Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৬ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর মোক্ষম হাতিয়ার ভ্রাম্যমাণ আদালত?

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

প্রকাশিত: ০১:১২, ২৭ মে ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর মোক্ষম হাতিয়ার ভ্রাম্যমাণ আদালত?

বহু বছর আগে মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং লিখেছিলেন, ‘যে কোন জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে। ফরাসী দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স লিখেছিলেন, ‘আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে। ভ্রাম্যমান আদালত বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান চরম দূরাবস্থায় উপরোক্ত দু’টি উক্তি চরমভাবে প্রণিধানযোগ্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো আইন মানবতা বিমুখ হয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না।

পাঠক নিশ্চয়ই টাঙ্গাইলের কলেজ শিক্ষার্থী সাব্বির শিকদারের কথা মনে আছে। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, টাঙ্গাইল-৮ আসনের সাংসদ অনুপম শাহজাহানকে নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। সংশ্লিষ্ট থানার ওসি সাব্বির শিকদার নামক এক কলেজ শিক্ষার্থীকে সন্দেহ করে থানায় ডেকে আনে। এরপর একটি কুচক্রী মহলের যোগসাজশে ওই শিক্ষার্থীকে সখিপুর ইউএন’র কার্যালয়ে হাজির করা হয়। এ অবস্থায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওই শিক্ষার্থীকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই বছরের কারাদ- দেন। অথচ ভ্রাম্যমাণ আদালত তথ্যপ্রযুক্তি আইনে কোনভাবেই সাজা দিতে পারেন না। আইনানুযায়ী জিডি হলে তদন্ত হবে। তদন্ত ছাড়া এভাবে দ- দেওয়া যায় না। এটা কেন হলো, তার ব্যাখ্যা জানতে ইউএনও ও ওসিকে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর তলব করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ এই আদেশ দেন। একই সঙ্গে কারাদ- পাওয়া শিক্ষার্থী সাব্বির শিকদারকে জামিন দেন আদালত।

আরেকটি কেইস ষ্টাডি থেকে জানা যায়, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ২০১০ সালের ১ লা জুলাই এক শিক্ষককে এক বছর সাজা দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট হওয়া যায়, এটি ষড়যন্ত্রমূলক ফাঁসানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তৎকালীন ভ্রাম্যমান আদালতের বিচারক ইউএনও মানিকহার রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, এখানে ঘটনা ৮০ ভাগ সত্য মনে হয়েছে।

আরেকটি কেইস ষ্টাডি থেকে জানা যায়, ২০১০ সালের ১৪ ডিসেম্বর মেহেরপুর জেলার সদর উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের হিজলী গ্রামের দুই স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার সময় সদর থানার এসআই সেকেন্দার আলী দুই যুবককে আটক করে সাংবাদিক এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে) সংবাদ দেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও এডিসি মো. আসলাম উদ্দিন হিজলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে দুপুর দেড়টায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে উত্ত্যক্তের শিকার দুই স্কুলছাত্রী, তাদের অভিভাবক ও গ্রামবাসীর বক্তব্য গ্রহণ শেষে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, যুবকদ্বয়কে মিথ্যা ইভ টিজিংয়ের মামলায় জড়িত করে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে এ ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়।

ইদানীং ইভ টিজিং বিষয়ে প্রশাসন তৎপর বিধায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ইভ টিজিংকে মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অপতৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ঘটনাগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, অভিভাবকদের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ইভ টিজারদের গ্রেপ্তার করে। আবার দেখা যায়, উত্ত্যক্ত করার সময় ভিকটিমের অভিভাবক বা স্থানীয় লোকজন উত্ত্যক্তকারীকে আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করছে। ওই ঘটনা এমন নয় যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ইভ টিজিংয়ের ঘটনা ঘটেছে।

অথচ ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯-এর ৬ ধারায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের ক্ষমতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘ধারা ৫-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা ধারা ১১-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনা করার সময় তফসিলে বর্ণিত কোনো আইনের অধীন অপরাধ, যাহা কেবল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য, তাহার সম্মুখে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত হইয়া থাকিলে তিনি উক্ত অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে গ্রহণ করিয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করিয়া এই আইনে নির্ধারিত দ- আরোপ করিতে পারবেন।’ এই আইনের ৮ ধারায় উল্লেখ করা আছে, সংশ্লিষ্ট অপরাধের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনের যে দ-ই নির্ধারিত থাকুক না কেন ২ (দুই) বৎসরের অধিক কারাদ- আরোপ করতে পারবেন না। তবে সংশ্লিষ্ট আইনে কারাদ-ের পরিমাণ যদি কম থাকে (যেমন ১ বৎসর) তার অতিরিক্ত কারাদ- আরোপ করা যাবে না। ৬ ধারা অনুসারে কোনো ভ্রাম্যমাণ আদালত তাঁর সম্মুখে কোনো ঘটনা না ঘটলে বা উদ্ঘাটিত না হলে কোনো আসামিকে এ আইনে দ-াদেশ প্রদান করতে পারবে না এবং দ-াদেশ শুধু আসামির দোষ স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে প্রদান করা যাবে।

আসামি দোষ স্বীকার না করলে আইনের ৭ ধারা অনুসারে অভিযুক্ত ব্যক্তির ব্যাখ্যা সন্তোষজনক হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্তকে অব্যাহতি প্রদান করবেন। তবে প্রদত্ত ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে তিনি অভিযোগটি বিচারার্থে উপযুক্ত এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে প্রেরণ করবেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ৬(১) ধারা অনুসারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সম্মুখে কোনো ঘটনা সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত না হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উত্থাপিত অভিযোগ এখতিয়ার সম্পন্ন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রেরণ করবেন।’

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, উত্ত্যক্তের ঘটনা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সংঘটিত হয়নি। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উচিত, এ ক্ষেত্রে ইভ টিজিংয়ের অভিযোগসহ গ্রেপ্তার করা আসামিকে পুলিশের মাধ্যমে এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে প্রেরণ করা। তবে সত্য যে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে ইভ টিজিংয়ের কোনো ঘটনা ঘটা খুবই বিরল হবে। কারণ ভ্রাম্যমাণ আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেট নিশ্চয় সার্বক্ষণিক স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট ও টার্মিনালের সামনে ওত পেতে বসে থাকবে না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে কোনো ঘটনা উদ্ঘাটনের বিষয় অহরহ হতে পারে।

কোনো ঘটনা ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ আইনের ৭(১) ধারা অনুসারে লিখিত অভিযোগ গঠন করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঠ ও ব্যাখ্যা করে শোনাবেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি আনীত অভিযোগ স্বীকার করেন কি না তা জানতে চাইবেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষ স্বীকার করলে তাঁর স্বীকারোক্তি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লিপিবদ্ধ করে অভিযুক্তের স্বাক্ষর বা টিপসইসহ দুজন উপস্থিত সাক্ষীর স্বাক্ষর বা টিপসই গ্রহণ করবেন। ১৩ ধারা অনুসারে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আপিল করতে পারেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিজে অথবা তাঁর অধীন কোনো অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওই আপিল শুনানি ও নিষ্পত্তি করতে পারবেন। তবে দ-াদেশ যদি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রদত্ত হয়ে থাকে, তা হলে দায়রা জজের আদালতে ওই আপিল করা যাবে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভ্রাম্যমান আদালদের দেয়া ত্রুটিপূর্ণ ৯৮ ভাগ রায় বাতিল করে দেন দায়রা জজ আদালত।

ভ্রাম্যমান আদালতের কথিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহনের ক্ষেত্রে আইনগত বিধান মেনে গ্রহনের কথা থাকলেও তা গ্রহন করা হয়না। কথিত স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি কোন স্বীকারোক্তির রিপোর্টের ফরমে গ্রহন করা হয়না বা স্বীকারোক্তি গ্রহনে আইন প্রদত্ত সময় দেওয়া হয়না। উক্ত স্বীকারোক্তির ক্ষেত্রে বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সকল বিধি বিধান মেনে চলা হয়েছে মর্মে কোন সার্টিফিকেট প্রদান করেন না। ফলে আসামীরা উক্ত রায় ও দন্ডাদেশ প্রদান করায় ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হওয়ার কথা অকপটে স্বীকার করেন।

তবে একথাও সত্য যে, মোবাইল কোর্ট আইন বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, মাদক, বালু উত্তোলন বা খাস জমি দখলের একাধিক ঘটনা এবং সফল ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের প্রাণঘাতী কর্মতৎপরতা অনেকাংশে ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রতিরোধ কর্মে অনুসৃত আইনটিতে আইনের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ ও পর্যুদস্ত করবে।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি উচ্চ আদালত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ সংশ্লিষ্ট আইনের কয়েকটি বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, গবেষক ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা। Email: [email protected]  

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer