লালন ফকির ও পানির বিষয়ে একটা লেখার ইচ্ছে ছিলো দীর্ঘদিনের। আমি গভীরভাবে খেয়াল করেছি লালন তার গানে কোন তত্ত্বকে সহজে খোলাশা করতে গিয়ে পানির উদহারণটাই টেনেছেন বারংবার। এতে করে কঠিন বিষয়টাও হয়ে উঠেছে পানির মত সহজবোধ্য।
পানির উপর কাজ করতে গিয়ে এই ইচ্ছে লেখার ইচ্ছেটা আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে। কিন্তু লেখাটার শিরোনাম লিখতে গিয়ে পড়েছি মহামুছিবতে। প্রথমই যেখানটাই খটরমটর লাগে তাহলো মহান সাধক লালন ফকির লালন শাহ না হয় লিখলাম, এর পাশে পানি লিখবো নাকি জল? এর মিমাংশা পরে করবো। ধান ভানতে শীবের গীত হলেও এর আগে আমাদের গ্রামের বাড়ির কথাই বলি।
আমরা আর আমাদের প্রতিবেশি নট্র ও সরকার বাড়ির লোকেরা একই নলকূপের পানীয় জল গ্রহণ করতাম। কিন্তু আমরা পান করতাম পানি, ওরা খেত জল। আমাদের চিন্তাধারা হচ্ছে, মুসলমান ‘জল’ খায় না, হিন্দু ‘পানি’ পান করে না। কথিত আছে, আগেরদিনে মুসলমানের ছোঁয়া লাগলে হিন্দুর পানি নাকি বিশুদ্ধ থেকে অপেয় হয়ে যেত। জল আনতে গিয়ে মুসলমানের মুখ দেখলে নাকি সেই কলসের জল ফেলে দিত সনাতন ধর্মাবলম্বী বধূরা। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পেও এই পানীয় জলের বিভেদ-বৈষম্য অনেকটাই প্রতীয়মান। কিন্তু লালন ফকির এমন এক সাধক পুরুষ যিনি তাঁর গানে সমার্থক এই দুটি শব্দই সাদরে সমান মর্যাদায় গ্রহণ করে বিভেদপন্থী অনিচ্ছুক হিন্দু-মুসলমানকে এক ঘাটের ‘পানি’ ও ‘জল’ খাইয়ে ছেড়েছেন।
তিনি গেয়েছেন, ‘জলের উপর পানি না পানির উপর জল/ আলীর উপর কালী, না কালীর উপর আলী / বল খোদা বল, বল খোদা বল?’ আগায় পানি না ঢেলে জাতধর্মের প্রশ্রয়ে লালিত ভাষা-সাম্প্রদায়িকতার গোড়াও এভাবেই কেটে দিয়েছেন তিনি। পানি হচ্ছে লালনের গানের একটি অন্যতম প্রধান উপজীব্য। বিভিন্ন গানের মাধ্যমে লালন পানি ও সামাজিক ন্যাযাতার কথা বলেছেন। লালনের পানি ভাবনা নিয়ে রয়েছে নানা জনের নানা মত থাকলেও আমাদের আজকের সমাজেও লালনের গানের প্রাসঙ্গিকতা এতটুকু কমেনি। যদি লালনের এই গানটার কথাই থরি: ‘জানো না মন খালে বিলে / থাকে না মীন জল শুকালে। কি হবে আর বাঁধাল দিলে, মোহনা শুকনা। অসময়ে কৃষি করে মিছামিছি খেটে মরে। গাছ যদিও হয় বীজের জোরে, ফল ধরে না। সময় গেলে সাধন হবে না। দিন থাকিতে তিনের সাধন কেন করলে না’। সময়ের কাজ সময়ে না করলে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়।
খালে বিলে যদি পানি না থাকে তাহলে মাছ বাঁচতে পারেনা। কেউ যদি মোহনা শুকনা করে রাখে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে, তাহলে তিস্তা ব্যারেজ দিয়ে কোন লাভ হবেনা। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে কৃষিকাজেও বৈচিত্র্য আনতে হবে। নইলে কৃষক যতই খাটাখাটুনি করুক না কেন ভালো ফসল পাওয়া যাবেনা। পরিবেশ সংরক্ষণের এখনই সময়। জলাধারগুলো দখল এবং ভরাটের হাত থেকে না বাঁচাতে পারলে পরে যতই উচ্চবাচ্চ্য করা হোকনা কোন কাজে আসবেনা।
বাংলাদেশের মানুষের কথা যদি বলতে চাই তাহলে বলতে হয় ‘সমুদ্রের কিনারে থেকে জল বিনে চাতকী মলো’ গানটির কথা। অতৃপ্ত লালন যেমন মেঘনা নদীর কাছে থেকেও পিপাসায় হাকাকার করেন : ‘সমুদ্রের কিনারে থেকে জল বিনে চাতকী মলো/ ওরে বিধি হারে বিধি/ তোর মনে কি ইহাই ছিল /..ফকির লালন মরল জল পিপাসায়/ কাছে থাকতে নদী মেঘনা।’ আমাদেরও ঠিক হয়েছে একই দশা। তিস্তায় ঘটি ডোবেনা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মনে কি ইহাই ছিলো? ফারাক্কা বাঁধের কারনে পদ্মায় বালুচর। বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষ আজ লালনের মত জল পিপাসায় কাতর। লালনের পিপসা হয়ত অন্যকোন দিকে ছিলো । কিন্তু নদীমাতৃক বাংলাদেশের পাথরঘাটা, কলাপাড়া, শরণখোলার মত অনেগুলো এলাকার মানুষ সত্যি সত্যিই তৃষ্ণার্ত। তাদের ভরসা পুকুর কিংবা চাতকের মত বৃষ্টির জল।
জানি, অনেকেই আমার এ ব্যাখার সাথে অনেকেই একমত হবেন না। দেহতত্বের কথা বলতে চাইবেন। ইউটিউবে এক মাওলানা সাহেবকে এই গানটির দেহতত্ত্বের দিকটায় আলোকপাত করে লালনকে লম্পট বলে আখ্যায়িত করেন। জীবন কিংবা দেহতত্ত্ব কোন কিছুই পানি ছাড়া অকল্পনীয়। এমনকি মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহতা’লা বলেছেন, ( أَلَمْ نَخْلُقْكُمْ مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ ) “আমি কি তোমাদেরকে তুচ্ছ পানি থেকে সৃষ্টি করি নি? (মুরসালাতঃ ২০)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ ( فَلْيَنْظُرِ الْإِنْسَانُ مِمَّ خُلِقَ خُلِقَ مِنْ مَاءٍ دَافِق) “অতএব, মানুষের দেখা উচিত কি বস্তু থেকে সে সৃজিত হয়েছে। সে সৃজিত হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে”(সূরা তারিকঃ ৫-৬)।
‘এই পানি দ্বারাই তোমাদের সৃষ্টি করেছি’- বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মনোগ্রামের উপর দিকটাই আরবীতে এরকমেরই একখানা আয়াতখানা সুন্দর করে লেখা আছে। আদমসন্তানের জন্ম হয় তাঁর পিতার একফোঁটা পানির (বীর্য) মাধ্যমে। আর যদি লালন পানির মাধ্যমে দেহতত্ত্বের কথা বলেন তাহলে যত্তসব বিপত্তি। অনেকেই লালনের পানির রূপক ব্যবহার সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য করেছেন। যারা অযথাই বির্তক বাঁধাতে চান তাদের জন্য লালন গেয়েছেন এই গান: ‘ইল্লতে স্বভাব হলে পানিতে কি যায়রে ধুলে, খাজলতি কিসে ধুবা? লালন বলে হিসাব কালে সকল ফিকির হারাবা /মন সহজে কি সই হবা?’ ।
লালনের জীবন জিজ্ঞাসা- মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বুঝাতে গিয়ে লালন সমগ্র মানুষকে অখন্ড জ্ঞান করেছেন। জাত পাতের তোয়াক্কাহীন লালনের কাছে সব মানুষই সমান। জন্মের কারণে কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান সকলই একই স্রষ্টার মানুষজীব। লালন-গীতিকায় জাত গেল জাত গেল বলে গানটিতে লালন গেয়েছেন, ‘ব্রাহ্মণ-চন্ডাল চামার-মুচি/একই জলে সব হয় শুচি/ দেখে শুনে হয় না রুচি/ যমে তো কাউকে ছাড়বে না’ । নদীর জলের যেমন কোন আলাদা জাত নেই। ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি সকলেই তো এক জলেতেই শুচি হয়। জলতো কাউকে ভেদাভেদ করে না। তেমনি জলের প্রাপ্যতার ব্যপারেও সব মানুষের রয়েছে সমান অধিকার। তাঁর গান একটা বার্তাই পৌঁছে দেয়, তিনি হিন্দু বা মুসলমান হওয়ার বদলে প্রাণপণে ‘মানুষ’ হতে চেয়েছেন। যদিও তাঁর কথা শোনা বা তার তাৎপর্য বোঝার জন্য সমাজ-মন প্রস্তুত ছিল না । তাই এই কাল বিরোধী সাধককে কালোত্তীর্ন ভাবনা ভেবে নানারকমের আঘাত সইতে হয়েছে।
মনের মধ্যে কখনো বেদনা, কখনো হতাশা জেগেছে সাইঁজির। তাই হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে গান রচনা করেছেন, ‘এ দেশেতে এই সুখ হলো আবার কোথা যাই না জানি/ পেয়েছি এক ভাঙা নৌকা জনম গেল ছেঁচতে পানি’। কিন্তু লালন সাঁইজীতো পরাভব মানতে পারেন না, হতাশার কাছে আত্মসমর্পণ তো তাঁর ধর্ম হতে পারে না! যাঁর তরঙ্গমুখর নদী হওয়ার বাসনা ছিল দুকূল ভাসানো ¯্রােতস্বিনী হওয়ার কথা ছিল, তিনি কিনা হয়ে রইলেন ‘আন্ধেলা পুকুরে’র বদ্ধ ‘কূপজল’! কিন্তু তিনিতো মানুষকে দিশা দিতে চান। তাই সুসময়ের জন্য আশা জাগিয়ে রাখেন, ‘কবে হবে সজল বরষা, রেখেছি মন সেই ভরসা’। একদিন বর্ষা নামবে, নব-জলধারায় সিক্ত হবে এই পৃথিবীর রুক্ষ মাটি, সবুজে ভরে যাবে ফসলের মাঠ। সত্য হয়ে উঠবে মানবজমিন আবাদের মরমি কৃষক লালনের স্বপ্ন।
লেখক : প্রধান নির্বাহী, বিএমওয়াইপি, প্রধান সমন্বয়কারী-ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিজ
বহুমাত্রিক.কম