Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

পাহাড়, সাগর, মরুভূমি, প্রাসাদের দেশ সালতানাত অব ওমান

বহুমাত্রিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:১৫, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

পাহাড়, সাগর, মরুভূমি, প্রাসাদের দেশ সালতানাত অব ওমান

ফাইল ছবি

ঢাকা : অবশেষে বিমানের পাইলট ঘোষণা করলেন, কিছুক্ষণের মধ্যে বিমান মাস্কাট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবতরণ করবে। যাত্রীদের যারা যারা সিট বেল্ট পরেননি কেবিন ক্রুরা এসে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিচ্ছেন। যাত্রীদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি। জীবন-জীবিকার জন্য তাদের অনেকে নতুন এসেছেন, কেউ আবার ওমানেই পরবাসী। আমি বিমানের জানালা দিয়ে দৃষ্টি ফেরালাম মাস্কাটের আকাশের দিকে।

আকাশে গভীর রাতের আঁধারের স্তব্ধতা ভেঙে আমাদের বহন করা বিমানটি চক্কর দিচ্ছে মাস্কাটের আকাশে। নিচে আলো ঝলমল আরব্য নগরী মাস্কাট। রাত গভীর হলেও মাস্কাট যেন ঘুমায়নি। রাস্তাঘাটে গাড়ি চলছে, স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। আমি আমার ভেতরে এক ধরনের আনন্দ উচ্ছ্বাস অনুভব করলাম। কেন যে জানি না বিমানের ল্যান্ডিং দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে।

যথারীতি বিমান নিরাপদ অবতরণের পর একটা ট্রানজিট বাসে করে আমাদের ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সামনে এনে ছেড়ে দেয়। কেননা টার্মিনাল থেকে বিমানটি ভিড়েছে অনেক দূরে। মাস্কাট এয়ারপোর্ট অনেক বড় হলেও বিমান থেকে যাত্রীদের নামার জন্য কোনো বোডিং ব্রিজ নেই। রাত গভীর হলেও নানান দেশের এয়ার লাইনসে ওমানে আসা যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়।

বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার জন্য অন্যান্য যাত্রীদের মতো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালাম।
ওমানে আসার আগে নেট ঘেটে ওমান সম্পর্কে যা জেনেছি তা আওড়াতে চেষ্টা করলাম।

সালতানাত অব ওমান । ওমান গালফ আর আরব সাগর বিধৌত চমকে দেওয়ার মতো এক আরব্য উপদ্বীপ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিশিষ্ট সাহাবী মাজেন বিন গাদুবা (রা.) এর স্মৃতি ধন্য এই ওমান। আরব্য রজনীর দিগ্বিজয়ী নাবিক সিন্দাবাদের স্মৃতি ধন্য এই ওমান। একদিকে তৃষিত জলধি। আরেক দিকে পৃথিবীর বিখ্যাত বালুকাময় মরুভূমি রুবা আল খালি। মাঝে জাজিরাতুল আরবের এই জনপদের রূপ বৈচিত্র্য পৃথিবীকে অবাক করে দিয়েছে। পাহাড়, সাগর, মরুভূমি, প্রাসাদ আর বিপরীত আবহাওয়ার সেই সহাবস্থান পৃথিবীর খুব বেশি দেশে নেই যা আছে ওমানে। আরব্য উপদ্বীপের এই জনপদে রয়েছে বৈচিত্র্যের সমাহার। পরস্পর বিরোধিতার সমুজ্জল উপস্থিতি এই মরু জনপদে। কেননা দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমের পাহাড়ে সবুজের হাতছানি, জুন জুলাইতে যখন থাকে কুয়াশার চাদরে ঢাকা, তখন দেশের পূর্ব-উত্তরাঞ্চলে লু হাওয়া বইতে থাকে। একদা মৎস্যজীবী আর মরুচারী বেদুঈন জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই জনপদের মানুষের জীবনে আজ লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। তবে শত আধুনিকতার চাপেও তারা ভুলে যায়নি তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কেন্দুরা বা ডিসডাসাকে।

কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই এখানে জীবনের উপস্থিতির সন্ধান পাওয়া গেছে। রাজধানী মাস্কাট প্রথম শতাব্দীতেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আরব উপদ্বীপে প্রবেশের একটি কৌশলগত রাস্তা হিসেবে বহু আগে থেকেই পরিগণিত হয়ে আসছে ওমান। পর্তুগিজরা এ দেশে আসে ১৫০৮ সালে। প্রায় দেড়শ বছর পর ওসমানিরা এসে পর্তুগিজদের তাড়িয়ে দেয় এবং সুলতানি শাসনের সূচনা করে একটি ইয়েমেনি উপজাতির মাধ্যমে। এই শাসন চলে ১৭৪১ সাল পর্যন্ত। পরে পারস্যের আক্রমণে ওসমানী শাসনের পতন ঘটে।ওই সময়টাতে আরব উপদ্বীপের এই জনপদটি ছিল অর্থনৈতিকভাবে খুবই সমৃদ্ধশালী। কেননা ভৌগো্লিক অবস্থানগত কারণেই ওমান ছিল বহির্বিশ্বের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য খুবই উপযোগী।

ওই সময়টাতে দেশটির নাম ছিল ওমান এবং মাস্কাট। তখন দেশটি পরিচালিত হতো একজন সুলতান এবং একজন ইমামের মাধ্যমে যৌথভাবে। ইমাম ছিলেন একজন এবাদি আধ্যাতিক নেতা। এর পর পরই ওমান ব্রিটিশদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। এতে ওমানের রাজনীতি এবং অর্থনৈ্তিক অবস্থা দুর্বল হতে থাকে। ১৯৭০ সালে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর সুলতান কাবুস বিন সাইদের হাত ধরে স্বাধীন ভাবে চলতে শুরু করে সালতানাত অব ওমান। আজকের এই আধুনিক ওমানের  রূপকার বর্তমান সুলতান কাবুস বিন সাঈদ। সামাজিক এবং অর্থনৈ্তিকভাবে দিন দিন দেশটি এগিয়ে যাচ্ছে। কাবুস বিন সাঈদ একজন মহৎ এবং কল্যাণকামী পরম শাসক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তেল ও খনিজ গ্যাস  উত্তোলনের ফলে গোটা রাষ্ট্রের শিক্ষা, বিদুৎ, জীবনযাত্রার মান, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছেন। সম্প্রতি পর্যটন খাতের দিকে নজর দিয়েছে ওমান সরকার।

তিনটি মহাদেশই সমুদ্রপথ ব্যবহারের জন্য আরব উপদ্বীপ সালতানাত অব ওমানকে প্রয়োজন। শতাব্দী কাল থেকে সমুদ্র শাসন করে আসছে ওমান। ভারত মহাসাগর এবং পারস্য সাগরের ওপর বাণিজ্যিক কৌশলগত অবস্থান বাড়িয়ে দেশের অর্থনৈ্তিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।

ওমানের বিভিন্ন  বেদুঈন গোত্র তাদের  ভাসমান জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। কিন্তু ভুলে যায়নি তাদের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে। এই জনপদের মানুষের সরলতা, সহযোগিতা এবং আতিথেয়তা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। বর্তমানে ওমানের মোট জনসংখ্যা ৫০ লাখের উপরে। ওমানী পরিবারে গড়ে পাঁচটি সন্তান রয়েছে। জনসংখ্যা বয়সে তরুণ। ৬০ ভাগ ওমানীর বয়স ২০-এর নিচে। আতিথেয়তা হচ্ছে গাওয়া খেজুর চা।  ওমানে ২০০ জাতের খেজুর উৎপন্ন হয়। চাষিদের ৬০ ভাগ জমি খেজুর উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়।

এ ছাড়া শাকসবজি, ফলমূল ও অন্যান্য খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়। আরব উপদ্বীপ ওমান ২ হাজার বছর  ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। খনিজতেল, গ্যাস দেশটির জীবনযাত্রার গতি পরিবর্তন এনে দিয়েছে। অতি সম্প্রতি দেশটি তার পর্যটন খাতকে  উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন  পদক্ষেপ নিচ্ছে, নির্মাণ করছে বিভিন্ন অবকাঠামো।

বিমানবন্দরের দীর্ঘ আনুষ্ঠানিকতা শেষে যখন বেরিয়ে আসি তখন রাত ৩টা বাজে। মাস্কাট প্রবাসী হারুন ভাই আমাকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দর থেকে আমাদের গাড়ি যখন সুলতান কাবুস হাইওয়ে ধরে গোবরার দিকে আগায়, মাস্কাটে তখন শেষ রাতের নিস্তব্ধতা। অনেক দূর থেকে দেখা যায় সুলতান কাবুস গ্রান্ড মসজিদ এবং আল আমিন মসজিদের সুউচ্চ মিনারগুলো আলোর রশ্মি ছড়াচ্ছে। হয়তো ঘণ্টাখানেক পরই সেই মিনার থেকে ঘোষণা আসবে-আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer