Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৬ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

বীরশ্রেষ্ঠের সমাধি শনাক্তকারী সেই পরিবারের ভাগ্য কী ফিরবে?

মো : মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত: ০৩:১৬, ২০ এপ্রিল ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

বীরশ্রেষ্ঠের সমাধি শনাক্তকারী সেই পরিবারের ভাগ্য কী ফিরবে?

ছবি : বহুমাত্রিক.কম

রাঙ্গামাটি : নানিরচরের বুড়ির ঘাটের বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিস্থল এবং স্মৃতিসৌধ সীমান্ত শিখায় যারা একবারের জন্যেও গেছেন তাদের সকলের কাছে অতি প্রিয় মানুষ ত্রিশোর্ধ্ব বিনয় কুমার চাকমা। তিনি এই স্মৃতিসৌধের কেয়ার টেকারের দায়িত্ব পালন করছেন ১৮ বছর ধরে।

একজন বীরশ্রেষ্ঠের সমাধিস্থলের রক্ষণাবেক্ষণ এবং স্মৃতিসৌধের দেখ ভালের দায়িত্ব পেয়ে তিনি অত্যন্ত সততা এবং নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন । বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফের সমাধিস্থল সনাক্তকারী দয়াল চন্দ্র চাকমার ভাতিজা এবং যতীশ চন্দ্র চাকমার পুত্র বিনয় চাকমার কাঁধে রাঙ্গামাটি বিজিবি সেক্টরের পক্ষ থেকে স্থানীয় ভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এই দেখভালের।

বছর সাতেক আগে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতিসৌধে গিয়ে বিনয় চাকমার দেখা পেলেও সেময় খুব বেশী কথা হয়নি। তবে গত ১৮ এপ্রিল বিকালে আবারো বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দু রউফের স্মৃতিসৌধ ‘সীমান্ত শিখা’য় গিয়ে কথা হলো তাঁর সাথে। শুধু নামেই বিনয় নয় তাঁর কথা বার্তায়ও এই বিনয় ভাব স্পষ্ট প্রকাশ পায়।

স্মৃতিসৌধের পাশের আরেকটি পাহাড়ে বিনয়ের পরিবারের বসবাস। বিকালে স্মৃতিসৌধে গিয়ে খবর দেয়ার সাথে সাথেই মিনট দশেকের মধ্যেই তিনি হাজির স্মৃতিসৌধে। সাদা সার্ট আর প্যান্ট পরিহিত বিনয়কে দেখে মনে হলো খুব পরিপাটি অবস্থা পছন্দ তাঁর।

বিনয় জানান, যেহেতু তার জন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধের কয়েক বছর পরে-তাই এই বীরের কথা তিনি তাঁর চাচা দয়াল বাবু এবং বাব যতীশ বাবুর কাছ থেকেই শুনেছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল বুড়িরঘাটের এই টিলায় পাক হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের পরের দিন তার পিতা যতীশ চন্দ্র চাকমা এবং চাচা দয়াল চন্দ্র চাকমা এই টিলা থেকে মুন্সী আব্দুর রউফের খন্ড-বিখন্ড মৃত দেহের বিভিন্ন অংশ সংগ্রহ করে সেখানেই তাঁকে সমাহিত করেন। সেসময় তাঁরা কেউ জানতনা যাকে তারা সমাহিত করেছেন তিনি কে? তবে ঘটনাস্থলে ইপিআরের পোশাকের অংশ এবং মুন্সী আব্দুর রউফের ছিন্ন ভিন্ন পায়ের বুট থেকে তারা বুঝেছিলেন এটি কোন সৈনিকের মৃত দেহ হবে।

বিনয় চাকমা জানান, তাঁর পিতা এবং দয়াল বাবু দুজনেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সমর্থক ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও যতীশ বাবুর বাসায় রাখা হতো। তবে এক সময় তারা যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এই বিষয়টি তৎকালীন চাকমা রাজার কানে পৌছানোর পর যতশি বাবুকে এদিন রাজার লোকজন ধরে নিয়ে যায়। তাঁকে রাজবাড়ীতে এনে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে, একই সাথে চলে নির্যাতন। তবে যতীশ বাবু কোন তথ্যই তাদের দেননি। পরে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। যেদিন যতীশকে চাকমা রাজার লোকজন ধরে নিয়ে যায় সেদিনও তাঁর বাসায় মুক্তিযোদ্ধাদের ৫ টি অস্ত্র এবং মুন্সী আব্দুর রউফের ছেড়া বুট ছিল। তবে রাজার লোকজন এগুলো খুঁজে পাননি। যতীশকে ধরে আনার পর তাঁর স্ত্রী এইসব অস্ত্র ও বুট কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ফেলে দেয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেক তথ্য উদঘাটনের পর এবং সেসময় সেখানে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মূখ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তৎকালীন ইপিআরের সদস্যদের তথ্যমতে, অনেক দিন পর নিশ্চিত হওয়া যায় বুড়িঘাটে সেদিন দয়াল এবং যতীশ যাকে সমাহিত করেছিলেন তিনি বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ। পরবর্তীতে তৎকালীন বিডিআরের পক্ষ থেকে এব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধ্যান চালানোর পর দয়াল চনআদ্র চাকমার ঘটনার বর্ণনার পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। ১৯৯৭ সনের ১ মার্চ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিস্থল যথার্থভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে সেসসময় তাঁর চাচা দয়াল বাবুর নাম ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হলেও প্রচারের আড়ালে থেকে যান বাবু।

একজন বীরশ্রেষ্ঠের সমাধিস্থল এর স্থান খুঁজে বের করার কাজে তাঁর পিতা এবং চাচা মূল্যবান ভুমিকা রেখেছিলেন-এই বিষয়টি ভেবেই তিনি গর্ববোধ করেন। তবে বাবা এবং চাচার মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি না পাওয়ার মন বেদনা তাঁর রয়ে গেছে। বিনয় বাবু ২০০৯ সালে মারা গেলেও এখনো বেঁচে আছেন চাচা দয়াল চন্দ্র চাকমা । তিনিও (দয়াল বাবু) এখন বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত। বিনয় বাবুর আকুতি মুক্তিযুদ্ধের সহায়তাকারী হিসাবে তার পিতা এবং চাচাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হোক। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের পরিচয় নিয়ে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা বেঁচে থাকতে চান।

বিনয় চাকমা জানান, গত ১৮ বছর যাবৎ কেয়ার টেকারের চাকুরি করলেও তাঁর চাকুরিটি এখনো নিয়মিতকরণ করা হয়নি। বিজিবি, রাঙ্গামাটি সেক্টর হতে প্রতি মাসে সাড়ে সাত হাজার টাকার সম্মানি ভাতা পান তিনি। তাঁর অপর চাচাত ভাই দয়াল বাবুর ছেলে পান মাসিক ৫ হাজার টাকা। বিনয় এখন আয়ের স্থায়ী পথই হচ্ছে এই সম্মানি ভাতা।

তিনি কী পাচ্ছেন বা কি পাবেন এই বিষয় নিয়ে খুব বেশী চিন্তিত নন। তাঁর মতে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতিসৌধের দেখভাল করার দায়িত্ব পাওয়াটাই তাঁর কাছে গৌরবের বিষয়। তবে চাকুরিটি নিয়মিত কিংবা বিজিবির কোন পদে স্থাযী চাকুরি পেলে তাঁর পরিবারের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হতে পারে বলেই তাঁর আশা।

বিনয় চাকমা প্রতিদিন সকালে একবার আসেন স্মৃতিসৌধে। পরম যত্ন সহকারে পরিস্কার করে স্মৃতিসৌধের বিভিন্ন জায়গা। সমাধিস্থল যাতে সব সময় পুত পবিত্র এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকে সেদিকে তাঁর সজাগ দৃষ্টি। আর যে কোন সময় বড় কোন কর্তা কিংবা দর্শনার্থী আসলে খবর পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি ছুটে আসেন সমাধি স্থলে। তাঁর হাতে থাকে পরিদর্শন বই।

সেখানে দর্শনার্থীদের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করার পর আবারো পরম যত্নে সংরক্ষণ করেন পরিদর্শন বই। পরিদর্শন বইতে সামরিক বাহিনীর উর্ধ্বতন অফিসার হতে শুরু করে, প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, জপ্রতিনিধি, সাংবাদিক সহ বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে পরিচিত হতে পেরে তিনি খুব খুশী হন। বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির হানিফ সংকেত সম্প্রতি মুন্সী আব্দুর রউফের বুড়ির ঘাটের স্মৃতিসৌধের উপর একটি প্রতিবেতন প্রস্তত তরে তা বিটিভিতে প্রচারের কারণে মুন্সী আব্দুর রউফের বুড়িঘাটের স্মৃতি সৌধের ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার হয় বলে তিনি জানান।

দয়াল চাকমা কিংবা যতশি চাকমারা আমাদের গর্ব আমাদের অহংকার। ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল সেদিন তারা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের মৃতদেহকে সমাধিস্থ করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর কবর শনাক্তকরণেও রেখেছিলেন মূল্যবান ভুমিকা। এখন বিনয় চাকমা দেখাশুনা করছেন মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিস্থল। যেখানে প্রতিটি পর্যায়ে তাদের রয়েছে দেশের প্রতি গভীর মমত্ব বোধ ও দেশপ্রেম।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিস্থল চিহ্নিতকারী দয়াল চাকমা ও যতীশ চাকমা যারা মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করেছিলেন-তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিটি আজ সব মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। বিষয়টি সুবিবেচনার দাবি জানাই। একইসঙ্গে বলতে চাই-যেখানে প্রতিনিয়ত হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে, সেখানে বিনয় চাকমা কিংবা দয়াল চাকমার ছেলেদের জন্য দুটি সরকারি চাকুরি দেয়া কি কঠিন কোন কাজ ?

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক এবং অধ্যক্ষ, রাঙ্গামাটি শিশু নিকেতন।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer