Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১০ ১৪৩১, বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪

নেতাজির জন্মদিন : প্রবল হচ্ছে রহস্য উন্মোচনের দাবি

বহুমাত্রিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ০২:৫৮, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭

আপডেট: ১৪:৩৮, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭

প্রিন্ট:

নেতাজির জন্মদিন : প্রবল হচ্ছে রহস্য উন্মোচনের দাবি

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

ঢাকা : ২৩ জানুয়ারি, সোমবার অখন্ড ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান সংগ্রামী্ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন। 

১৮৯৭ সালের এই দিনে ভারতের বর্তমান ওড়িশা রাজ্যের কটকে জন্ম নেওয়া কিংবদন্তি এই স্বাধীনতা সংগ্রামী্ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।

বিরল কুটনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিভার অধিকারী সুভাষচন্দ্র বসু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের সহযোগিতা নিয়ে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গড়ে তুলেন। গঠন করেন আজাদ হিন্দ সরকার, যা লাভ করে বিশ্বের বহু দেশের স্বীকৃতি। 

নেতাজির নেতৃৃত্বে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’র প্রবল প্রতিরোধের মুখে ব্রিটিশ বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ইম্ফলসহ অনেক মুক্ত ভারতভূমিতে উঠে স্বাধীনতার পতাকা। বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় নেতাজিকে কৌশলগত কারণে যুদ্ধের ময়দান থেকে সরে যেতে হয়। তখনকার টালমাটাল বিশ্ব পরিস্থিতিতে ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট নেতাজি তাইওয়ানে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বলে খবর প্রচার করা করে কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। যদিও তথাকথিত সেই মৃত্যুর খবর প্রমাণিত হয়নি।

পরবর্তীকালে ভারতবর্ষ সহ বিশ্বের নানা দেশে নেতাজির বেঁচে থাকার অসংখ্য প্রমাণ পাওয়ার কথা দাবি করেছেন গবেষক ও স্বজনরা। আশির দশকে ভারতের উত্তরপ্রদেশের ফায়জাবাদে গুমনামি বাবা নামে এক সাধুর আবির্ভাব হয়। অনেকে দাবি করে সেই গুমনামি বাবাই হচ্ছেন নেতাজি। তবে বিগত সাত দশক ধরে চলা নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। তাঁর বিরল দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের কারণে তিনি এখনো আপামর ভারতবাসীসহ বিশ্বের দেশে দেশে পূজিত হন। বহু রাজনীতিক-বিপ্লবী ইতিহাস থেকে হারিয়ে যেতে থাকলেও নেতাজি সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আরও বেশি করে ভারতবাসীর কাছে-নতুন প্রজন্মের কাছে পূজনীয় হয়ে উঠছেন। 

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু পরপর দুইবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত এবং কংগ্রেসের বৈদেশিক ও আভ্যন্তরিণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনার জন্য তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। নেতাজি মনে করতেন গান্ধীজির অহিংসার নীতি ভারতের স্বাধীনতা আনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এই কারণে তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের পক্ষপাতী ছিলেন। পরে তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের পূর্ণ স্বরাজ দাবি জানাতে থাকেন।

রাজনৈতিক জীবনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে এগারো বার কারারুদ্ধ করেছিল, তবুও তিনি তাঁ নীতির সাথে আপস করেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলেও তাঁর মতাদর্শের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি; বরং এই যুদ্ধকে ব্রিটিশদের দুর্বলতার সুবিধা আদায়ের একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন।

যুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি লুকিয়ে ভারত ত্যাগ করে কাবুল হয়ে রাশিয়ায় পৌছান। সেখান থেকে ইতালি হয়ে জার্মান পৌছান। পরে জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন এবং পরে তার নেতৃত্ব দান করেন। এই বাহিনী সৈনিকেরা ছিলেন মূলত ভারতীয় যুদ্ধবন্দী এবং ব্রিটিশ মালয়, সিঙ্গাপুর সহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত মজুর।

জাপানের আর্থিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় তিনি নির্বাসিত আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

কংগ্রেস যেখানে ভারতের অধিরাজ্য মর্যাদা বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে মত প্রদান করে, সেখানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন। ভগৎ সিংহের ফাঁসি ও তাঁর জীবন রক্ষায় কংগ্রেস নেতাদের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ সুভাষচন্দ্র গান্ধী-আরউইন চুক্তি বিরোধী একটি আন্দোলন শুরু করেন। তাঁকে কারারুদ্ধ করে ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তিনি ভারতে ফিরে এলে আবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। 

শিক্ষাজীবনে সুভাষচন্দ্র কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়ে তিনি প্রায় নিয়োগপত্র পেয়ে যান। কিন্তু স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ সুভাষ সেই নিয়োগ প্রত্যাখ্যান করেন।

অমৃতসর হত্যাকাণ্ড ও ১৯১৯ সালের দমনমূলক রাওলাট আইন ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুদ্ধ করে তুলেছিল। ভারতে ফিরে সুভাষচন্দ্র স্বরাজ নামক সংবাদপত্রে লেখালিখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ।

১৯২৪ সালে দেশবন্ধু যখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন, তখন সুভাষচন্দ্র তাঁর অধীনে কর্মরত ছিলেন। ১৯২৫ সালে অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাঁকেও বন্দী করা হয় এবং মান্দালয়ে নির্বাসিত করা হয়। এখানে তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।

প্রায় বিশ বছরের মধ্যে সুভাষ চন্দ্র মোট ১১ বার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাকে ভারত ও রেঙ্গুনের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল। ১৯৩০ সালে তাকে ইউরোপে নির্বাসিত করা হয়। তাঁর পিতার মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সরকার তাকে শুধু মাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের উদ্দ্যেশ কিচ্ছুক্ষণের জন্য কলকাতা আসার অনুমতি দেয়।

১৯৩৮ সালে তিনি গান্ধীর বিরোধীতার মুখে ভারতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য ত্রিপুরা সেশনে কংগ্রেসের প্রসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে গান্ধি পট্টভি সিতারামায়াকে সমর্থন দেন; নির্বাচনের ফলাফল শোনার পর গান্ধি বলেন "পট্টভির হার আমার হার"। কিন্তু জয়যুক্ত হলেও তিনি সুষ্ঠু ভাবে কার্য সম্পাদন করতে পারছেলেন না।

সুভাষ চন্দ্র বসু এ নির্বাচনে জয় লাভ করলেও গান্ধির বিরোধীতার কারণে তাকে পদত্যাগ করতে হয়।তিনি নিজেই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন এবং অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি জাতীয় পরিকল্পনা পরিষদের প্রস্তাবনা দেন।

সুভাষ চন্দ্র বসু প্রস্তাব করলেন, কবে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের স্বাধীনিতার অনুমোদন দেবে তার জন্য বসে না থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে সুবিধা নেওয়া উচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা নির্ভর করে অন্য দেশের রাজনৈতিক, সামরিক ও কুটনৈতিক সমর্থনের উপর। তাই তিনি ভারতের জন্য একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার উদ্দ্যেগ গ্রহণ করেণ।

ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণের ব্যাপারে সুভাষ বসু নাখোশ ছিলেন। তিনি সে সময় গৃহ বন্দি ছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন ব্রিটিশরা তাঁকে যুদ্ধের আগে ছাড়বে না। তাই তিনি দুইটি মামলার বাকি থাকতেই আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানি পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। মস্কো থেকে রোম হয়ে তিনি জার্মানি পৌছেন। তিনি বার্লিনে মুক্ত ভারতীয় কেন্দ্র (Free India Center) গড়ে তোলেন।

ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের সাহায্য প্রার্থনা করেণ। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে হিটলারের উদাসিনতা তার মনোবল ভেঙ্গে দেয়। ফলে ১৯৪৩ সালে সুভাষ বসু জার্মান ত্যাগ করেণ। একটি জার্মান সাবমেরিন তাকে সমুদ্রের তলদেশে একটি জাপানি সাবমেরিনে পৌছিয়ে দেয়, সেখান থেকে তিনি জাপান পৌছেন।

এদিকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বীরত্বে হিটলার-তোজো’র মতো একন্যায় তন্ত্রে বিশ্বাসীরাও তাঁর সামনে মাথা অবনত করে মৈত্রীর দিকে হাত বাড়ান। ভারতের অরবিন্দ ঘোষ, সূর্য সেন ভগৎ সিংয়ের মতো নেতারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুলের মতো কবিরা তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। সমস্ত ভারতবাসীর কাছে পরম পূজনীয় হয়ে উঠেন তিনি।

জাতীয়তাবাদী নেতা রাসবিহারী বসু নিজের হাতে গড়ে উঠা ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি)’র দায়িত্ব ১৯৪৩ সালে সুভাষ চন্দ্র বসুকে হস্তান্তর করেন । একটি আলাদা নারী বাহিনী (রানি লক্ষ্মীবাঈ কমব্যাট) সহ এতে প্রায় ৮৫,০০০ হাজার সৈন্য ছিল। এই বাহি্নীর কর্তৃত্ব ছিল প্রাদেশিক সরকারের হাতে, যার নাম দেওয়া হয় "মুক্ত ভারতের প্রাদেশিক সরকার" (আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ)। এই সরকারের নিজস্ব মুদ্রা, আদালত ও আইন ছিল। অক্ষ শক্তির ৯ টি দেশ এই সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। আইএনএ-র সৈন্যরা জাপানিজদের আরাকান ও মেইক্টিলার যুদ্ধে সাহায্য করে।

সুভাষ চন্দ্র বসু আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের উপর আইএনএ-র হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে হতাশ হয়ে আইএনএ-তে যোগ দেবে। কিন্তু এই ব্যাপারটি তেমন ব্যাপকভাবে ঘটল না। যুদ্ধে পরিস্থিতির অবনতির সাথে সাথে জাপান তার সৈন্যদের আইএনএ থেকে সরিয়ে নিতে থাকে। একই সময় জাপান থেকে অর্থের সরবরাহ কমে যায়। অবশেষে, জাপানের আত্মস্বমর্পন এর সাথে সাথে আইএনএ-ও আত্মসমর্পন করে। নেতাজি একটি বিমানে করে রাশিয়ার মাঞ্চুরিয়ার দিকে যাত্রা করেন। এরপর থেকেই তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তাকে নিয়ে শুরু হয় নানা গল্প-যা রূপকথার কাহিনীকেও হার মানায়।

পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতের সরকার নেতাজির মৃত্যু রহস্য উন্মোচনে একাধিক কমিটি করলেও সেসবের নিরপেক্ষতা নিয়ে বহু প্রশ্ন রয়েছে। এমনকী ব্রিটিশদের সাথে হাত মিলিয়ে নেতাজিকে মৃত প্রমাণ করতেও তৎকালীন অনেক শীর্ষ নেতা মরিয়া হয়ে উঠেন। সাম্প্রতিক সময়ে তরুণ প্রজন্মসহ লাখো নেতাজি ভক্ত দাবি জানাচ্ছেন সরকারের দখলে থাকা নেতাজি বিষয়ক ফাইলগুলো জনসম্মূখে আনার। বহু নেতাজি গবেষক দবি করেছেন, তৎকালের শীর্ষনেতাদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়ার ভয়ে ফাইলগুলো দীর্ঘদিন ধরে চেপে রাখা হয়েছে। 

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer