Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৬ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

পারিবারিক বন্ধন ফেরায় মাদকাসক্তদের, পড়ুন পলাশের গল্প

তুহিন আহামেদ

প্রকাশিত: ২১:১০, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

পারিবারিক বন্ধন ফেরায় মাদকাসক্তদের, পড়ুন পলাশের গল্প

ঢাকা : একজন মাদকাসক্ত পাগল নয়, অসুস্থ্য। পরিবারের কোন সদস্য যদি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তাহলে তার প্রতি সকলেই খারাপ আচরন ও দূর্ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এটা জানা জরুরি যে ‘‘পারিবারিক বন্ধনই মাদকাসক্তি প্রতিরোধে মুখ্য ভূমিকা পালন করে’’।

যেসব যুবক আজ মাদকাসক্ত তারা প্রথমেই একজন মাদকাসক্ত বা পরবর্তীতে মাদক ব্যবসায়ী হয়ে উঠে না। তারা প্রথমে কৌতুহল বশত পাড়ার খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশে প্রথমে সিগারেট দিয়ে শুরু করে। পরে গাঁজা, ইয়াবা এবং একসময় ফেনসিডিল, হেরোইনসহ সকল প্রকার মাদক গ্রহণ করে থাকে। মাদক সেবন করতে করতে পরবর্তীতে এরাই হয়ে উঠে একজন ভয়ঙ্কর মাদক ব্যবসায়ী।

সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক অশান্তি, প্রেমজনিত আঘাত, স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে খারাপ বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করাসহ নানা কারণে একজন যুবক মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এসকল কারণ ছাড়াও হতাশার কারণে একজন যুবক মাদকাসক্ত হয়। এসকল কারণে একজন যুবক বা পরিবারের একজন সদস্য যদি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তখন পরিবার তাকে ফেলে দেয়। কিন্তু ছোট এ কাজটির জন্য ওই মাদকাসক্ত ব্যক্তি বা সদস্য আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে।

একসময় সে মাদক সেবন করতে করতে মাদক ব্যবসায়ী হয়ে যায়। এছাড়া মাদক গ্রহণের ফলে সে সমাজে এমন কোন খারাপ কাজ নেই যা সে করতে পারেনা। যেমন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই সহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে এবং এক সময় হয়ে উঠে এলাকার চিহিৃত মাদক ব্যবসায়ী।
এদিকে, যখন সমাজের একটি যুবক মাদকাসক্ত হয়ে উঠে তখন পরিবারতো দূরের কথা সমাজের কেউ তাকে ভাল চোখে দেখে না এবং কোন বিপদ আপদে কেউ তার পাশে থাকে না।

কিন্তু এ মাদকাসক্ত যুবকের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন ও সমাজ তাকে ছুড়ে ফেলে না দিয়ে সহনুভ’তি দেখিয়ে তার সাথে মিশে এর কুফল সম্পর্কে অবহিত করলে হয়তো সে এ রাস্তা থেকে ফিরে আসতে পারতো। তবে যখন সে মাদকাসক্ত হয় তখন তাকে কেউ ভাল করার কথা চিন্তা না করে তার প্রতি অবহেলা আর অবজ্ঞা করতে থাকে।

পরিবারের একজন সদস্য যদি মাদকাসক্ত হয় তবে সর্ব প্রথম তার পরিবারকেই তার দায়ভার নিতে হয়। কেননা পরিবারের সদস্যটি মাদকাসক্ত হওয়ার আগে তার প্রতি কোন যত্ন নেয়া হয়না। সে কোথায় যায়, কার সাথে মেলামেশা করে, কত রাতে সে বাড়ীতে ফিরলো, কোথায় থেকে ফিরলো সে দিকে কোন খেয়াল রাখেনা পরিবার। তবে যখন সে মাকদাসক্ত হলো তখন তার প্রতি বৈশম্যমূলক আচরণ করা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। যার কারণে সে আরো হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং একসময় বড় ধরণের মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসায়ী হয়ে যায়।

একটি বাস্তব উদাহরণ দেয়া যাক, শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার ধামসোনা এলাকায় মাকে নিয়ে একটি ভাড়া বাড়ীতে থেকে অটোরিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো নরসিংদী জেলার পলাশ (ছদ্ম নাম)।

অটোরিক্সা চালিয়ে যে কয় টাকা ইনকাম বা আয় করতো তা দিয়ে মা-ছেলের সংসার ভালভাবেই কেটে যেত। তবে পলাশ (ছদ্মনাম) যে এলাকায় থাকতো সে এলাকায় তার কয়েকজন বন্ধু জোটে যায় এরই মধ্যে। তবে তারা ভাল বন্ধু নয় পলাশ সেটা জানতো। বন্ধুরা নেশা করতো পলাশ সেটা দেখতো এবং একসময় কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে পলাশ একটু সেবন করলো।

প্রথমে অবশ্য গাঁজা দিয়ে শুরু করলো মাদক গ্রহণ করা। একদিন দু’দিন এরপর নিয়মিতভাবেই পলাশ গাঁজার পাশাপাশি ইয়াবা ট্যাবলেট, মদ, ফেনসিডিল এবং হোরাইনের প্রতিও সে আসক্ত হয়ে পড়লো।
এদিকে পলাশের মায়ের সন্দেহ হলে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে সে জানায় একটু আকটু খেয়ে থাকে বন্ধুদের সাথে তবে সেটা বেশী পরিমানে নয়। মায়ের সাথে মিথ্যা বলাটাই যেন পলাশের কাল হয়ে দাড়ালো।

এরপর থেকে পলাশ আরো বেশী পরিমানে মাদক সেবন করতে লাগলো। এক সময় মাদক সেবন না করলে ঠিক থাকতে পারতো না সে। সে মাদক সেবন করার জন্য বেকুল হয়ে পড়তো। এদিকে পলাশ তার অটোরিক্সা চালানো বন্ধ করে দেয়। সে মাদক সেবন ছাড়া আর কিছুই যেন করতে চাইতো না।

এমন কি পকেটে যখন মাদক কেনার টাকা থাকতো না সে কাচা বাজারে গিয়ে পেয়াজের বস্তা চুরি, কারো গোয়ালের গরু চুরি এমনকি ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। কয়েকবার অবশ্য ধরা পরে জনগণের ধোলাইও খেয়েছে। এছাড়া মায়ের গলার স্বর্ণের চেইন পর্যন্ত চুরি করে তা দিয়ে মাদক কিনে সেবন করেছে সে।

এতো কিছুর পরেও এ যুবকটি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ জীবনে ফিরে এসেছে। অনেকেই হয়তো আমার এ লেখাটি পড়ে মনে করতে পারেন মনগড়া বানানো একটা গল্প মাত্র এটি। লেখাটি গল্পের মতো হলেও পুরোটাই সত্যি যে এরকম একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি এতো কিছু করার পর আবার কিভাবে সুস্থ জীবনে ফিরে আসলো। হ্যা তবে বলছি, আমি উপরেই লিখেছি ‘‘পারিবারিক বন্ধন মাদকাসক্তি প্রতিরোধে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।’’

যখন পলাশ নামের এ যুবকটি বুঝতে পারলো সে পরিবারের, সমাজের এমনকি রাষ্ট্রের কাছে একজন ঘৃণ্য ব্যক্তি। তখন সে তার মায়ের কাছে এসে বলে মা আমি ভাল হতে চাই, আমি আবার আগের জীবনে ফিরে আসতে চাই। কিন্তু পারিনা। কারণ আমি মাদকাসক্ত, মাদক সেবন না করলে আমি ঠিক থাকতে পারিনা।

তখন তার মা আশুলিয়ার ভাদাইল এলাকার একটি বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ছেলে পলাশ কে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে সাদরে গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ এবং তাদের দেয়া নিয়ম অনুযায়ী পলাশকে সেখানে থাকতে হয়। বেশ কিছুদিন থাকার পর পলাশকে সেখান থেকে তাদের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

চার মাস সেখানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হয়ে মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে আসে। তবে পলাশ কখনো চিন্তাও করেনি যে আবার সে সুস্থ্য জীবনে ফিরে আসতে পারবে। এটা সম্ভব হয়েছে তার ইচ্ছা শক্তি ও পরিবারের সদস্যের একটু সহানুভুতিশীলতা।

আমার সাথে পাঠকরাও কন্ঠ মিলিয়ে বলতে পারেন ‘‘পারিবারিক বন্ধন মাদকাসক্তি প্রতিরোধে মূখ্য ভুমিকা পালন করে।” আর অবশ্যই মনে রাখতে হবে ‘একজন মাদকাসক্ত পাগল নয়, অসুস্থ্য। তাকে ভালবাসা দিয়ে, সহানুভুতি দিয়ে কাছে নিয়ে এর কুফল সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক

 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer