Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

`ভাইয়া আমারে বাঁচান, হাতটা ছুটায়া দেন`

বহুমাত্রিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৩:২৩, ২৪ এপ্রিল ২০১৮

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

`ভাইয়া আমারে বাঁচান, হাতটা ছুটায়া দেন`

ঢাকা : ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সকাল আটটা নাগাদ রানা প্লাজার সামনে আসেন গার্মেন্ট শ্রমিক আয়েশা আক্তার।

তাঁর আশংকা ছিল, সেদিন অফিসে না গেলে মাস শেষে বেতন দেবে না কারখানা কর্তৃপক্ষ। মাস শেষ হতে তখন মাত্র ছয়দিন বাকি।মনের ভেতরে এক ধরনের উদ্বেগ আর ভয় নিয়েই তিনি রানা প্লাজার সামনে গিয়েছিলেন।

কারণ এর আগের দিন অর্থাৎ ২৩শে এপ্রিল রানা প্লাজা ভবনে ফাটল দেখেছিলেন অনেক শ্রমিক।রানা প্লাজা ভবনের সপ্তম তলায় নিউ ওয়েভ স্টার লিমিটেড কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন আয়েশা আক্তার।

তিনি বলেন, "২৩ তারিখ আমাদের বলা হইছিল নয় তলায় কারেন্টের কাজ করবে। সকালে ছুটি দিয়ে বলা হইছিল যে লাঞ্চের পর আসার জন্য। দুইটার দিকে আইসা দেখি যে লোকজন সবাই নিচে দাঁড়ায়ে আছে। কেউ উপরে যায় না। কিন্তু বাইরে থেকে দেখা গেছে জানালার সাইড দিয়া ফাটা। সেদিন সবাইকে ছুটি দেয়া হয়েছিল। বিল্ডিং-এ আর কেউ ঢুকেনি। "

২৪শে এপ্রিল সকালে রানা প্লাজার সামনে এসে আয়েশা আক্তার দেখলেন, কেউ ভবনের ভেতরে যাচ্ছে, আবার অনেকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

"তখন মালিকরা আর বিল্ডিং-এর মালিক রানা গালাগালি করতাছে লোকজনদের। অনেকদের মাইর-ধইর কইরা উঠাইছে। শেষ পর্যন্ত আমি উঠলাম," বলছিলেন তিনি।

পাঁচ বছর আগের সে ভয়ঙ্কর দিনটির কথা মনে করে এখনো চিৎকার করে কাঁদেন আয়েশা আক্তার।

সেদিন শ্রমিকরা চাপে পড়ে ভবনের ভেতরে ঢুকলেও তারা কাজে মনোযোগ দিতে পারছিলেন না।

তখন কারখানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে তাদের শাসিয়ে যান বলে অভিযোগ করেন আয়েশা আক্তার।

"তারপর গিয়ে বসলাম। আমি এক পিছ কাজ করছি মাত্র। হঠাৎ করে এমন জোরে আওয়াজ হইল, পিছন দিকে ফিরে তাকানোর সময়টুকু ছিল না।"

সকাল ৮:৪৫ মিনিটের দিকে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় জেনারেটর চালু করা হয়।জেনারেটর চালু করার সাথে সাথেই বিকট আওয়াজ হয় বলে জানান আয়েশা আক্তার।সে সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আয়েশা আক্তার।"বিশ্বাস করবেন না। আমি এমন জোরে দৌড় দিছি.. আল্লাহ হায়াত রাখছে.. "

দৌড়াতে গিয়ে মেঝতে পড়ে জ্ঞান হারান তিনি।জ্ঞান ফিরে আয়েশা আক্তার দেখেন, তিনি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন।তাঁর বাম হাত এবং বাম পা আটকে যায় কংক্রিটের নিচে।

সে বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, " চুল যে রকম বেনি করি, সেই রকম বাম হাত আর বাম পা পিইষা ছিল। তখন আমি বললাম, ভাইয়া আমারে বাঁচান, হাতটা ছুটায়া দেন। আমার মনে শক্তি আছে। আমি পারবো। আমি ঐখান থেকে বের হতে পারবো।"

আয়েশা আক্তার যেখানে আটকা পড়েছিলেন সেখানে কিছু ভাঙ্গা লোহা ছিল।সে লোহা দিয়ে তাঁর আটকে পড়া সহকর্মীরা সারাদিন শুয়ে থেকে ধীরে-ধীরে একটু একটু করে কংক্রিটের স্লাব ভাঙতে থাকেন।

আশপাশে তারা উদ্ধার কর্মীদের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু আটকে পড়াদের চিৎকার উদ্ধার-কর্মীদের কানে পৌঁছচ্ছিল না।

কান্না জড়িত কণ্ঠে আয়েশা আক্তার বলেন, "আমরা সবার কথা শুনতেছি। কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনেনা। আমরা যে চিৎকার করতেছি, বাঁচাও-বাঁচাও বলতেছি, কেউ শোনে না।"

আটকে পড়াদের আর্তনাদ একপর্যায়ে একজন উদ্ধারকারীর কানে পৌঁছায়।তারপর উদ্ধারকারীরা এসে ছাদ কেটে তাদের বের করে।

আয়েশা আক্তারের যখন জ্ঞান ফেরে তখন তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের বিছানায়।সৌভাগ্যক্রমে তাঁর আঘাত তেমন একটা গুরুতর ছিল।পরের দিন হাসপাতাল ছাড়ার অনুমতি দেন চিকিৎসকরা।সেই থেকে আর কোন কারখানায় কাজ করেন না তিনি।

পাঁচ বছর আগের সে ভয়ঙ্কর স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাঁকে।তৈরি পোশাক কারখানার প্রতি মারাত্মক ভীতি তৈরি হয়েছে আয়েশা আক্তারের।তাঁর বর্ণনায়, " আমি চাকরী-বাকরী করি না। আমার ভয় লাগে.. পারি না।"

বিবিসি বাংলা 

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer