Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

বর্ষা বন্দনায় পদ্মনাভ অধিকারী

মুস্তাক মুহাম্মদ

প্রকাশিত: ১৩:০৬, ২ আগস্ট ২০১৬

আপডেট: ০৪:২৪, ৩ আগস্ট ২০১৬

প্রিন্ট:

বর্ষা বন্দনায় পদ্মনাভ অধিকারী

ছয় ঋতু বৈচিত্রের দেশ বাংলাদেশ। বৈশাখÑজ্যৈষ্ঠের তাপদাহে যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত, প্রকৃতিতে যেনো রসের অভাব তারপরের দুমাস আষাঢ়-শ্রাবণ জুড়ে বর্ষাকাল। বর্ষার আগমনে রুক্ষ প্রকৃতি রসে সজীব হয়ে উঠে। জীবনে দোলা লাগে। শাখে শাখে প্রাণের সঞ্চয় হয়। নব হিল্লোনে জেগে উঠে চারপাশ। আকাশ হঠাৎ মেঘে ঢেকে যায়। ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামে। কর্মব্যস্ত মানুষ কিছু সময় থমকে যায়। তবু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে নববর্ষার আবির্ভাবে। তবে কিছুদিন পরেই শুরু হয় মুষলধারা তখন বিরক্তির অন্ত থাকে না।

সারাদিন পানি ঝরতেই থাকে । আদুরে কাঁদুনে মেয়ের মত। মনে হয় বাবার উপরে অভিমান করে কাঁদতেই থাকে। আর বৃষ্টি মেয়ের অভিমানটা একটু বেশি-সাত/আট দিন এমন কি তার বেশি সময় ধরে অভিমানে কাঁদতেই থাকে। তার অভিমান থামতেই চাই না।

অপরিকল্পিত শহরের রাস্তায় পানি জমে। চিপা আবর্জনা পূর্ণ ড্রেনগুলো ঠিক মত পানি নিষ্কশন করতে পারে না। জমা পানি মাড়িয়ে , গায়ে রেইনকোর্ট চাপিয়ে দুর্ভোগে আধা ভেজা অবস্থায় ছোটে কর্মমুখি মানুষ। গ্রামে বর্ষা আসে ভিন্ন রূপে। কত রূপ বর্ষার তা গ্রামে না থাকলে অনুমান করা যাবে না। বর্ষা নিয়ে আসে মাঠে-ঘাটে খেটে খাওয়া মানুষের বিশ্রামের আরামপাটি। একটু অবসর সময়। তেমন কাজকর্ম নেই। ঘরে বসে থাকা। সারাদিন পানি ঝরতে থাকে। অলস সময়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নানা স্বপ্নে ভেসে যায় মানুষ।

বধূরা খিচুড়ি রান্না করে স্বামীকে ডাকে। অবসর সময়ে ইনডোর গেম লুডু খেলে কাটিয়ে দেয়। কেউ খালে ঘোলা পানিতে খেপলা ফেলে মাছ ধরে। সরপুটি নতুন পানি পেয়ে লাল পশ্চাশদেশ নাড়তে নাড়তে খেলে বেড়ায়। কারোর ছনেÑগোলপাতায় ছাওয়া ঘরে পানি পড়ে। থালা বাসন পেতে পানি ধরা হয়। তবু বর্ষা স্বস্তি দেয়। কদম শাখে হলুদের উপরে সাদা মিশে কদমফুল শোভা বিলায়। টাপুর টুপুর শব্দ যেনো খুকুর পায়ের নুপুরের মত বাজে। মন হারিয়ে যায় অজানায়। স্মৃতিরা জেগে উঠে। বুকের গহীনে কি যেনো বাজতে থাকে। রিনঝিনে বৃষ্টি আনমনা করে দেয়। কোথায় যেনো হারিয়ে যায় মন। একি মাদকতা বৃষ্টি! পথ হারায়ে কোথায় নিয়ে চলে ! কোন দূও দেশে! শীত শীত লাগে।
স্মৃতি ভাসতে ভাসতে শৈশব থেকে জীবনের যত চাওয়া পাওয়া-না পাওয়ারা ভিড় করে চোখের সামনে। মুহূর্তে মানুষ অতীত মুখো হয়ে যায়। বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যায়। মনকে নিয়ে যায় আজানায়।

অজানা স্রোত ভাসতে ভাসতে স্বপ্নদেশে চলে যায় মানুষ। বৃষ্টির এই মাদকতা শক্তি অন্য কোনো ঋতুর নেই। এই ভাবালুতা সৃষ্টি করা বৃষ্টিকাল তথা বর্ষাকাল একান্ত সুখে বা বিরহের সুর হয়ে বাজে বিদেশী স্বামীর জন্য বধুর। কিন্তু স্বপ্ন থেমে যায় না। স্বপ্ন বাড়তে থাকে। মনে মনে হাজারো স্বপ্ন- স্মৃতি -কল্পনায় ডুবে যায় মন। এক্ষেত্রে রবি ঠাকুরের ‘নববর্ষা ’প্রবন্ধটির কয়েকটি ছত্র প্রণিধান যোগ্য।

তিনি লিখেছেন- “মেঘ দেখিলে ,সুখিনোহপন্যথাবৃত্তিচেতঃ, সুখী লোকেরাও আনমনা ভাব হয়, এইজন্যই। মেঘ মনুষ্যলোকের কোনো ধার ধারে না বলিয়া মানুষকে অভ্যস্ত গ-ীর বাহিওে লইয়া যায়। মেঘের সঙ্গে আমাদেও প্রতিদিনের চিন্তা চেষ্টা কাজ কর্মেও কোনো সম্বন্ধ নাই বলিয়া সে আমাদেও মনকে ছুটি দেয়। মন তখন বাঁধন মানিতে চাহে না,প্রভুশাপেÑ নির্বাসিত যক্ষের বিরহ তখন উদ্দাম হইয়া উঠে। প্রভুভৃত্যেও সম্বন্ধ সংসারের সম্বন্ধ। মেঘ সংসারের এই সকল প্রয়োজনীয় সম্বন্ধগুলোকে ভুলাইয়া দেয়, তখনই হৃদয় বাঁধ ভাঙিয়া আপনার পথ বাহির করিতে চেষ্টা করে।”

কালিদাসের ‘মেঘদূত; এ বর্ষার অন্তবেদনা সব মানুষের ভাষ্য হয়ে উঠেছে। বাঙারি কবিরা বর্ষা নিয়ে কবিতা লিখেছেন, আরো লিখবেন। আমরা আজকে পদ্মনাভ অধিকারীর কবিতায় বর্ষার রূপ-সুষমা খুঁজব। তিনি যেভাবে দেখেছেন বর্ষা আমরা তা উপলব্ধি করব।

সুপ্রভাত সিডনি’তে ধারাবাহিকভাবে কবি পদ্মনাভ অধিকারীর কবিতা নিয়ে রচিত প্রবন্ধ আলোচনা করছি। সে কারণে সুপ্রভাত সিডনি’র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। অনেকে প্রকাশিত লেখা নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন। তাদেরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি।

আগামীতে তাঁর উপরে আরও কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। আজকে বাংলাদেশের ষড়ঋতুর আদুরে ঋতু বর্ষা নিয়ে আলোচনা করব। যে পান থেকে চুন খসলেই কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। সে কাঁন্না আর থামায় কে! টাপুর টুপুর, রিন ঝিন ঝরতেই থাকে। গ্রীষ্মে প্রকৃতি যখন গরমে বিরূপ রূপ ধারণ করে। চারদিক পানি শূন্য। মাটি শুকিয়ে যায়। উদ্ভিদ শ্রেণী তাতে প্রায় শুকিয়ে যায়। তারপরে আসে বর্ষাকাল। ঠিক গ্রীস্মের বিপরিত রূপ। শুষ্ক প্রকৃতি রসে ভরে উঠে। নববর্ষাকে ডেকে আনে পূর্বমেঘ আর উত্তরমেঘ। দুই মেঘের আনাগোনায় বৃষ্টি নামে। প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পায়। নির্জীব পৃথিবী সজীব হয়ে উঠে। সবুজের সমারহ চোখে পড়ে। খাল-বিল ভরে উঠে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে আসে পৃথিবীতে। অনূঢ়ার পায়ের মলের মত রিন ঝিনিয়ে বৃষ্টি নামে। নতুন পানি পেয়ে মাঠে মাঠে ঘ্যাঙর ঘ্যা করে ডেকে ওঠে কুলাব্যাঙ। সে সুরও মাদকতা সৃষ্টি করে।

পদ্মনাভ অধিকারীর “নামলো ধারা” কবিতায় নতুন মেঘ আর নতুন পানি পেয়ে জীব জগতে যে প্রাণের সঞ্চয় হয় তা ফুটে উঠেছে। কয়েকটি ছত্রের উল্লেখ করা বাঞ্চনীয় মনে করছি। তিনি লিখেছেন-“আকাশে আকাশে সঘন মেঘের তাড়া/ নির্জীব ভুবনে তার পড়েছে সাড়া-/ মেঘে বাজায়ে ডম্বরু/ নামলো ধারা/ তৃপ্ত হলো মন মরু,/ ছুটে চলেছে সেই মেঘের নতুন জল/ বাজছে যেন অনূঢ়ার পায়ের মল!/ যে জলেতেই ভরলো খেত-জলাধার/ ভেঙে বাঁধ সব বাধার।”
বর্ষার বিশেষ ফুল কদম। কদমের শোভা আমাদের মন মাতিয়ে দেয়। রসালো মাটিতে নানা রকমের উদ্ভিদ জন্মে।প্রকৃতি নানা ছন্দে মোহিত করে আমাদের। নববর্ষায় আমরা নতুন করে জাগি। প্রকৃতি যেনো উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বর্ষা আগমন মানে উৎসবের আয়োজন। প্রকৃতিতে মাতামাতি শুরু হয়। সজীব হয়ে উঠে চারদিক। কানায় কানায় পূর্ণ হয় জলাশয়। এই সব কিসের আয়োজন ? নিশ্চয় বর্ষার ।

স্বস্তিতে আনন্দের কানাকানি। উৎসবের আয়োজন। “নামলো ধারা ” কবিতার ছন্দে সে কথা কবি যে ভাবে ফুটিয়েছে তা দেখব-“কদমে বর্ষায় যেন ছন্দের উৎসব / সরস মাটিতে অবুঝ সবুজের সুর/ উৎসবের দিন কতোদূর আর কতোদূর-”

জ্যৈষ্ঠ গেলেও তার রেশ তখনও থেকে যায়। পরিবেশে কেমন যেনো একটা গুমোট ভাব। অস্বস্তি লাগে। মানুষ বর্ষার জন্য অপেক্ষা করে । কখন একটু বৃষ্টি হবে। যার জল একটু স্বস্তি দেবে। প্রকৃতিকে একটু স্বস্তিদায়ক করে তুলবে। আষাঢ়ের শুরুতে বৃষ্টি হয় না। হলেও তাতে তাতী পরিবেশ স্বস্তিদায়ক হয় না। মধ্য আষাঢ়ে বৃষ্টি হয়। মেঘ কালো হয়ে আকাশে আনাগোনা করে।

বিরাট আওয়াজে বৃষ্টির পানিকে আহ্বান করে। অন্ধকার হয়ে আসে। হঠাৎ ঝরঝর করে আকাঙ্খিত বৃষ্টি আসে। গুমোট আবহাওয়া কিছুটা সহনীয় হয়। তবে এই বৃষ্টির আগমন ঘোষনা কের আর বাকি নেই কয়েকদিনের মধ্যেই মাটি রসালো হবে। প্রকৃতি ধুয়ে নব যৌবনে ফিরে যাবে। রসে টইটুম্বর করবে। আকাঙ্খিত বৃষ্টির পানিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেবে। এমন কথার মালা শব্দে শব্দে বুনে বর্ষাকে স্বাগতম জানিয়েছেন কবি পদ্মনাভ অধিকারী। এ প্রসঙ্গে তার “ সে আসে ঐ আসে” কবিতাটি উল্লেখ করা যায়। তিনি যখন লেখেন-

“আষাঢ়ে গুমোট আবহায়ে বাতাসে/ধূসর সঘন মেঘ আসে,/সে আসে-ঐ আসে ঝরঝরিয়ে-/সাজ সাজ রবে কি যে সাজে/প্রকৃতি মাতে দারুণ মহোৎসবে,/চমকিয়ে বিদ্যুৎ খেলিয়ে রুদ্ধশ্বাসে/সে আসে ঐ আসে ঝরঝরিয়ে-/আজ মাতালো কে মাতিয়ে দিলো/মেঘেরা গুরুগুরু ডম্বরু বাজিয়ে,/প্রাণে আমার শ্বাসের তার বাঁধিয়ে/তাতেই জীবনের সুর সাধিয়ে!/ঝরে ঝরে পড়ে সে ঝরে পড়ে/নিভৃত অন্তরে আমার/ভালোবাসার বিশ্বাসে,/সে আসে ঐ আসে ঝরঝরিয়ে-”

নববর্ষার স্বস্তি আনন্দ সবুজে কদমের বাহারি রূপ তথা বর্ষার প্রকৃত রূপ-সুষমা তুলে ধরতে কবি পদ্মনাভ অধিকালীর তুলনা নেই। চমৎকার সব উপমা অলংকারে বর্ষা মেয়েকে সাজিয়ে বরণ করে লালিত পালিত করেছেন তিনি।
তাঁর বর্ষার কবিতা পড়তে পড়তে কখন যে মন বৃষ্টির পানিতে ভিজে যায় তা আমরা বলতে পারি না। অপূর্ব সব শব্দের বন্ধনে তার বর্ষা বন্দনা। যা আমাদের বর্ষার প্রকৃত রুপ-সৌন্দর্য় উপলব্ধি করতে সহায়ক। তার বর্ষার কবিতা পড়তে পড়তে আমরা অতীতে চলে যায়। যা আমাদের আনন্দ দেয়। অতীতকে কাছে পেয়ে আমরা কেমন জানি আনমনা হয়ে যায়। বর্ষার রূপ অঙ্কনে-বর্ষা বন্দনায় এখানেই সার্থক বর্ষাপ্রিয় কবি পদ্মনাভ অধিকারী।

 লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer