(ভারতীয় গণমাধ্যমবর্তমান’র সৌজন্যে) দুঃখকে তুমি করে তুলেছ সুযোগ, বিঘ্নকে করেছ সোপান। সে সম্ভব হয়েছে। যেহেতু কোনও পরাভবকে তুমি একান্ত সত্য বলে মানোনি। ঋষিকবি স্নেহের সুভাষকে এই ভাষাতেই দেশনায়ক পদে অভিষিক্ত করেছিলেন আর আহ্বান করেছিলেন তার পাশে সমস্ত দেশবাসীকে দাঁড়াতে। সে অবকাশ ভারতবাসী না পেলেও দেশান্তরী নেতাজি সুভাষের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী, সেদিন পাশে থেকে সমর্থন জানিয়েছিল বিশ্বের এগারোটি স্বাধীন দেশ ও তাদের রাষ্ট্রপ্রধান। কৈশোরে এবং যৌবনে একাধিকবার বিবেকানন্দের সেবার আদর্শে গৃহত্যাগ করেছেন, দেশপ্রেমের তীব্র আগুনে মৃত্যুভাবনা উপেক্ষা করে বারংবার ঝাঁপিয়ে পড়েছেন পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করতে।
আজ তার দেশবাসী নিজেকে স্বাধীন নাগরিক হিসাবে দাবি করতে পারে, মুক্ত ভাবনাচিন্তা চেতনায় দেশে-বিদেশে নিজেকে মেলে ধরতে পারে। কিন্তু পুরোটা পারেনি দেশপ্রেমিক ত্যাগীদের মনে রাখতে। তাদের রাষ্ট্রও চেষ্টা করেনি অখণ্ড ভারতসাধকের বাস্তবমুখী চিন্তা চেতনাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ গড়ার মাধ্যমে সত্যিকার দেশভক্ত গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে। আজকের পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ এই তিন টুকরো রাজনৈতিক ভূখণ্ড সেদিন নেতাজির আজাদ হিন্দ আন্দোলনের শরিক হয়েছিল, শহিদ হয়েছিলেন অজস্র নিবেদিতপ্রাণ। সেখানে কোনও জাতধর্ম ভাষার নিরপেক্ষ মুখোশের আড়াল প্রয়োজন পড়েনি।
শুধু ব্রিটিশের কারাগার নয়, পৃথিবীর কোনও কারাগার তোমার গতি রুদ্ধ করতে পারেনি। শতচক্রান্তের জাল ছিন্ন করে আজ তোমার কর্মকাণ্ডের নানা নমুনা আর সাক্ষ্য প্রকাশিত হচ্ছে নানা মহাফেজ খানার দলিল আর আলোকচিত্রের ফুটেজে। ইতিহাস নতুন করে লেখার দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু হিমশীতল উপেক্ষায় একদিকে মূল স্রোতের কিছু গণমাধ্যমের দাপাদাপি আর বুদ্ধিজীবীদের একাংশের একদেশদর্শিতা দেশের মহত্তম দেশপ্রেমিকের মূল্যায়নে ব্যর্থ।
ভারতপথিক সুভাষ চন্দ্রের ভারত ভাবনা ভাবিত করতে পারছে না দেশপ্রেমিকের দাবিদার কয়েকটি রাজনৈতিক দলের চিন্তাবিদ ও নেতাদের। লোকসভা যখন ন্যাশনাল হেরাল্ড কিংবা নোটকাণ্ডে উত্তাল হয় সেখানে উচ্চারিত হয় না আজাদ হিন্দ ফান্ডের কোটি কোটি টাকার লুটতরাজ প্রসঙ্গ। কারণ আর যা-ই থাক ব্রিটিশের ‘যুদ্ধপরাধী’ সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ রাষ্ট্র ভারত আদৌ গৌরবান্বিত হবার স্বপ্ন দেখে না। অথচ চরকা-শোভিত ত্রিবর্ণ পতাকাই অধিকৃত ভারত ভূমিতে উত্তোলন করে ছিলেন নেতাজির মুক্তি কামী বীর যুবকেরা। আত্ম বিস্মৃত ভারতবাসীর একটা অংশ তাই ২৩ জানুয়ারিকে আন্তর্জাতিক দেশপ্রেম দিবসের দাবি জানাতে কুণ্ঠিত হয়।
মাতৃভাষার সম্মান ২১ ফেব্রুয়ারির মাধ্যমে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হয়েছে বাংলাদেশ। আর নিজ দেশেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দৈন্যের শিকার হয়েছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক মানুষটি। জাতির জনক যাঁকে বলেছেন দেশপ্রেমিকদের রাজপুত্র। সেই রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন ভারতবর্ষ শাসন করেছে কিন্তু ভুলেও নেতাজি প্রাপ্য মর্যাদা যাতে না পান সে বিষয়ে কার্পণ্য প্রকাশে দ্বিধা করেনি। একের পর এক সাজানো কমিটি-কমিশন গড়ে একদিকে তাঁকে নিশ্চিত মৃত প্রমাণের পাহাড় প্রমাণ প্রচেষ্টা, অন্যদিকে পাঠ্যসূচি থেকে প্রকল্প পরিকল্পনায় শুধুই পারিবারিক প্রচারের ঢক্কানিনাদ।
আন্দামান নিকোবরকে আজাদ হিন্দ সরকার নামকরণ করে শহিদ ও স্বরাজদ্বীপ। কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গের মতোই সেলুলার জেল উন্মুক্ত করেছিলেন নেতাজি সুভাষ। দিল্লির শাসক সম্প্রদায় দেশের নানা শহরের নামকরণে পরিবর্তন আনলেও শহিদ স্বরাজ দ্বীপ নামকরণে ব্যর্থ। রাষ্ট্রসংঘের সনদে ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি অন্য চোদ্দোটি রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত সরকারও যুদ্ধপরাধীদের শাস্তির জন্য স্বাক্ষর করেছেন। সেই সময় বাংলাদেশ যুদ্ধ শুরু হয়নি, আজও ভারত সরকার স্পষ্টভাবে জানাতে পারেনি ওই সময় ভারতের যুদ্ধপরাধী কে বা কারা ছিলেন।
নিজ দেশে পরবাসী অনামা সন্ন্যাসী গুমনামী বাবা ওরফে ভগবানজির প্রকৃত পরিচয় কী এই নিয়ে উত্তরপ্রদেশে আদালতের রায়ে গঠিত হয়েছে বিষ্ণুসহায় কমিশন। কেন সেই সন্ন্যাসী স্বনামে প্রকট হতে পারেননি কিংবা কেনই-বা তার পরিচয় জানতে গোয়েন্দাকুল ব্যস্ত ছিল তার উত্তর হয়তো-বা লুকিয়ে আছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধপরাধী তালিকার মেয়াদ ৩০ বছর থেকে আজীবন বাড়িয়ে দেবার রহস্যের মধ্যে।
সোভিয়েত রাশিয়ার যুদ্ধ অপরাধী তালিকায় একমাত্র একজন ভারতীয় ছিলেন যাঁকে ১৯৪৬ সালেই মুক্তি দেওয়া হয়। সম্ভবত আন্তর্জাতিক আইন এবং মিত্রশক্তির সখ্যের চুক্তির কারণে বহিঃবিশ্বের কাছে সঠিক পরিচয় তুলে ধরা হয়নি অথচ সেই সোভিয়েত ভূমি থেকে সুভাষচন্দ্রের বেতার ভাষণ তিনবার সম্প্রচারিত হয়েছে এবং তা বাংলার গভর্নর জেনারেলের রেডিও মনিটর কে সি কর রেকর্ড করেছিলেন। নানা ফাইলের সূত্রে এমন সত্যই ক্রমশ প্রকাশ্যে আসছে। বিষ্ণুসহায় কমিশন নিয়ে বাংলার গণমাধ্যম এতটা সক্রিয় নয় যতটা উত্তরপ্রদেশ। অথচ ভগবানজির সঙ্গে যে সমস্ত বাঙালি যুক্ত ছিলেন, যাঁরা এবং যাঁদের পরিবার পশ্চিমবাংলায় এখনও আছেন তাঁদের সাক্ষ্য গ্রহণ জরুরি।
এক বাঙালি সন্ন্যাসীর প্রকৃত পরিচয় প্রতিষ্ঠার আইনি উদ্যোগকে এখনও বাংলা সার্বিকভাবে কেন স্বাগত জানাতে প্রস্তুত নয় কিংবা ভাষান্তরে বলা যায় কমিশন এ রাজ্যে আসছেন না কেন তা বিস্ময়কর হলেও অনুমান করা যায়। একমাত্র জাগ্রত জনমত যেমন ফাইল প্রকাশ-এর ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছে তেমনি সত্যান্বেষী গণমাধ্যমই পারে নেতাজি সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে অসম্পূর্ণ সত্যের বৃত্তকে সম্পূর্ণ করতে।
লেখক: নেতাজি গবেষক