Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪

প্লাস্টিকের প্রভাবে বিলীন হোগলা পাতার বুনানো জিনিসপত্র

মো: আমিনুল ইসলাম, ঝালকাঠি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২১:০০, ১৪ আগস্ট ২০১৮

আপডেট: ১২:৪৯, ১৫ আগস্ট ২০১৮

প্রিন্ট:

প্লাস্টিকের প্রভাবে বিলীন হোগলা পাতার বুনানো জিনিসপত্র

ছবি : সংগৃহীত

ঝালকাঠি : ঝালকাঠির বায়তুল মোকাররম চৌমাথা থেকে থানা মোড় পর্যন্ত প্রায় আধা কিলোমিটার জুড়ে এক সময়ে হোগলা বিক্রি হতো। জেলার ৪ উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বুনানো হোগলা নিয়ে এসে এখানকার পাইকারদের কাছে বিক্রি করতো। অন্যদিকে প্রয়োজনের তাগিদে জেলার বিভিন্ন এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী জেলা থেকেও ঝালকাঠির হোগলা পট্টি আসতো হোগলা পাতা কিনতে।

কালের বিবর্তনে প্লাস্টিকের প্রভাবে বিলীন হয়ে গেছে হোগলা পাতার বুনানো জিনিসপত্রের ব্যবহার। সেই সঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে হোগল বনও। আগাছা পরিষ্কারের নামে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে হোগলা বন। জেলার হোগলা বন সংখ্যা অথবা কী পরিমাণ জমিতে হোগলা বন আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই জেলা বনবিভাগ ও কৃষি বিভাগে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আনাচে কানাচে স্যাঁতসেঁতে ভেজা কিংবা খাল-ডোবায় একধরনের লম্বা সবুজ পাতা হোগলা গ্রামীণ পরিবেশে জন্মানো একটি বিশেষ উদ্ভিদ। অঞ্চল ভেদে এটি হোগলা, হোগল, ধাড়িপাতা এসব নামে পরিচিত। হোগলা একটি বহুবর্ষজীবী, একবীজপত্রী, বাতাসে পরাগায়িত, হার্ব জাতীয় উদ্ভিদ। অনাদরে অবহেলায় এ উদ্ভিদটি প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয়। মাটির নিচের কন্দ (বীজ) থেকে প্রথমে পাতার মোথা কান্ড বের হয়। প্রতি গুছিতে সব মিলিয়ে ৮-১২টি পাতা জন্মে। বছর পেরুলে পাতার মধ্যে গোড়া থেকে লম্বা পুষ্প দন্ডের মাধ্যমে ফুল আসে। ফুল থেকে ফল হয় ফল থেকে বীজ হয়।

বীজগুলো তুলার মতো আঁশের সঙ্গে লেগে থাকে। আরও পরিপক্ক হলে বাতাসে উড়ে ভেসে বেড়ায়। কোথাও মাটির স্পর্শে এসে অঙ্কুরিত হয়ে নতুন গাছের জন্ম নেয়। হোগলাপাতা গড়ে ৩-৪ মিটার লম্বা হয়। তবে ১-৭ (৩-২৩ ফুট) মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতার প্রস্ত ৬-২৫ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়। গুচ্ছমূলী উদ্ভিদ এটি। একবার এর চারা মাটিতে পুতা হলে যুগ যুগ ধরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়াতে থাকে। অপ্রয়োজনীয় ফেলে থাকা অনাবাদি পতিত জমিতে হয়। এ গাছে কোনো রোগ বা পোকামাকড়ের আক্রমণ করে না। একেবারে অনাদরে অবহেলায় বিনা খরচে বছর শেষে বেশ উল্লেখযোগ্য আয় এনে দেয়।

দেশে এমনও অনেক পরিবার বা চাষিরা আছেন যারা কেবল শুধু হোগলা চাষ করে জীবন-জীবিকা চালান। অনেক সময় এগুলো নিজেদের জমিতে চাষ করে না। নদীর ধারে যেখানে মালিকানা বিহীন জন্মে সেখান থেকে কেটে বাজারে বিক্রি করে। কেউ কেউ নিজেদের অনুর্ভর জমিতে হোগলার চাষ করেন। ২ বছর পর্যন্ত অনবরত পানি সহ্য করতে পারে এ গাছ।

কৃষিবিদ মাহজুবা তাসনিম ঐশী জানান, সাধারণত হোগলার জমিতে কোনো সারের প্রয়োজন হয় না। তবুও ফেব্রুয়ারি শেষ থেকে মার্চ মাসে একর প্রতি ৫০ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি ও ৩০ কেজি এমওপি, ১ হাজার কেজি গোবর উপরি প্রয়োগ করলে অনেক ভালো ফলন পাওয়া যায়। হোগলাপাতা শুধু পাতা হিসেবেই কার্যকর না। খাদ্য হিসেবে হোগলার গুঁড়ি বেশ সুস্বাদু খাবারের মূল উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হোগলা ক্ষেতে শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে ফুল হয়। এ ফুলে সুমিষ্ট ও সুগন্ধি এক প্রকার গুঁড়া পাওয়া যায় যা হোগলার গুঁড়ি নামে পরিচিত। এ গুঁড়ি গ্রাম বাংলার মানুষের মন জয় করেছে বহুদিন আগ থেকে তা এখন শহরের রান্না ঘরে বহু সমাদৃত এবং উপদেয় খাদ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

তিনি জানান, আমাদের দেশের কৃষকরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বেশ কিছু কৌশল ও বুদ্ধি খাটিয়ে এটিকে আরো নান্দনিক করেছেন। যেমন সকালে বা বিকালে গুঁড়ি ভাঙতে হয়। পাকা গুঁড়ি নরম ঢ্যাবঢেবে হয় এতে প্রচুর পরাগ রেণু থাকে। প্রথমে গুঁড়ি কেটে কাগজে বা পরিষ্কার কাপড়ে ১-২ দিন শুকাতে হয়। এরপর পরিষ্কার পাতিলে বা গামলার মুখে অতি পাতলা কাপড় বেঁধে গুঁড়িতে আস্তে আস্তে টোকা দিতে হয়। এসব গুঁড়ি ২-১ দিন রোদে শুকাতে হয়। কেউ কেউ গুঁড়ি হালকা আগুনে ভেজে নেন। তখন খুব সুঘ্রাণ বের হয়। শুকানো গুঁড়ি বায়ুরোধী পাত্রে বছর পর্যন্ত রেখে দেয়া যায়। প্রতি ফুলের মঞ্জরি থেকে ৫০ গ্রাম গুঁড়ি পাওয়া যায়। হোগলার ৮০-১০০ টি ফুল থেকে ১ থেকে ১.২৫ কেজি গুঁড়ি পাওয়া যায়। এক কেজি গুড়ির স্থানীয় মূল্য ৩৫০-৪০০ টাকা। ১ একর জমি থেকে বছরে ৫-৮ হাজার টাকার গুড়ি সংগ্রহ করা যায়। এ গুঁড়ি থেকে মিষ্টান্ন, ফিরনি, পোলাও, হালুয়া, পায়েশ, সন্দেশ, পিঠা-পুলি, নাড়ু বিস্কুট তৈরি করা হয়।

কৃষকরা জানান, হোগলা পাতা থেকে তৈরি গুড়া পুষ্টিগুণ প্রচুর ও সুস্বাদু হওয়ায় এলাকায় এর বেশ চাহিদা রয়েছে। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে হোগলা পাতার ফুল থেকে গুড়া সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন। বাজারে প্রতি কেজি হোগলের গুড়া ১৬০-১৮০ টাকায় বিক্রি করেন তারা।

উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মনিকা বিশ্বাস জানিয়েছেন, সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া হলে সারাদেশে হোগলা পাতা ও এর গুড়া বাজারজাত করা সম্ভব। তিনি জানান, হোগলা পাতার ফুল থেকে যে পাউডার হয় সেটিই হোগলার গুড়ি। এটি চকচকে হলুদ রঙের হয়। এ গুড়োটি খুব পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু খাবার। হোগলের গুড়া দিয়ে এখানে জনপ্রিয় একটি কেক তৈরি হয়।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer