Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

বেকারত্বের ঘানি টেনে জীবনসংগ্রামে নারী চা শ্রমিকরা

নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৩:০৩, ৮ মার্চ ২০১৮

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

বেকারত্বের ঘানি টেনে জীবনসংগ্রামে নারী চা শ্রমিকরা

ছবি : বহুমাত্রিক.কম

মৌলভীবাজার : ‘সময় এখন নারীর : উন্নয়নে তারা বদলে যাচ্ছে গ্রাম-শহরের কর্ম-জীবন ধারা’ এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে আজ ৮ মার্চ আন্তজার্তিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে। বেকার ও অধিকার বঞ্চিত নারীরা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে পুরুষের পাশাপাশি সমান কাজ করলেও অবসান ঘটেনি মজুরি বৈষম্যের। অথচ নারীর ভূমিকা সমাজ-সভ্যতার অগ্রযাত্রার ইতিহাসে সমান্তরাল।

“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর” জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পঙক্তিমালায় নারীর এ বীরত্বগাথায় কোন বাহুল্য নেই। নারী দিবসের এই দিনেই গোটা জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয় জগতের শক্তির উৎস আর প্রেরণা হচ্ছে নারী। তবে এই নারী সমাজের একটি বিশাল অংশ রয়েছে অবহেলিত। কর্মক্ষেত্রে নারীর মজুরি পুরুষের চেয়ে রয়েছে অনেক কম।

নারীর সমঅধিকার, মর্যাদা, শ্রম-মজুরির বৈষম্য দূরীকরণ, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধান, কর্মযাত্রায় সম্মান ও নুন্যতম বাঁচার অধিকার এসব বিষয়কে সামনে রেখে ৮ মার্চকে নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা আদায়ের দিন বলা হয়। তবে দেশের অন্যান্য সেক্টরের নারী শ্রমিকদের মতো দেশের চা বাগানের নারী শ্রমিকদের একটি বিরাট অংশ ন্যায্য অধিকার ও করুন চিত্র নিয়েই বেকারত্বের ঘানি টেনে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চা বাগানের নারী শ্রমিকরা পাতি উত্তোলন সহ বাগানের অন্যান্য কাজে নিয়োজিত থাকলেও প্রায় পয়তাল্লিশ শতাংশ নারীরা রয়েছেন বেকার। পাঁচ, সাত সদস্যের পরিবার থাকলেও একজনের ৮৫ টাকা মজুরি দিয়ে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। ফলে সংসারের হাল টেনে ধরতে বাধ্য হয়ে বেকার নারীরা বস্তি ও শহরের কনস্ট্রাকশন, কৃষি, নার্সারি, বাড়ি তৈরী ও ইটভাঙ্গা সহ ঝুঁকিপূর্ণ ও কঠিন কাজে নিয়োজিত হচ্ছেন। স্বল্প মজুরিতেও তারা পুরুষের সমান কাজ করেও তারা মজুরি বৈষম্যের শিকার। কৃষি ও নার্সারি সমুহে চা বাগানের নারী শ্রমিকদের মজুরি আশি থেকে একশ’ টাকা আর পুরুষ শ্রমিকের মজুরি একশ’ বিশ থেকে একশ’ পঞ্চাশ টাকা। বাসাবাড়ি নির্মাণে কনস্ট্রাকশন কাজে নারী শ্রমিকরা একশ’ পঞ্চাশ থেকে ২শ’ টাকা এবং পুরুষ শ্রমিকরা দুইশ’ পঞ্চাশ থেকে তিনশ’ টাকা হারে মজুরি পাচ্ছেন।

চা বাগানের শ্রমিক অনুরোধ রবিদাস, শ্রমিক সর্দার শিউ প্রসাদ গৌঢ় জানান, রাস্তা ও বিল্ড্রিং নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ঠিকাদাররা মাটি কাটা, ইট-বালি, কনক্রিট বহন কাজে পুরুষদের তুলনায় মহিলা শ্রমিকদের কম টাকায় সহজেই খাটানো যায়। তাই এসব কাজে চা বাগানের নারী শ্রমিকদের বেঁচে নেওয়া হয়। অভাবী সংসারে কোন মতে বেঁচে থাকার সংগ্রামে কাজ না পেয়ে নারী শ্রমিকরা এসব কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বাসা বাড়ির কনস্ট্রাকশন কাজে নিয়োজিত মৌলভীবাজারের আলীনগর চা বাগানের নারী শ্রমিক সুমা মুন্ডা, সঞ্জিতি বাউরী, ময়না গৌড়, রীতা বাউরী বলেন, চা বাগানে আমাদের কাজ নেই। সংসার চালাতে ইটভাটা ও বিল্ড্রিং নির্মাণ কাজে ৮ থেকে ৯ ঘন্টা কাজ করে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে মজুরি পাই। আর পুরুষরা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা হারে মজুরি পান।

ডানকান ব্রাদার্স শমশেরনগর চা বাগান এর নারী শ্রমিক কাঞ্চনী বাউরী, সবিতা রিকিয়াশন ও সাবিত্রি রবিদাস বলেন, ‘দাদা কাজ না করলে ক্যামনে খাইমু। ছংসারে (সংসারে) আমরা স্বামী-স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে ছয়টা, একজনে কাজ করে রোজ ৮৫ টাকা পায়। এই টাকা দিয়ে চাল কিনবো, না খরচ করবো। অছুখ (অসুখ) বিছুখে (বিশোক) ঔছধ (ঔষধ) কিনতে পারি না। বাধ্য হয়ে বস্তিতে রাস্তার মাটি কাটা ও নার্সারীতে কাজ করে একশ’ একশ’ বিশ টাকা করে মজুরি দিয়ে কোন মতে সংসার চালাই।’

সরেজমিনে দেখা যায়, চা বাগান সমূহের বেকার মহিলা শ্রমিকদের জীবন চলছে খুবই দুঃখ কষ্টে। পরিবার পরিজন ও সন্তানাদি নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে পুরুষদের পাশাপাশি তারা কঠিন কাজে লিপ্ত রয়েছেন। যুবতি মহিলারাও চা বাগানের বাইরের আশপাশ গ্রামের রাস্তা, কালভার্ট নির্মাণে মাটি কাটা ও মাথায় টুকরি দিয়ে মাটি স্থানান্তরের মতো কঠিন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রতিদিন সকালে দলবদ্ধভাবে পুরুষদের পাশাপাশি ঐসব মহিলা চা শ্রমিকরা কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়ান। এদের কেউ কেউ নার্সারী সমূহেও কাজ করছেন। আবার অধিকাংশরাই বস্তি কিংবা শহরের রাস্তা ঘাটে মাটি ভরাটের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। কোদাল ও টুকরি নিয়ে সকালে রুটি দিয়ে নাস্তা করেই বের হয়ে পড়েন। সন্ধ্যা হলেই কাজ শেষ করে বাসায় ফিরেন। তবে নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের মজুরি ক্ষেত্রে রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক নারী ফোরামের আহ্বায়ক গীতা কানু ও সদস্য লছমি রানী রাজভর এই প্রতিবেদককে বলেন, চা শিল্পে নারীদের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বেকার। তারা চা বাগানের বাইরে গিয়ে স্বল্প মজুরিতে ঝুঁকিপূর্ণ ও কঠিন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তারা আরও বলেন, এ অবস্থা থেকে পরিত্রানের জন্য চা বাগানের পরিত্যক্ত জমি আবাদ করে শিল্পের প্রসার বৃদ্ধি, বেকারত্ব দূরীকরণ, তিনশ’ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer