, আশেপাশের কোথায় কেনাকাটা করা যেতে পারে। তখন তিনি ক্যারোল বাগে আমরা যে হোটেলে উঠেছি তার পাশেই গাফফার মার্কেটের কথা বলে আরো কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। যাহোক, পরে আমাদের সাথে থাকা গাড়ির ড্রাইভারের পরামর্শে ‘দিল্লি হাট’ নামের একটি গলাকাটা দামের দোকানো নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে কয়েকটি শীতের শালসহ আরো কয়েকটি জিনিস কিনে বাহিরে বের হতেই ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলেন যে, আমরা কত টাকার শপিং করেছি। পরে বুঝলাম, এসব ড্রাইভারের সাথে দোকানীদের একটি গোপন আঁতাত বা চুক্তি থাকে। খদ্দের জুটিয়ে দিলে তারা যত টাকার শপিং করবে, সেই টাকার উপর একটা কমিশন পাবে। সেখানে তারা সাধারণত বিদেশি পর্যটকদের টার্গেট করে থাকে। যা হোক, আমার চোখ-কান খোলা থাকার বদৌলতে একটু দামা-দামী করে কিনার কারণে খুব বেশী ছিলতে পারেনি।

এ বিষয়ে দেশ থেকে পূর্বাভিজ্ঞ অনেকেই সতর্ক করে দিয়েছিল, ফিক্সড প্রাইজ দোকান হলেও লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে একটু দামা-দামী করতে হবে এবং সেটা কোন কোন সময় লিখিত মূল্যের অর্ধেকের চেয়েও কম হতে পারে। আবার অনেক দোকানে সত্যি সত্যিই ফিক্সড প্রাইজ ফলো করা হয়। সেটা দুয়েকটি জিনিস কিনলেই বুঝা যাবে। তারপরও ইতোমধ্যে নিজেও কিছুটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম। পরদিন ভোরবেলায় চারদিনের জন্য দিল্লি থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। শীতের সকাল, সেই ভোর পাঁচটায় হোটেল গেটে চলে আসল শরাফত খানের বাবু ড্রাইভার। নাফি, তকি ও নিশুকে নিয়ে ভোর বেলাতেই বেরিয়ে গাড়িতে চেপে বসলাম। অন্য সময় শীতের মধ্যে বাচ্চাসহ সকলে ভোরে ঘুম থেকে উঠতে একটু আলসেমি করতে দেখা গেলেও এখন আর সেরকমটি দেখা যায়নি।

বরং সকলের মধ্যে অন্যরকম একটি স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষ্য করা গেছে। শীতের ভোরবেলায় রাস্তায় অনেক কুয়াশা ছিল। কিন্তু বাবু ড্রাইভার খুবই দক্ষ বলে কোন অসুবিধাই হয়নি ইনশাল্লাহ। তবে রাস্তা খুবই ভালো, একেবারে ছয়লেন। রাস্তায় যেতে যেতে ড্রাইভারে সাথে এটা সেটা আলাপ হয়। তবে সে যে শুধু গাড়ি চালাতেই চালু তাই নয়, সে একটু টাউট ধরনের তা আমাদের বুঝতে বেশী সময় লাগেনি। তার কথা হলো, যে কোন কিছু আমরা যেন তার উপর শতভাগ নির্ভর করি। অর্থাৎ কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবই। উদ্দেশ্য সেখান থেকে দালালি খাওয়া। যেহেতু চারদিনের ব্যাপার, তাকে নিয়েই চলতে হবে, তাছাড়া ড্রাইভার হিসেবে ভালো, সেজন্য পরে অবশ্য আমাদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তাকে ম্যানেজ করে নিয়েছি।

আট.
আমাদের এবারের মিশনে প্রথম টার্গেট হলো আগ্রার তাজমহল। সেখানে বেলা ১২ টার দিকে পৌঁছে যাই। তাজমহলে ঢোকার টিকেট গ্রহণের দুটি পদ্ধতি রয়েছে। ভারতীয়দের জন্য মাত্র ২০ রুপি, কিন্তু বিদেশি পর্যটকদের জন্য তা ৭০০ রুপি, সেই সাথে আবার পাসপোর্ট ভিসা ইত্যাদি অনেক বৈধ কাগজপত্রাদি দেখে অনেক সময় নিয়ে টিকেট ইস্যু করা হয়। আমার বড় ছেলে নাফি ইন্ডিয়ান কার্টুন দেখে দেখে হিন্দি ভাষাতে কিছুটা দক্ষতা অর্জন করেছে। সেজন্য এ ভ্রমণে যেখানেই আমরা ঠেকে গিয়েছি সেখানেই নাফিকে দুভাষী হিসেবে ব্যবহার করেছি। অনেক ঝামেলা ও সময় বাঁচানোর জন্য তাজমহলের টিকেট সংগ্রহের ক্ষেত্রেও নাফিকে ব্যবহার করে ভারতীয় হিসেবে সহজেই ২০ রুপিতে আমাদের টিকেট পেয়ে যাই।

টিকেট নিয়ে ভিতরে ঢুকে অতীতের সকল অভিজ্ঞতা, ধারণা, শোনা সব ফিকে হয়ে যায়। আগে অনেকের কাছে শুনেছি, বিভিন্ন পত্রিকায় বইয়ে পড়েছি, টেলিভিশনে ছবি দেখেছি। সবকিছুই মিথ্যে হয়ে গেছে তাজমহলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে। দৃশ্যত বাইরে থেকে আমরা যে তাজমহলের অতিসাধারণ একটি ছবি দেখি তা মোটেও সেরকম নয়। নিজ চোখে না দেখলে এর বাস্তবতা ও রূপ কখনো অনুধাবন করা যাবেনা। দশবার দেখলেও এগারো বারে তাকে আবার নতুন মনে হবে। এটাই হলো তাজমহলের মূল আকর্ষণ ও বিশেষত্ব। আমরা দিল্লিতে যে হুমায়ুন টম্ব দেখে গিয়েছি, তার সাথে তাজমহলের একটি অদ্ভূত মিল লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে খচিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, হুমায়ুন টম্ব তাজমহলের আগে স্থাপিত। সেটার রং একটু লালচে ধরনের এবং এর পরিধি অনেক ছোট। কিন্তু তাজমহল সম্পূর্ণ শ্বেত পাথরে করা।

আমরা তাজমহলের যেটুকু ছবিতে দেখি তার নিচে আরো দুটি বেইজ রয়েছে, আশে-পাশেও রয়েছে আরো অনেক দৃষ্টিনন্দন ঐতিহাসিক স্থাপনা, পাশেই আবার যমুনা নদী বয়ে চলেছে। আমরা সেখানে থাকতে থাকতে যোহরের আজানের সময় হয়ে যাওয়ায় সেখান থেকে তখন আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল। শীতের দিনে কুয়াশা থাকলে তাজমহলের স্পষ্ট ছবি তোলা কঠিন হয় এবং দূর থেকে অতটা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেনা। কিন্তু সেদিন একটু শীতল বাতাস বইছিল ঠিকই কিন্তু তখন কুয়াশা কেটে গিয়েছিল। সেজন্য সৌভাগ্যক্রমে এর পূর্ণ রূপটিই আমরা দেখতে পেরেছি। আগেই বলেছিলাম যে, তাজমহলে আসার পর নিজেকে স¤্রাট শাহজাহান, স্ত্রীকে মমতাজ এবং বাচ্চাদের কুমার কুমার মনে হচ্ছিল।

এখানকার সৌন্দর্য ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না, তারপরও যেহেতু সময়ের ফ্রেমে বাধা, সেজন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরিয়ে পড়লাম। আগেই শরাফত খানের কাছে শুনেছিলাম, আগ্রায় ভালো চামড়ার জিনিস পাওয়া যায়। সেজন্য সেখান থেকেও বাবু ড্রাইভারকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় চামড়ার জিনিস কিনে নিয়েছিলাম। সেখান থেকে সোজা ফতেহপুর সিক্রিতে। সেখানে পৌরাণিক অনেক স্থাপনা দেখে সেদিনেই চলে যাই জয়পুরে। যেতে যেতে রাস্তার ধারে সবুজ ফসলের ক্ষেত, সেই ক্ষেতের ভিতর কাছে-দূরে আবার দলে দলে গরু চড়তে দেখা যাচ্ছে, দিগন্তজুড়ে মাঠ আর মাঠ, যা একজন কৃষিবিদ হিসেবে আমাকে খুবই শান্তি দিয়েছিল। জয়পুরে রাতে গিয়ে সেখানে শরাফত খান নির্ধারিত হোটেল ‘মহারানী প্যালেসে’ রাত্রিযাপন করি।

নয়.
সকালে সেখান থেকে জয়পুরের বিখ্যাত পিংক সিটি ও সাতরাজার ইমারত পরিদর্শন করি। পরে পাহাড়ি রাস্তার সুরঙ্গ পথ পেরিয়ে আম্বার পোর্ট ও মহারানীর দিঘী পরিদর্শন করে সেখান থেকে টুকিটাকি কেনাকাটা করা হয়। তারপর সোজা চলে যাই আজমীর শরিফ। দুপুরবেলায় আজমীরে পৌঁছে হোটেল ‘পার্ক প্যালেসে’ উঠে সেখানে হালকা ফ্রেশ হয়ে পবিত্র চিত্তে হাটতে হাটতে আজমীর শরিফে চলে যাই। আমরা যাওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগেই আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আজমীর শরিফ জিয়ারত করে এসেছেন। সেজন্য আশেপাশের দোকানীরা বাংলদেশী পরিচয় দেওয়াতে একটু বাড়তি খাতির যত্ন করেছে। আজমীর শরিফে ঢুকে তখন মাগরিবের নামাজের জামাতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে নিয়েছি। আজমীর শরিফ সকল ধর্মের মানুষের জন্য তীর্থস্থান, সেজন্য সেখানে সব ধর্মের মানুষকেই তাদের নিজ নিজ ধর্মমতে প্রার্থনা করতে দেখা গেল। সেখানে একরাত কাটিয়ে রাতেই আন্নাসাগর দিঘী পরিদর্শন করে পরদিন দিল্লি।

তারপর দিল্লি থেকে শরাফত খানের করে দেওয়া রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকেট নিয়ে আবার কলকাতায় ফিরি। কলকাতায় আরো দু’রাত থেকে সেখানে ইচ্ছেমত সঙ্গতির ভিতরে নিউমার্কেট, বাজার কলকাতা, বিগবাজার, কলেজ স্ট্রিটের আদি ঢাকেশ্বরী, আদি মোহনীমোহন কাঞ্জিলাল, আদি ইন্ডিয়ান সিল্ক ইত্যাদি বিখ্যাত শপিংমল থেকে কেনাকাটা করে আবার একইপথে নির্বিঘ্নে ময়মনসিংহে ফিরে আসি। এ ভ্রমণে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে, অর্জন হয়েছে আরো বেশী। কারণ ভ্রমণে যে অভিজ্ঞতা হয় তা টাকার অংকে হিসাব করা যায় না। আর বাচ্চাদের তা সারাজীনের একটি পাথেও হয়ে তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সঞ্চিত হয়ে থাকবে। কাজেই সবারই সুযোগমত যার যার সঙ্গতির মধ্যে দেশ-বিদেশে বেড়ানোর সুযোগ নিতে পারেন। আর সে সুযোগ সবসময় আসেনা, তা করে নিতে হয়। কারণ কথায় আছে, ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়।

লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল-০১৭১৫-২৮১৮৯২, [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer