ছবি : সংগৃহীত
ঢাকা : ব্রিটিশমুক্ত ভারতে ‘ভগবানজি’র ছদ্মবেশে আর্বিভূত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সান্নিধ্যধন্য হয়ে তাঁর সেবা করার বিরল সুযোগ হয়েছিল যাঁর, সেই সুরজিত দাসগুপ্তও চলে গেলেন নীরবে। লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত এই আজন্ম নেতাজি অনুগামী স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যা ৭ টায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর কলকাতার ঝামাপুকুরে নিজবাড়িতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
অকৃতদার সুরজিত দাসগুপ্ত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি বিপ্লবী দীনেশ দাসগুপ্তের বংশধর। ‘নেতাজির তথ্যভাণ্ডার’ বলে পরিচিত এই দেশপ্রেমিক আমৃত্যু নেতাজির আদর্শ ও চেতনাকে সমুন্নত রাখার চেষ্টায় সক্রিয় ছিলেন। তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু কিংবা ‘স্ত্রী-কন্যা’ নামে প্রচারিত মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের অগ্রভাগেও ছিলেন প্রয়াত সুরজিত দাসগুপ্ত।
‘ভগবানজি’ নেতাজির আরেক স্নেহধন্য ‘ব্রজনন্দন’ দুলাল নন্দীর প্রয়াণের দেড় মাসের কাছাকাছি সময়ে সুরজিত দাসগুপ্তের এই চলে যাওয়া নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শিক লড়াইয়ে এক অপূরণীয় ক্ষতি।
ব্রিটিশ বিতাড়িত ভারতবর্ষে বিট্রিশের অনুগত রাজনৈতিক শক্তি শাসন ক্ষমতায় আসীন থাকায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরযোদ্ধা ও তাঁর অনুগামীরা অবর্ণনীয় নির্যাতন এবং নিগ্রহের শিকার হন। মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধ করা আজাদ হিন্দ ফৌজের বীর সেনানিরা দশকের পর দশক নিদারুণ মানবেতর জীবনযাপন করলেও রাষ্ট্র তাদের পাশে দাঁড়ায়নি, এমনকী মৃত্যুর পর শেষযাত্রাতেও মেলেনি শ্রদ্ধা সম্ভাষণ। সদ্য প্রয়াত সুরজিত দাসগুপ্ত সেইসব নিগৃহীত বিপুল সংখ্যকদেরই একজন।
বিশিষ্ট নেতাজি গবেষক ও কলকাতার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক আলিপুর বার্তার সম্পাদক ড. জয়ন্ত চৌধুরি সুরজিত দাসগুপ্তের প্রয়াণের খবর নিশ্চিত করে বলেন, ‘‘নেতাজির আরেক ‘তথ্যভান্ডার’ আজ চলে গেলেন। নিভৃতচারী এই নেতাজি অনুগামীর তরফে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে বহুজন সমাজে প্রতিষ্ঠা পেলেও তিনি সবার অন্তরালেই থেকে গেছেন।’
‘‘নেতাজির তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা স্ত্রী-কন্যা তত্ত্ব হাজির করে যে জঘন্য মিথ্যাচার চলে, তিনি সেসবের বিরুদ্ধে রুঁখে দাঁড়িয়েছিলেন। একইভাবে নেতাজিকে নিয়ে নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করে ‘ফরগটেন হিরো’ নামে যে সিনেমা নির্মাণ করেন, এর বিরুদ্ধে ডা. মধুসূদন পাল, প্রয়াত সুরজিত দাসগুপ্তসহ আমরা আইনি লড়াই করেছি’’-যোগ করেন ড. চৌধুরি।
তিনি বলেন, ‘‘এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশে ‘ভগবানজি’ নেতাজির রহস্য উন্মোচনে গঠিত সহায় কমিশনের এ সংক্রান্ত বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন প্রয়াত সুরজিত দাসগুপ্ত। ভগবানজির ছদ্মবেশে থাকা নেতাজির সেবা করার বিরল সুযোগ হয়েছিল তাঁর। নেতাজি বিষয়ক বহু তথ্য সযতনে নিভৃতে আগলে রাখলেও সহায় কমিশন তা গ্রহণ করেনি। সেই কমিশনের প্রতিবেদন দেখে যেতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে চলে গেলেন তিনি’’।
প্রয়াত সুরজিত দাসগুপ্ত যে তথ্যভান্ডার বহন করে আসছিলেন, এই প্রজন্মের নবীন নেতাজি গবেষকদের তা সংগ্রহ করে নেতাজির আদর্শ ও মহিমাকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌছে দেওয়ার অনুরোধও জানান ড. জয়ন্ত চৌধুরি।
জানা গেছে, লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন সুরজিত দাসগুপ্তকে নার্সিং হোম থেকে নিজ বাসায় নেওয়া হয়েছিল। বুধবার বিকেল থেকে তাঁর অবস্থার অবনতি হতে থাকে। অন্তিমযাত্রার প্রাক্কালে সুরজিত দাসগুপ্তে শয্যাপাশে উপস্থিত ছিলেন নেতাজি গবেষক, তাঁর বন্ধু ও চিকিৎসক মধুসূদন পাল, নেতাজি গবেষক ড. জয়ন্ত চৌধুরিসহ নেতাজিপ্রেমীরা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে তাঁর শ্বাসকষ্ট ক্রমেই বাড়তে থাকে। ৭টার দিকে পরলোকগমন করেন নেতাজির সান্নিধ্যধন্য ও বহু তথ্যের আধার সুরজিত দাসগুপ্ত।
বহুমাত্রিক.কম