ঢাকা : ঢাকার মধ্য বাড্ডা এলাকায় একটি বাজারে গ্যাস সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি করেন বিল্লাল মোল্লা। কিন্তু ব্যবসা যে এতোটা জমজমাট হবে - সেটি দু`বছর আগেও ধারণা করতে পারেননি তিনি।
মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে তাঁর দোকানে সিলিন্ডার গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে তিনগুণ। বিল্লাল মোল্লা বর্তমানে প্রতিমাসে প্রায় চার হাজার সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি করেন।সে এলাকায় পাইপ লাইনে তীব্র গ্যাস সংকটের কারণেই মানুষ এলপিজি গ্যাসের উপর উপর নির্ভরশীল হয়েছে।
শুধু মধ্য বাড্ডা নয়, ঢাকা শহরের অধিকাংশ এলাকায় এখন তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে চুলা জ্বলেনা ।দিনে অধিকাংশ সময় লাইনে গ্যাস থাকে না - কিংবা গ্যাস থাকলেও চাপ কম থাকে। ফলে টিম-টিম করে চুলা জ্বলে।
নতুন বাজার এলাকার একজন গৃহিণী নুরুন্নাহার বলেন, "প্রতিদিন সকাল ১০টায় গ্যাস চলে গেলে বিকেল চারটার দিকে আসে। অসুবিধা হইলে আর কী করা যাইব? এমনিভাবেই তো চলতেছে।"ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় গ্যাস সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। শিল্পখাতে গ্যাস সংকট তো আছেই।
পরিস্থিতির উন্নতির তেমন কোন আশাও দেখা যাচ্ছে না। নতুন করে গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধও রাখা হয়েছে।ফলে সরকারও পরামর্শ দিচ্ছে, মানুষ যাতে পাইপ লাইনের গ্যাসের উপর নির্ভরশীল না থেকে এলপিজি ব্যবহার করে।
তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি অপরিহার্য?
গ্যাস সংকট মোকাবেলায় অনেক আগেই সরকার কাতার থেকে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।এজন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে একটি ভাসমান টার্মিনালও নির্মাণ করা হয়েছে।সেখান থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করা হবে।
সরকার বলছে গ্যাস সংকট এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এলএনজি আমদানির কোন বিকল্প নেই।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পরিস্থিতি এ পর্যায়ে পৌঁছলো কেন?জ্বালানী বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, বাংলাদেশ গ্যাস সম্ভাবনাময় এলাকা। গত ১০-২০ বছরে যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার এবং উত্তোলন হলে এলএনজি আমদানি করার প্রয়োজন হতো না বলে মনে করেন অধ্যাপক ইমাম।
ভারত এবং মিয়ানমারের সাথে সমুদ্র-সীমা নিষ্পত্তির পর সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ জোরালোভাবে করা হয়নি বলে তিনি মনে করেন।অথচ ভারত এবং মিয়ানমার তাদের সমুদ্র-সীমায় গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলনের কাজ বেশ দ্রুত গতিতে চালিয়ে যাচ্ছে বলে অধ্যাপক ইমাম উল্লেখ করেন।
তাঁর তথ্য মতে বাংলাদেশের সমুদ্র-সীমায় চিহ্নিত ২৬ টি ব্লকের মধ্যে মাত্র চারটি ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের কাজ খুব ধীর গতিতে চলছে। বাকি ২২টি ব্লক খাল পড়ে আছে।
অধ্যাপক ইমাম বলেন, "আমাদের এখানে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সে কাজ আমরা করি নাই। যার ফলে এ গ্যাসের সংকটটা এক কথায় আমি বলবো যে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।"
কিন্তু বিদ্যুৎ, জ্বালানী এবং খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সরকার গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলনের জন্য সব ধরণের প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছে। বিষয়টি সময় সাপেক্ষ বলে তিনি উল্লেখ করেন।মি: হামিদ বলেন, "আমাদের যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে তাতে গ্যাস আমাদের কুলাচ্ছে না। আমাদের আরো প্রচুর গ্যাস দরকার। আমাদের যে গ্যাস ফিল্ডগুলো ধীরে-ধীরে নি:শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া আমাদের গ্যাস ফিল্ডগুলো ছোট। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশাল।"
"গ্যাস অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান করে গ্যাস পাওয়া গেলে সেটি লাইনে নিয়ে আসতে দুই থেকে আড়াই বছর সময় লাগে। আপনি কি অন্ধকারে বসে থাকতে চান? ভবিষ্যতে গ্যাস পাওয়া যেতে পারে সেজন্য আমি কোন গ্যাস ডেভেলপ করবো না? আপনারা কি চান যে পাওয়ার প্লান্ট চালাবো না?"
বাড়বে গ্যাসের দাম
এলএনজি আসার পরে গ্যাসের দাম অবশ্যই বাড়বে।এ নিয়ে বিশ্লেষকদের মাঝে যেমন কোন সন্দেহ নেই, তেমনি সরকারও বিষয়টি স্বীকার করছে।
পেট্রোবাংলার হিসেব উদ্ধৃত করে অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, " পেট্রোবাংলার হিসেব মতে এখন আমরা যে গ্যাস ব্যবহার করি সেটার দাম প্রতি ঘনমিটার পাঁচ টাকা। এলএনজির দাম প্রতি ঘনমিটারে ৩৩টাকা। দেশীয় গ্যাস এবং আমদানি করা এলএনজি মিক্স করে পাইপ লাইনে দেয়া হবে। পেট্রোবাংলার হিসেব অনুযায়ী তখন প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম হবে ১৩ টাকা।"
ব্যয় সংকুলান করতে কিছুদিন পরপর গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে বলে তিনি মনে করেন।"প্রতিবছর পরিমাণ বাংলাদেশে যে পরিমাণ এলএনজি আমদানি করা হবে তাতে খরচ হবে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো। এ খরচটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক চাপ তৈরি করবে," বলেন অধ্যাপক ইমাম।
তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানী এবং খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ যুক্তি তুলে ধরে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়বে ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার চেয়ে অনেক বেশি হবে। বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজারের মতো শিল্প কারখানা গ্যাস সংকটের কারণে বসে আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।তবে দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকবে বলে ধারণা দিয়েছেন মি: হামিদ। বিবিসি বাংলা