Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৬ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

বিবিধ কাব্যে মাইকেল

পদ্মনাভ অধিকারী

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ২৪ জানুয়ারি ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

বিবিধ কাব্যে মাইকেল

স্বদেশে প্রবাসি আমি, যেন কারারুদ্ধ/কবে হবে বাঙালীর মন, আর সূচিশুদ্ধ!

শুরুতে আমার এই উক্তিতে; হয়তো অনেকের মনে বজ্রপাত হতে পারে। সত্য কথা বলতে কি, আমি যা বলতে চেয়েছি, সেটা একটু ভিন্নভাবের কথা। তা হলো এই, ভারতবর্ষে কেবল নয়, সমগ্র এশিয়ার বাঙালী বলতে এক বাক্যে যাদের বুঝি (ধর্ম যা হোক) তাদের মনে ও মননে কবি নজরুল (১৮৯৯-১৯৭৬) - রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) হয়ে আছে ভালবাসার ফুল, অথচ তাদেরই কাছে দিনে দিনে মাইকেল (২৫-০১-১৮২৪, ২৯-০৬-১৮৭৩) হয়ে যাচ্ছে ভুল! এই ভুলটা বাঙালীর এক প্রকার ছুত মার্গের ব্যাপার। মাইকেল যেন অছুত অথচ সে বাঙালী। বাঙালী হিসেবে বাঙালীকে মূল্যায়ণ করার মানসিকতা থাকবে না কেন?

আমরা বিদেশী সাহিত্য পড়ছি, বিদেশী কবিদের নিয়ে মাতামাতি করছি, তাদের যেন গলার হার বানিয়ে রেখে বাংলা ভাষা-কবিদের ছুড়ে ফেলে দিলে ভাল হয়-এমনই সময়ের অবস্থা! অথচ যদি প্রশ্ন করা যায়-বিদেশে-বিদেশী সাহিত্যে, বিশেষ করে আলোচনা সাহিত্যে গত পাঁচশত বছরে কতজন বাঙালী কবি স্থান পেয়েছে বা হয়েছে! তাহলে কেউ কি সঠিক জবাব দিতে পারবো? না। এ জবাব কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তাহলে আমরা কেন আমাদের সন্তানকে স্বেচ্ছায় অচ্ছুত করে কারারুদ্ধ করে দূরে সরিয়ে রাখবো? কেন আমরা শুচিশুদ্ধ হবো না?

কিটস্, শেলি, বায়রন, মিল্টন, হোমার-এসব পাশ্চাত্য কবিরা যদি আমাদের সাহিত্যে প্রবেশাধিকার পায়, তাহলে-স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, তারা কি ছিল? কোন জাত-কোন ধর্মের? সেক্ষেত্রে মাইকেল-? সে বাঙালী। একজন খাঁটি বীর বাঙালী। আজ যদি বঙ্গীয় সাহিত্যের উৎস ধারায় যাই, তাহলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হবে, তা হলো- মাইকেল যুগসন্ধিক্ষণের কবি। তিনি ঠিক যুগসন্ধিক্ষণেই মেঘনাদবধ মহাকাব্য রচনা করেছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য আদর্শ আর পাশ্চাত্য কাব্যকলার অনুকরণে যে নতুন বাংলা কাব্যের সৃষ্টি করেছিলেন, বা করে গ্যাছেন, তার পরবর্তী বহু মহারথির আবির্ভাব হলেও, তাকে কেউ অতিক্রম করতে পারেনি- এটাই বাস্তব, এটাই বাঙালীর অনন্য গৌরবস্তম্ভ।

মধুসূদন থেকে বাংলা কাব্যের যে পুনরুজ্জীবন শুরু হয়েছে, তারই স্রোতধারা কবি গুরু রবীন্দ্রনাথে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গ্যাছে, যা কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। এতো ঘটনার পরও মধুসূদন নিজের দেশে আজও বিদেশী, যা ভাবতে গেলে নিজের প্রতি ঘৃণা হয়।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সে-ই আদি কারিগর সে-ই আদি প্রতিভার উজ্জ্বল পরিচয়। বিশ্বসাহিত্য পাঠ করতে গিয়ে দ্যাখ্যা গ্যাছে যে, “ইংরেজী ব্লাঙ্কভার্স মিল্টনীয় পরিণতি লাভ করিতে অন্তত একশত বছর সময় লাগিয়াছিল। এখানে মাইকেলের অমিত্রাক্ষর মাত্র তিনটি বৎসর। আর একটি ছন্দকে কত কাজেই লাগাইছেন কবি। কত সুর-ই না ধ্বনিত করিয়াছেন একছন্দে।”
(মধুসূদনের জীবন ও কাব্য- প্রমথনাথ বিশী- পৃঃ ২৯) তাহলে বাংলা ও বাঙালী কবি মাইকেল মধুসূদন কম কিসে?

মাইকেল মধুসূদনের বিবিধকাব্য প্রসঙ্গেই কিছু আলোকপাত করতে চাই। মধুসূদন একদিকে যেমন প্রতিবাদী অন্যদিকে তেমন প্রগতিবাদী। তিনি তার সমগ্র কাব্যে নতুন সমাজ গড়ার চিত্ররূপ পরিবেশন করে গ্যাছেন। সে সমাজ অধিনতার নয়- পরাধীনতার নয়, মুক্তির। পক্ষান্তরে মধুসূদন প্রেমি ছিলেন, রসিক ছিলেন বটে।

মৎসগন্ধা

চেয়ে দেখ, মোর পানে, / কলকল্লোলিনী / যমুনে! দেখিয়া, কহ, শুনি তব মুখে, / বিধুমখি, আছে কি গো অখিল / জগতে;
দুঃখিনী দাসীর সম? কেন যে / সৃজিলা,- / কি হেতু বিধাতা, মোরে, বুঝিব / কেমনে?
তরুণ যৌবন মোর! না পারি নাড়িতে / পোড়া নিতম্বের ভরে! কবরীবন্ধন / খুলি যদি, পোড়া চুল পড়ে ভূমিতলে!
কিন্তু কে চাহিয়া কবে দেখে মোর / পানে?
না বসে গুঞ্জরি, সখি, শিলীমুখ যথা / শ্বেতম্বরা ধুতুরার নীরস অধরে,- 
হেরি অভাগিরে দূরে ফিরে অধোমুখে / যবকুল; কাঁদি আমি বসি লো / বিরলে“

মৎস্যগন্ধা নিজের রূপ যৌবন নিয়ে বিপাকে। অসহায় হয়ে যমুনাকে সাক্ষী রেখে বিলাপ করে বলছে- হে যমুনা, আমাকে বিধাতা এতো রূপ দিয়েছে কিন্তু কে দেখবে- যুবকদল কোথায়। বিধাতা এরূপ কেন দিলেন।

সুভদ্রাহরণ

আর কি মানিবে কেহ এতিন ভূবনে / অভাগী-ইন্দ্রাণীরে? কেন তাকে দিলি / অনন্ত-যৌবন-কান্তি, তুই, পোড়া / বিধি?

হায় কারে কব দুখ? মোরে অপমানি, / ভোজ-রাজ-বালা কুন্তী-কুল / কলঙ্কিনী,

পাপীয়সী তার মান বাড়ান / কুলিশী?
যৌবন-কুহকে, ধিক্, যে ব্যভিচারিণী / মজহিলা দেব-রাজে, মোরে লাজ দিয়া, / অর্জ্জুন-জারজ তার-নাহি কি / শকতি
আমার-ইন্দ্রাণী-আমি-মারিযে / অর্জ্জুনে,
এ পাড়া চোখের বালি? দূর্য্যােধনে / দিয়া
গড়াইল জতুগৃহ; / ................................. / .................................
এ পোড়া মনের দুঃখ কব তার কাছে, / এ পোড়া মনের দুঃখ সে যদি না পারে / জুড়াতে কৌশল করি; কে আর / জুড়াবে?
যায় যদি মান, যাক। আর কি তা আছে? / .................................... / ................................... / ঘুচাও কলঙ্ক শুভঙ্করি,
পুত্রের কিঙ্কর আমি এ মিনতি করি, / পা দুখানি ধরি।”
উত্তর করিলা গৌরী সুমধুর স্বরেÑ / “পুত্রের বাহন তুমি খ্যাত চরাচরে, / এ আক্ষেপ কর কি কারণে। / হে বিহঙ্গ, অঙ্গ-কান্তি ভাবি দেখ মনে।
চন্দ্রকলাপে দেখ নিজ পুচ্ছদেশে; / রাখাল রাজার সম চূড়াখানি কেশে। / আখ-ল-ধনুর বরণে / মন্ডিলা সু-পুচ্ছ ধাতা তোমার / সৃজনে।

সদা জ্বলে তব গলে / স্বর্ণহার ঝল ঝলে / যাও, বাছা, নাচ গিয়া ঘণের গর্জনে / হরষে সু-পুচ্ছ খুলি / শিরে স্বর্ণ চূড়াতুলি; / কর গে কেলি ব্রজ-কুঞ্জবনে।
(মাইকেল রচনা সম্ভার- প্রমথনাথ বিশী পৃঃ ২৫০-২৫৪)

উপদেশ মূলক কাব্য রচনাও করে গ্যাছেন কবি- 
যেমন-

রসাল ও স্বর্ণলতিকা
(আমগাছ ও কনকলতা পরগাছা)

রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণ- / লতিকারে!
“শুন মোর কথা ধনি, নিন্দা / বিধাতারে!
নিদারুণ তিনি অতি; / নাহি দয়া তব প্রতি;
তেঁই ক্ষুদ্র-কায়া করি সৃজিলা / তোমারে।
মলয় বহিলে, হায়, / নতশিরা তুমি তায়,
মধুকর-ভরে তুমি পড়লো ঢলিয়া; / দিমাদ্রি-সদৃশ আমি,
বন-বৃক্ষ কুল স্বামী, / মেঘলোকে উঠে শির আকাশ / ভেদিয়া।

আম গাছ নিজেই নিজের গুণকীর্তন শুনাচ্ছে স্বর্ণলতিকাকে। সে মনে করে পরগাছা তাকে আশ্রয় করে আছে বলে সে নিরূপায় আর আম গাছ তার আশ্রয়দাতা প্রভু। কিন্তু জগতের প্রভূ স্বর্ণলতিকাকে অনাবশ্যক সৃষ্টি করে- একান্ত অবহেলার মাঝে ফেলে দিয়েছ। তাহলে স্বর্ণলতিকা কেন তাকে প্রভু বলে মাথানত করবে! মহাপ্রভু তাকে এমন ক্ষমতা দিয়েছে যে, বাতাস হলে- মৌমাছি-মধুপাখী বসলে স্বর্ণলতিকার মাথা নুয়ে পড়ে এটা একান্ত অবহেলার। অথচ আম গাছের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটে না। সে বনের অন্যান্য বৃক্ষের স্বামী। তার মাথাটা সুদূর মেঘ ছেদ করে- উপরে উঠেছে। এমন দাবী তার। স্বর্ণলতা কেন স্রষ্টাকে অবহেলা-আর ঘৃণা করবে না!
......................................................

আম গাছ এখানে বলছে- 
শুন, ধনি, রাজ-কাজ দরিদ্র পালন। / আমার প্রসাদে ভুঞ্জে পথ-গামী জন। / কেহ অন্ন রাঁধি খায় / কেহ পড়ি নিদ্রা যায় / এ রাজ চরণে; / শীতলিয়া মোর ভরে / সদা আসি সেবা করে / মোর অতিথির হেথা আপনি পবন! / মধু-মাখা ফল মোর বিখ্যাত ভূবনে। / তুমি কি তা জান না, ললনে? / ......................................... / ......................................... / কিন্তু তব দুখ দেখি নিত্য আমি দুখী; / নিন্দ বিধাতায় তুমি, নিন্দ বিধুমুখি।”

আমগাছ আবারও দর্পভরে স্বর্ণলতিকাকে বলছে যে, তার অতিথিদের পবন নিজেই এসে সেবা করে, তবে সে স্বর্ণলতিকার দুঃখে নিত্য দুখী। বিধুমুখি স্বর্ণলতিকা- তুমি বিধাতার নিন্দা করনা কেন।
.........................................../ ........................................... / নিরবিলা তরুরাজ, উড়িল গগনে / যমদূতাকৃতি মেঘ, গম্ভীর স্বননে; / আইলেন প্রভঞ্জন / সিংহনাদ করি ঘন / যথাভীম ভীমসেন কৌরব সমরে।

সহসা আকাশে ঘনকাল মেঘের আবির্ভাব হলো। ঠিক যমদূতের মত। কুরু পা-বদের যুদ্ধে বিশাল দেহধারী ভীমসেনের আবির্ভাবের মত ঘটনা।

রসাল ভূতলে পড়ি, / হায়, বায়ুবলে / হারাইলা আয়ুসহ দর্প বনস্থলে।

আমগাছ বাতাসের প্রবল আঘাতে ধরাশায়ি হলো বনের ভেতর। তার সমস্ত দর্পচূর্ণ হলো- প্রাণও হারালো। তায় কবি শেষে বলছেন- 
উর্দ্ধশির যদি তুমি কুল মান ধনে / করিওনা ঘৃণা তবু নীচশির জনে! / এ উপদেশ কবি দিলা এ কৌশলে।

তুমি যত বলশালী হও, কিংবা কুল-মানে ধন সম্পদে বড় হও তবুও যারা দুর্বল-অভাবী- তোমার সমকক্ষ নয়- কিংবা দরিদ্র- তাদের ঘৃণা-অবহেলা করনা, কবি কৌশলে রূপকের মাধ্যমে এই উপদেশ দিয়েছেন। সমাজ সচেতন কবি, তাই তিনি উচু-নীচুর ভেদাভেদ ব্যবধান ভুলে গিয়েÑ মানুষ হিসাবে সবাই সমান-এমন মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হওয়ার কথা বলেছেন- তার কাব্যের গীতিকারসে।

দেবদৃষ্টি

দেবদৃষ্টিতে কবি বঙ্গদেশের নৈসর্গিক বিবরণ ও চিত্ররূপ বর্ণনা করেছেন কাব্যিক ধারায় রূপকের মাধ্যমে কথপোকথনে।

একদিন শচী ও শচীপতি স্বর্ণ-মেঘাসনে বসে বের হোলেন বিশ্ব পরিক্রমায় অর্থাৎ বিশ্বদরশনে। এ সময়ে দুজনের আলাপচারিতার ভেতর দিয়ে যা ব্যক্ত করেছেন তা হচ্ছে-

শচী সহ শচীপতি স্বর্ণ-মেঘাসনে / বাহিরিলা বিশ্ব-দরশনে। / আরোহি বিচিত্র রথ / চলে সঙ্গে চিত্র রথ / নিজদলে সুমণ্ডিত অস্ত্র আভরণে, / রাজাজ্ঞায় আশুগতি বহিলা বাহনে।

শচী ও শচীপতি চিত্ররথে চড়ে, অস্ত্রে সুসজ্জিত দল নিয়ে বের হলেন। তারা দেখতে লাগলেন- 
হেরি নানা দেশ সুখে / হেরি বহু দেশ দুঃখে / ধর্ম্মের উন্নতি কোন স্থলে;

অনেক দেশ দেখলেন সুখের, আবার বহুদেশ দুখের। এতসব দেশ দেখলেন কিন্তু তাদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হলো- ধর্ম্মের উন্নতি কোথায়?

কোথাও বা পাপ শাসে বলে / দেব অগ্রগতি বঙ্গে উভরিল।

কোথাও-কোথাও পাপের শাসন, তবে বঙ্গে দেবতার অগ্রগতি হয়েছে। তাইÑ
কহিলা মাহেন্দ্র সতী শচী সুলোচনা-

কোন দেশে এসে গতি / কহ হে প্রাণের পতি / এদেশের সহ কোন্ দেশের তুলনা?

শচী তার পতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে স্বামী। এবার তাহলে কোন দেশে যাবে, সে দেশের সাথে কোন দেশের তুলনা চলে? শচীর এমন প্রশ্নে শচীপতি বল্লেন-

উত্তরিলা মধুর বচনে / বাসব, লো চন্দ্রাননে, / বঙ্গ এদেশের নাম বিখ্যাত জগতে। / সে দেশের নাম বঙ্গদেশ-জগতে সে নাম বিখ্যাত।

এরপর-

ভারতের প্রিয় মেয়ে / মা নাই তাহার চেয়ে / নিত্য অলঙ্কৃত হীরা, মুক্তা, মরকতে।
অর্থাৎ- ভারতের প্রিয় কন্যা-মা বঙ্গো জননী, তার মত কেউ নেই। নিত্য অলঙ্কৃত সে, হীরা, মুক্তা, পান্নাতে।

স্নেহে জাহ্নবী তারে / মেখলেন চারি ধারে / বরুণ ধোয়েন পা দু’খানি। / নিত্য রক্ষকের বেশে / হিমাদ্রি উত্তরদেশে / পরশনাথ আপনি / শিরে তার শিরোমণি / সেই এই বঙ্গভূমি শুন লো ইন্দ্রানী!
অর্থাৎ- জাহ্নবী শচীপতি অর্থাৎ শিবকে চারপাশ ঘুরিয়ে দেখালেন, নিত্য রক্ষকের বেশে উত্তরে অবস্থান করছে হিমালয়, তার মস্তকে শিরমনির মত পরেশনাথ, এই হচ্ছে বঙ্গোভূমি।
................................. / ................................. / হেন দেশে হেন শব্দ কি হেতু জন্মিলা? / চিত্ররথ হাত জোড় করি,
কহে, শুন, ত্রিদিব-ঈশ্বরী! / বিবাহ করিয়া এক বালক যাইছে, / পত্নী আসে দেখ তার পিছে। / সুধাংশুর অংশুরূপে নয়ন-কিরণ /
নীচদেশে পড়িল তখন!
(মাইকেল রচনা সম্ভার- প্রমথনাথ বিশী পৃঃ ৫৫৭)

শচী অর্থাৎ দূর্গা শিবকে সর্বশেষ প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন এই দেশে এমন শব্দ কিসের? সবার সঙ্গী চিত্ররথ দেবীকে বল্লেন- হে ত্রিদিব ঈশ্বরী! এক বালক বিবাহ করে যাচ্ছে সাথে তার স্ত্রী ও পিছু পিছু আসছে। কবি সমগ্র কাব্যে অতি সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা আর বর্ণনার মাধ্যমে বঙ্গোদেশের ভৌগলিক পরিবেশ, সামাজিক পরিবেশের চিত্রায়ণ করেছেন। যেখানে কবির একান্ত স্বাদেশীক বোধের পরিচয় মেলে। কবির দেবদৃষ্টি কাব্যে নায়ক রূপকে দেবদেবী হলেও। নায়িকা প্রকৃতার্থে মানব-মানবীই প্রধান। কারণ কবি দৈবে আর দেববাদে বিশ্বাসী নন, তিনি মানুষের মাঝে সবকিছুই প্রত্যক্ষ করেছেন। মানুষই সব তার বিচারে।

কুক্কুট ও মণি (রূপক কাব্য) (ঐ পৃঃ  ৫৫৯)

কবি এখানে মোরগ ও মণি নিয়ে রূপকাচ্ছলে বিদ্যা ও বিদ্যানের মূল্য সেই সাথে মূর্খের বিষয় ও উপদেশ দিয়েছেন-

খুঁটিতে খুঁটিতে ক্ষুদ্র কুক্কুট পাইল / একটি রতন;- / বণিকে সে ব্যগ্রে জিজ্ঞাসিল;- / “ঠোটের বলে না টুটে, এ বস্তু / কেমন?”

একটা মোরগ খাবার খুঁটতে খুঁটতে একটা রতন বা মণি পেয়ে- 
একজন বণিককে প্রশ্ন করে জানতে চায়, তার ঠোঁটের আঘাতে
তার পাওয়া বস্তুটা ভাংছেনা- তাহলে বস্তুটা কি?
তখন- 
বণিক কহিল,-“ভাই, / এহেন অমূল্য রতন, বুঝি, দুটি নাই।

বণিক জবাবে বল্লে- এর মত অমূল্য মণি দুটি নেই।

হাসিল কুক্কুটশুনি;- তণ্ডুলের কণা / বহুমূল্যতর ভাবি;- কি আছে / তুলনা?”
মোরগটা একথা শুনে হেসে বলে- চাউলের টুকরো কার সাথে কিসের তুলনা।

“নহে দোষ তোর, মূঢ়, দৈব এ ছলনা, / জ্ঞান-শূন্য করিল গোসাঁই?” / এই কয়ে বণিক ফিরিল।

বণিক যাওয়ার আগে তাকে বলে গ্যালো- “এ দোষ তোর নয়রে বোকা, এটা দৈবের ছলনা। জ্ঞানহীন তুই। বিদ্যা বা জ্ঞানের মূল্য তুই কি বুঝবিরে মূর্খ।”

অবশেষে কবি বললেন- 

মূর্খ যে, বিদ্যার মূল্য কভু কি সে / জানে? / নরকূলে পশু বলি লোকে তারে / মানে;-/ এই উপদেশ কবি দিলা এই ভানে।

যে মূর্খ, সে বিদ্যার মূল্য কখনো বুঝতে পারে না। মনুষ্য সমাজে তারে পশু বলে সবাই মানে। আসলে- মানব দরদী। সমাজ সচেতন কবি- তার বাসনা ছিল- নতুন নিরক্ষর মুক্ত সমাজের, তাই তিনি এইভাবে উপদেশ মূলক কাব্য রচনা করে গ্যাছেন।

সিংহ ও মশক

বনের সিংহ। সে পশুরাজ। কাজ তার বেসামাল। বয়সের ভারে স্থবির। পালাক্রমে বনের পশুদের তার আহার হিসাবে আসতে হয়। কেউ সাহস করে প্রতিবাদ করতে পারে না। দিন দিন ভীষণ করুণ দশা হতে থাকে বনের পশুদের। ক্ষুদ্র মশা- সে একদিন সিংহকে আক্রমণ করে।

চিৎকারে বনের পশুরা লড়াই দেখতে ছুটে আসে। পশুরাজ মশাকে সম্মুখ যুদ্ধে আহ্বান করে। মশা বলে- তুই তো ভীরু মহাপাপি, ন্যায়-অন্যায়ভাবে বনের নিরীহ পশুদের ধরে খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করিস নির্লজ্জ কোথাকার।

মশার হুল দংশনে পশুরাজ ধরাশায়ী হলো। অবশেষে কবি বল্লেন- শত্রু, সে যত ছোট হোক, কিংবা দুর্বল- তবু তাকে অবহেলা করলে- চরম বিপদের সম্মুখীন হতে হয়।

সিংহ ও মশক

শঙ্খনাদ করি মশা সিংহে আক্রমিল, / ভব-তলে যতনর, / ত্রিদিবে যত অমর, / আর যত চরাচর, / হেরিতে অদ্ভুত যুদ্ধ দৌড়িয়া আইল / কুল-রূপ শূলে বীর, সিংহেরে বিঁধিল! / অধীর ব্যথায় হরি, / উচ্চ-পুচ্ছে ক্রোধ করি, / কহিলা; “কে তুই, কেন / বৈরিভাব তোর হেন? / গুপ্তভাবে কি জন্য লড়াই? / সম্মুখ-সমর কর, তাই আমি চাই। / ............................... / ............................... / ............................... / কহে মশা;- ভীরু মহাপাপি / অন্যায়-ন্যায়ভাবে, / ক্ষুধায় যা পায়, খাবে; / ধিক, দুষ্ট মতি! / মারি তোরে বন-জীবে দিব রে- / ............................... মুকতি।”............................... / ক্ষুদ্র শত্রু ভাবি লোক অবহেলে যারে, / বহুবিধ সংকটে সে ফেলাইতে পারে,- / এই উপদেশ কবি দিলা অলংকারে।

অবশেষে বলতে হয়; পৌরাণিক নরনারীদের ঘরের মানুষ, বাঙালী হিসাবে রূপায়ণ করে, ঊনবিংশ শতকের সেইসব বাঙালী-যারা ইংরেজী ভাষায় শিক্ষিত হয়ে, স্বাদেশীকতা বোধ থেকে বিচ্ছিন্নতার পথে পা রেখেছিল? তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার মানসে, কবি নব্যবঙ্গের মহাকাব্য রচনা করেছিলেন। তিনি যেন আজও এক দূরবিস্মৃত অতীতের অজানা কাহিনী। তা কেন হবে?

যদি বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল সার্থক দুখানা আখ্যায়িকা মূলক দীর্ঘকাব্যের পাশে- বঙ্গীয় কাব্য ভান্ডারে মেঘনাদবধ কাব্যখানি স্থান পেয়ে থাকে, তাহলে মধুসূদন, কেন হিমাগারে প্রক্রিয়াজাত হয়ে পড়ে থাকবে, সে ক্ষেত্রে তাঁর বিবিধ কবিতা-ই বা অচর্চিত থাকবে কেনো???

পদ্মনাভ অধিকারী : কবি ও প্রাবন্ধিক
কারুকাজ, কেশবলাল রোড, যশোর, [email protected]  

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer