Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৬ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

বিশেষ সম্পাদকীয়: ‘পুলিশ পেটিকোটের ভেতরেও ঢুকতে পারে’?

শওকত আলী বেনু  

প্রকাশিত: ১৯:৩৩, ১২ অক্টোবর ২০১৬

আপডেট: ১১:১৫, ১৩ অক্টোবর ২০১৬

প্রিন্ট:

বিশেষ সম্পাদকীয়: ‘পুলিশ পেটিকোটের ভেতরেও ঢুকতে পারে’?

 

‘পুলিশ পেটিকোটের ভেতরেও ঢুকতে পারে’/ ‘বাড়িতে ঢুকে সেনা সদস্যকে লাঞ্ছিত করল ডিবি পুলিশ’ এই দুটি শিরোনামে গতকাল একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে একাধিক সংবাদ মাধ্যমে।

বিষয়টি একদিকে যেমন স্পর্শকাতর, অপরদিকে একজন সেনা সদস্যের পরিচয় জানা সত্বেও একটি অসামরিক বাহিনীর লাগামহীন দাম্ভিকতা এবং কটূক্তি কর্মরত সেনা সদস্যের জন্যে বিব্রতকর এবং অসম্মানজনকও বটে ।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের সূত্রে জানা যায় ‘রাজশাহী সেনানিবাসে কর্মরত সেনা সদস্য মো. আবদুর রউফ ছুটিতে গাজীপুরের শ্রীপুর থানার নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। দুপুরে তিনি তার ছেলেকে বাথরুমে গোসল করাচ্ছিলেন এসময় সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশের কয়েকজন সদস্য কাউকে কোনো কিছু না বলে বাড়ির ভেতর ঢুকে বাথরুমের দরোজায় সজোরে লাথি মেরে ভেতরে ঢুকে পড়ে’।

হতভম্ব সেনা সদস্য নিজ পরিচয় দেয়া সত্ত্বেও ডিবি পুলিশের ওই সদস্যরা তাকে জেরা করতে থাকেন এবং উত্তেজিত হয়ে সেনা সদস্যকে সজোরে চরথাপ্পড় মারতে থাকেন।এক পর্যায়ে ডিবি পুলিশের কুটক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যা শুধু বিব্রতকরই নয় অপমানজনকও বটে ‘‘আমাদের যেখানে দরকার সেখানে যাব, তোর বাথরুম কেন,দরকার হলে পেটিকোটের (নারীদের পরিধেয় কাপড়) ভিতর ঢুকব’’। এই চরম দম্ভ ভয়ঙ্কর লজ্জাজনক।

ঘটনাটি হলো ডিবি পুলিশ স্বাধীন নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে ধরতে যান ওই বাড়িতে। ওই মাদক ব্যবসায়ীর পরিচয় এবং আস্তানা সুনির্দিষ্টভাবে নিশ্চিত না করেই তারা একটি বাড়িতে ঢুকে যান এবং একজন নিরাপরাধ নাগরিকের উপর অমানবিক আচরণ ও অশোভনীয় কূটক্তি করেন। যদিও পরে বিষয়টি ‘ভুল বুঝাবুঝি’ হয়েছে বলে ডিবি পুলিশ স্বীকার করেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময় হল ১৯৭১ সাল। পাকিস্থানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা দেশের প্রধান অসামরিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাটির নাম বাংলাদেশ পুলিশ।

১৮৬১ সালে the commission of the Police Act (Act V of 1861) বৃটিশ পার্লামেন্টে পাশকৃত আইনের অধীনে ভারতের প্রতিটি প্রদেশে একটি করে পুলিশ বাহিনী গঠিত হয়। আর বৃটিশদের তৈরীকৃত এই ব্যবস্থা থেকেই আজকের এই বাংলাদেশ পুলিশ প্রবর্তিত হয়েছে।

মোটাদাগে এক সময় শুধু চুরি-ডাকাতি রোধ, ছিনতাই প্রতিরোধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইত্যাদি সমাজ বিরোধী কর্মকান্ড প্রতিরোধ করা ছিল পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব। সময়ের পরিবর্তনে গত এক দশকে জঙ্গিবাদ দমন এবং নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশ বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে যা সর্বত্র সমাদৃত।

তবু কখনো কখনো পুলিশ বাহিনীর অত্যাচারী মনোভাব এবং অসহনীয় দুঃশাসন সাধারণ নাগরিকের জীবনকে বেসামাল করে তোলে যা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। এমন নজির একটি নয় হাজার-লক্ষ দেয়া যাবে। তাই এই ঘটনাটিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাস্যকর বিবৃতি ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা বলে পার পাওয়া যাবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই ।এটি আমার অগ্রিম আশংকা।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, শিল্প বিপ্লবের কারণে ইংল্যান্ডের সামাজিক ব্যবস্থায় অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে স্যার রবার্ট পিল একটি নিয়মতান্ত্রিক পুলিশ বাহিনী গঠনের অভাব অনুভব করেন। তখন ১৮২৯ সালে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে পুলিশ গঠনের একটি বিল আনেন। তার প্রেক্ষেতেই গঠিত হয় লন্ডন মেট্রো পুলিশ। অপরাধ দমনে বা প্রতিরোধে এর সাফল্য শুধু ইউরোপ নয় সাড়া ফেলে আমেরিকায়ও। ১৮৩৩ সালে লন্ডন মেট্রো পুলিশের অনুকরণে গঠিত হয় নিয়ইয়র্ক সিটি নগর পুলিশ কর্তৃপক্ষ। আমাদের পুলিশের গোড়াপত্তনেও তাঁদেরই অবদান।

ইউরোপ ঘুরে দেখেছি পুলিশ মানুষের পরম বন্ধু। যেকোনো বিপদে রাস্তায় পুলিশ দেখলে মানুষ স্বস্তি পায়। ভরসা থাকে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার। বাংলাদেশেও এমন নজির একেবারে নেই তা বলছি না। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের উপর পুলিশের অযাচিত হয়রানি-নির্যাতন ছিঁটে-ফোঁটা দুই একটা ভালো কাজের মূল্যায়ন শূন্যে মিলে যায় যা গোচরীভূত হয়না বললেই চলে।

পুলিশ এতো দম্ভ পায় কোত্থেকে? পুলিশের দম্ভ ‘প্রয়োজনে বাথ রুমে কেন (?) প্যাটিকোটের ভিতরেও প্রবেশে করবে’! আমরা কোন স্বর্গে বসবাস করছি? পুলিশের এই দুঃসাহসিক পুলিশি মনোভাব পরিত্যাগ না করলে কিংবা একজন নাগরিকের গায়ে বিনা প্রয়োজনে হাত দেয়ার কোনো এখতিয়ার পুলিশের নাই এই বিষয়টি যতদিন আমাদের পুলিশ বাহিনী বুঝতে না শিখবে ততদিন পুলিশ মানুষের বন্ধু হতে পারবে না।

আমরা জানি ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা মোতাবেক পুলিশ বিনা পরোয়ানায় ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়াই সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যেকোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে।

৫৪ ধারা মোতাবেক ‘কোন আমলযোগ্য অপারাধের সহিত জড়িত কোন ব্যক্তি অথবা এইরূপে জড়িত বলিয়া যাহার বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত অভিযোগ করা হইয়াছে অথবা বিশ্বাসযোগ্য খবর পাওয়া গিয়াছে অথবা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রহিয়াছে এমন ব্যক্তিকে আটক করা যাইতে পারে’।

বিষয়টিকে নেতিবাচক দিক থেকেও দেখা প্রয়োজন। এখানে বিষয় দুটি। একটি ‘সুনির্দিষ্ট’ অভিযোগ আর অন্যটি ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। প্রথমটি না হয়ে দ্বিতীয়টি যে পুলিশ বিভাগের কোনো সদস্য প্রয়োগ করছে না এমনটির নিশ্চয়তা পুলিশ বাহিনীকে দিতে হবে।

এই ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগটি যদি পরবর্তীতে সুনির্দিষ্ট না হয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় তাহলে কী ওই কর্মযজ্ঞের জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে ‘অপরাধ সংঘটিত করেছে’ এই মর্মে আদালতে বিচারের জন্যে অভিযুক্ত করা যাবে না? এখানেও কী আইন নাগরিককে সুরক্ষা দেয়নি?

আমরা মনে করি ঘটনা তদন্তে সংশ্লিষ্ট ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। এতে করে বাংলাদেশ পুলিশের জবাবদিহিতা আরো বৃদ্ধি পাবে বৈকি।

প্রসঙ্গক্রমে আর একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছিনা। একজন মাদক ব্যবসায়ীকে ধরার জন্যে ডিবি পুলিশের হুমকি ‘প্রয়োজনে বাথরুমে কেন প্যাটিকোটের ভিতরেও প্রবেশে করবে’! আর ঐদিকে পুলিশ বাহিনীর ‘হাইওয়ে পুলিশ’ অপরাধী ধরার জন্যে হাইওয়ের ২০ মিটারের বাইরে গিয়ে অপরাধী ধরতে পারছে না !

আমাদের দেশের প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার মহাসড়কে নিরাপত্তা জোরদার ও দুর্ঘটনা রোধে ২০০৫ সালের ১৪ জুন গঠন করা হয় হাইওয়ে পুলিশ। কিন্তু হাইওয়েতে নানা রকমের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ হাইওয়ে পুলিশ বলছে মহাসড়কের দুই ধারে ২০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হাইওয়ে পুলিশের সব ক্ষমতা। অপরাধ করে অপরাধীরা সড়কের ২০ মিটার বাইরে গিয়ে আশ্রয় নিলে পুলিশের আর কিছু করার থাকে না।

হাইওয়ে পুলিশে ভাষ্য-‘২০ মিটারের বাইরে গিয়ে ঘটনার তদন্ত করা কিংবা আসামী ধরা অথবা মামলা নেয়ারও এখতিয়ার নেই হাইওয়ে পুলিশের।’ ফলে সড়কে অপরাধ করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। তাই সীমানার বাইরে গিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে আইনি বাধা উৎরানো যাচ্ছে না।

সীমানা পরিত্যাগ করা কিংবা এখতিয়ার বহির্ভূত কোনো কর্মযজ্ঞ সাধন করা কারো জন্যেই আইন পারমিট করেনা। তবু আমাদের ডিবি পুলিশ প্রয়োজনে প্যাটিকোটের ভিতরেও প্রবেশ করার হুমকি দেয়। আবার ঐদিকে হাইওয়ে পুলিশ ২০ মিটারও অতিক্রম করতে পারেনা অপরাধী ধরার জন্যে। আমরা পুলিশ বিভাগের এই সব অসঙ্গতির দ্রুত অবসান চাই।

 

শওকত আলী বেনু: সম্পাদক, বহুমাত্রিক.কম 

[email protected]  

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer