পুরাতন টিনের চালে অসংখ্য ফুটো। বৃষ্টি এলেই ভিজিয়ে দেয় পুরো ঘর। সেই দুর্দশাই দেখাচ্ছিলেন চা শ্রমিক দেওছড়া চা বাগানের বাবুলাল রবিদাস। ছবি: বহুমাত্রিক.কম
মৌলভীবাজার : বয়োবৃদ্ধ চা শ্রমিক ফুলচাঁন রবিদাস। কমলগঞ্জের ডানকান ব্রাদার্সের দেওছড়া চা বাগানে কাজ করেন তিনি। অনেক দশক পার করেছেন এই চা বাগানে। তার সামনে অনেক-কেই নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে দেখেছেন তিনি। চা বাগানের ‘বড় বাবুদের’ তোষামোদ করে পাকা বাড়ি করে ফেলেছেন। কিন্তু ফুলচাঁনদের ভাগ্য বদলায়নি এতোখানিও।
সেই ব্রিটিশ শাসনামলে চা শ্রমিকদের জন্য তৈরি ডেরাগুলোর ছাউনী দেয়া টিনগুলো ক্রমই বিবর্ণ হচ্ছে। অধিকাংশ চালই ফুটো। বৃষ্টি নামলেই ভিজে একাকার গোটা ঘর। দেয়ালেও অসংখ্য ফাটল। প্রায়শই খসে পড়ছে পলেস্তেরা, ইট-সুরকি। দেয়াল ধ্বসে মৃত্যুবরণও করেছেন অনেক চা শ্রমিক। এই ‘অনেকের’ সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে অজিত নায়েকের নাম।
গত ক’দিনের টানা বর্ষণে চা শ্রমিকদের এই দুর্দশা আরও প্রবল হয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দুর্দশাগ্রস্ত এসব শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাদের মানবেতর জীবনের মর্মস্পর্শী সব গল্প।
চা বাগানে গাঁ ঘেষাঘেষি করা কলোনীগুলোর সবক’টি ঘরেই টিন থাকলেও সেগুলো মরিচা ধরে জীর্নশীর্ণ। প্রবীণ শ্রমিকদের ভাষ্যমতে ১৯৬০-৬৫ সালে নির্মিত হয় পাকা ও আধা পাকা এসব শ্রমিক কলোনী। বর্তমানে এগুলোর দরজা-জানালা ভাঙ্গা-ফাটা, সিটকারী নেই, দেয়ালও ফাটা। চালের ওপরের কাঠ নষ্ট হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে অনেক আগেই। টিনের ছিদ্র দিয়ে অব্যাহতভাবে বৃষ্টির পানি পড়ে ভিজে যায় শ্রমিকদের কাপড়-চোপড়সহ সব কিছুই। মৌলভীবাজার জেলার ৯২টি চা বাগানের শ্রমিকদের অধিকাংশ কলোনীতে এরকম ভগ্নপ্রায়।
চা শ্রমিকদের অভিযোগ, বাগানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বার বার বললেও ভগ্নপ্রায় এসব আবাস সংস্কারে শুভদৃষ্টি পড়েনি তাদের।
জেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী সুনারায়নছড়া চা বাগানে পুরনো ঘরের মাটির দেয়াল ধ্বসে গত ৫ এপ্রিল অজিত নায়েক (৪৫) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। দেয়াল চাপায় গুরুতর আহত হন তাঁর স্ত্রী অঞ্জু নায়েক (৩২)। ওইদিনের প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে একই সময়ে জেলার ফুলবাড়ি, শমশেরনগরসহ বিভিন্ন চা বাগানে ৩০টি ঘর বিধ্বস্থ ও অর্ধশতাধিক ঘর আংশিক বিধ্বস্থ হয়।
কমলগঞ্জ উপজেলার ডানকান ব্রাদার্স শমশেরনগরের ফাঁড়ি দেওছড়া চা বাগানের বয়োবৃদ্ধ মহিলা শ্রমিক সিতরলিয়া রবিদাস। প্রতি চাহনিতেই যেন কষ্টের ছাপ। আর্দ্রকণ্ঠে তিনি বলেন, “বাবা বিরটিশ দেখলাম। পাকিস্তান দেখলাম। এ্যাহন বাংলাদেশ দেকতাছি। হেই বিরটিশ আমলে শরমিকদের যে ঘর দিছিল, হেই ঘরেই হামরা আছি। এই ঘর আর মেরামত হয় নাই। কহন ভাইঙ্গা পড়ব জানি না।’
ওই বাগানের আরেক শ্রমিক ফুলচাঁন রবিদাস বলেন, “হামরা বর্ষার সময়ে খুব কষ্টে আছি। ঘরে বৃষ্টির পানি পড়ে সব ভিজে। গরু-ছাগলও এরকম থাকে না। বাবু সাহেবদের পকেটে যারা হামাইছে তারা ঘর ঠিক কইরা নেয়। আমাদের ঘর মেরামত হয় না।”
গত কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণে ডানকান ব্রাদার্স ও এনটিসি চা বাগানে সাধারণ চা শ্রমিকদের জীর্ণ ঘরগুলো যেন এক একটি মৃত্যু ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেওছড়া চা বাগানের উত্তর লাইনের শ্রমিক অনুরোধ রবিদাসের ঘরের টিনের চালা ছিদ্র। ভেঙ্গে পড়ছে চালার কাঠ। বৃষ্টির পানি পড়ে একাকার হয়ে গেছে ঘরের মেঝে।
একইভাবে বৃষ্টিতে ভিজে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন ওই বাগানের দুসরা দুলাল রবিদাস, দ্বীপা রবিদাস, বৃন্দাচন রবিদাস, চৌতা সুদর্শন, স্বরসতি পঞ্চম, শ্যামলাল রবিদাস, রীতা রবিদাস, বাবুলাল, মতিলাল, মইনি, সুখদেব, গনেষিয়া রবিদাস, গোলাপ গোয়াল ও ছবি লাল ভরসহ অসংখ্য চা শ্রমিক।
বৃষ্টিতে ভিজে দেয়াল ধ্বসে কখন চাপ পড়বেন-সেই আশঙ্কায় এই চা শ্রমিক
চাতলাপুর চা বাগানের চুয়াল্লিশ পাট্টা এলাকার শ্রমিক বিলু বাউরী বলেন, আমার ঘরের কী শোচনীয় অবস্থা না দেখলে কেউ বুঝবে না। অসংখ্য শ্রমিকের মধ্যে নিজের সংকটকে বেশ প্রবলভাবেই তুলে ধরলেন তিনি। অনুরোধ করেই নিয়ে গেলেন তার দুর্দশা দেখাতে।
চাতলাপুর চা বাগানের শ্যামল, শমশেরনগর চা বাগানের লছমি ও এনটিসির কুরমা চা বাগানের নারী কর্মী গীতারানী অভিযোগ করে বলেন, বৃষ্টির সময় আসলে দেখা যায় চা বাগানে শ্রমিকরা যে কতো কষ্টে দিনযাপন করছে। শ্রমিক কলোনীর ৭৫ ভাগ চা শ্রমিকদের জীর্নশীর্ন ঘরে বাস করছেন। এই সময়ের বৈরী আবহাওয়ায় যেকোনো সময় ঘরবাড়ি ধ্বসে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তাদের।
তবে চা শ্রমিকদের দুর্দশা যখন এতোটা প্রবল তখন চা বাগানগুলোর কর্তাব্যক্তি ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। বেশ কয়েকজন বাগান ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তা কেউই কথা বলছেন রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সহকারী ব্যবস্থাপক বলেন, শ্রমিকদের চাহিদার ভিত্তিতে যাচাই বাছাই করে প্রতি বছর ঘর মেরামত করে দেওয়া হচ্ছে।
এরপরও চা শ্রমিকদের ঘরবাড়ির এ অবস্থা কেন-জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
বহুমাত্রিক.কম