Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

বাস্তবসম্মত মজুরি ও বোনাসের প্রত্যাশা চা শ্রমিকদের

নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১১:৫৩, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬

আপডেট: ১৪:১৭, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রিন্ট:

বাস্তবসম্মত মজুরি ও বোনাসের প্রত্যাশা চা শ্রমিকদের

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

মৌলভীবাজার : শ্রম আইনে উৎসাহ বোনাস, উৎসব বোনাস, নীট মুনাফার পাঁচ শতাংশ অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিলে প্রদান করার কথা থাকলেও যথারীতি চা শ্রমিকরা এসব সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত।

শ্রম আইনের সকল সুবিধা প্রাপ্ত না হওয়ায় চা শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ রয়েছে। তবে শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে মালিক পক্ষের চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিকরা যে সুবিধা ভোগ করছেন সেখানেও শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে বলে শ্রমিকরা অভিযোগ তোলেছেন।

ডানকান ব্রাদার্স শমশেরনগর চা বাগানের দেওছড়া ডিবিশনের শ্রমিক দেওরাজ রবিদাস ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দিনভর চা শ্রমিকদের হাড়ভাঙা খাটুনির পর দৈনিক সর্বোচ্চ মজুরি ৮৫ টাকা। এই টাকা দিয়ে সংসার চালানো যায় না। অথচ চায়ের উৎপাদন আর দাম বাড়লেও বাড়েনি মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা। চা শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে এ বছর চায়ের উৎপাদনে ইতিহাস সৃষ্টি হলেও আমরা চা বাগানের শ্রমিকরা প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি না।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি মৌসুমে চায়ের উৎপাদনে অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। চা শিল্পের ১৬২ বছরের ইতিহাসে এযাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ চা উৎপাদন হয়েছে। দেশীয় বাজারে পিছিয়ে পড়লেও চা শিল্প এখন ঘুরে দাঁড়াতে বসেছে।

উৎপাদন বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আগের মতোই চা রপ্তানি সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। ‘চা বাগান ব্যবস্থাপনা কোষ’ এর জি.এম. মো. শাহজাহান আখন্দ জানিয়েছেন, চলতি মৌসুমে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ১২ মিলিয়ন কেজি বেশি উৎপাদন হয়েছে।

তিনি জানান, গত বছরের তুলনায় ১ কোটি ২০ লাখ কেজি বেশি চা উৎপাদন হয়েছে। চায়ের বাজার দরও গত বছরের তুলনায় ভালো। আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশের কারনে চায়ের উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্যে এ বছর চা শিল্পে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেও শিল্পের শ্রমিকরা আইনে প্রাপ্ত বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত রয়েছেন বলে অভিযোগ তোলেছেন। আগামী ৩১ শে ডিসেম্বর মজুরি বৃদ্ধির চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। নতুন চুক্তিতে বাস্তবসম্মত মজুরিসহ শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধার পথ প্রশস্ত হবে বলে শ্রমিকদের দাবি।

মৌলভীবাজার চা-শ্রমিক সংঘের আহবায়ক রাজদেও কৈরী বলেন, শ্রমিকদের শ্রম-ঘামে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উৎসাহ ভাতা প্রদান শিল্পের একটি স্বীকৃত বিষয়। আমাদেরকে কোম্পানী সবসময় এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে আসছে। এমনকি এবছর যখন শ্রমিকরা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে চা উৎপাদনে নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে, তখনও কোম্পানী চা-শ্রমিকদের একটি টাকাও উৎসাহ বোনাস দিচ্ছেন না। বর্তমান বাজারে একজন শ্রমিককে দৈনিক সর্বোচ্চ মাত্র ৮৫ টাকা মজুরি প্রদান করা হয়।

তিনি আরও বলেন, দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার কথা বলা হয়। কিন্তু শ্রমিকদের অভুক্ত রেখেই দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা কি সম্ভব? আমরা দীর্ঘ দিন যাবত প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে বর্তমান বাজারদরের সাথে সংগতি রেখে চা-শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক ৪০০ টাকা নির্ধারণের দাবি জানিয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছি না।

চা-শ্রমিকদের বর্তমান মজুরি এ ক্লাস বাগানে দৈনিক ৮৫ টাকা, বি ক্লাস বাগানে দৈনিক ৮৩ টাকা, সি ক্লাস বাগানে দৈনিক ৮২ টাকা। বছরে ৩২ দিনের মজুরির সমপরিমান অর্থ দুর্গা পূজা/ ঈদুল-আযহা এবং লালপূজা(ফাগুয়া)/ঈদুল ফিতরে যথাক্রমে ৬০ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ উৎসব ভাতা হিসেবে প্রদান করা হয়। তবে সেটা সকল শ্রমিক সমান হারে পান না। বাগান কর্তৃপক্ষ উৎসব ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রেও বিগত বছরের কর্মে উপস্থিতির উপর নির্ধারণ করে উৎসব ভাতা প্রদান করে।

যদিও আইনে উৎসব ভাতা প্রদানের সাথে কর্মে উপস্থিতি বা উৎপাদনশীলতার কোন সম্পর্ক নেই। শ্রমিকদের কর্মে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য ইনসেন্টিভ বোনাস বা উৎসাহ ভাতা প্রদান করার কথা। উৎসব ভাতা ও ইনসেন্টিভ বোনাস বা উৎসাহ ভাতা ভিন্ন বিষয়।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (অদ্যাবধি সংশোধিত)-এর ২৩৪(খ) ধারায় “প্রত্যেক বৎসর উহা শেষ হইবার অনূন্য নয় মাসের মধ্যে, উক্ত বৎসরের নীট মুনাফার পাঁচ শতাংশ অংশ গ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিলে ৮০ঃ২০ অনুপাতে প্রদান করিবে।”

এছাড়া ৩০ মার্চ ২০১০ তারিখে ‘টি গার্ডেন’ শিল্প সেক্টরে সরকার ঘোষিত নূন্যতম মজুরির ঘোষিত গেজেটে (এসআরও নং ৮৯-আইন/২০১০) এর ৯ নম্বর শর্তাবলীতে নূন্যতম মজুরি ছাড়াও শ্রমিকদের ইনসেন্টিভ (উৎসাহ) বোনাসসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বা ভাতা প্রদান করার কথা বলা হয়েছে।

চায়ের উৎপাদনে নতুন মাত্রা পাওয়ায় সম্মানজনক মজুরিসহ এসব সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির দাবি করছেন অবহেলিত চা শ্রমিকরা। শেফালী কূর্মি, সবিতা রবিদাস বলেন, আমরা চা শ্রমিকদের নিজস্ব সম্পদ বলতে ছেঁড়া চট, টিনের মগ ও থালা বাটি। বাগানের ভেতর রাস্তার দু’পাশে মাটি দিয়ে তৈরি ও পুরনো পাকা দেয়ালের ছোট ছোট এক একটি ঘরে একসঙ্গে মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী নিয়ে জীবন কাটি। ঝুপড়ি ঘরে রোগবালাই লেগেই থাকে।

চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, উৎপাদন খুবই ভালো হওয়ায় আমাদের প্রত্যাশাও বাড়লো। তবে বাস্তবসম্মত মজুরি, নীট মুনাফার পাঁচ শতাংশ পাওয়ার জন্য নিয়মিতহারে আমরা দাবি জানাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে চায়ের দাম কম অজুহাত দেখানো হয়। কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর উৎপাদন ও দাম দু’টিই ভালো। সেজন্য আমাদের পাওনা পরিশোধের দাবি জানাচ্ছি।

ন্যাশনাল টি কোম্পানী (এনটিসি) এর ডিজিএম মো. শাহজাহান বলেন, চায়ের উৎপাদন ভালো হলেও দাম নিম্নমুখী। তবে উৎসাহ বোনাস স্টাফরা পেয়ে থাকে। আর দু’বছর অন্তর মজুরি বৃদ্ধির চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিকরা তাদের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির সত্যতা নিশ্চিত করে চা বোর্ডের শ্রীমঙ্গলস্থ প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট ইউনিট এর পরিচালক মঈন উদ্দীন বলেন, চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিকরা সুবিধা পাওয়ার কথা।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer